যেসব সুন্নত পালনে সুখী হবে দাম্পত্য জীবন
প্রত্যেক দম্পতিই সুখ শান্তিময় জীবন কামনা করে। দাম্পত্য জীবনে কেউই বিবাদ-অশান্তি চায় না। কিন্তু দাম্পত্য জীবনে পরস্পর দীর্ঘ সময় একসঙ্গে থাকলে কারণে-অকারণে রাগ-অভিমানের মতো ঘটনা ঘটে। এটি যদি দীর্ঘায়িত হয় তবে তা স্থায়ী কলহে রূপ নেয়। এসবের মাঝেও এমন সব কাজ আছে, যেসব কাজে দাম্পত্য জীবন হয় সুখ ও শান্তিময়। যার অধিকাংশই নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নত। সেসব কাজগুলো কী?
আদর্শ দম্পতি বা পরিবার গঠনে স্বামীর অবদান গুরুত্বপূর্ণ। একজন আদর্শ স্বামী হতে হলে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নত ও দিকনির্দেশনা মেনে চলার বিকল্প নেই। সুখময় ও শান্তিপূর্ণ দাম্পত্য জীবনের জন্য ইসলামি জীবন ব্যবস্থা অনুসরণীয়। তাহলো-
১. স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করা
নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্ত্রীদের সঙ্গে পরামর্শ করতেন। তিনি শুধু ঘরোয়া বিষয়ে তাদের মতামত নিতেন তা নয়; বরং মুসলিম উম্মাহর অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদির ক্ষেত্রেও তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিতেন। ইসলামের ইতিহাসে ‘হুদায়বিয়ার সন্ধি’র মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপটে তিনি উম্মুল মুমিনিন উম্মে সালমা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে পরামর্শ নিয়েছিলেন। সেই মতামতের অসাধারণ কার্যকারিতা পরে। (বুখারি ২৭৩১)
সুন্নতের অনুসরণে যেকোনো কাজেই স্ত্রীর মতামত নেওয়া চাই। অনেক সময় দেখা যায়- চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যান্য ব্যক্তিগত কাজে স্ত্রীর মতামত নেওয়া হয় না। আবার অনেকে বিষয়টি গুরুত্বও দেন না। অথচ এটা অনুচিত ও অসুন্দর।
২. পরিবারের প্রতি যত্নশীল হওয়া ও সময় দেওয়া
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার স্ত্রীদের প্রতি অত্যন্ত যত্নশীল ছিলেন। তিনি প্রতিদিন সব স্ত্রীর খোঁজ নিতেন এবং সবার সঙ্গে সময় কাটাতেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, ‘ফজরের নামাজের পর নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাজের স্থানে বসে থাকতেন। সূর্যোদয়ের আগ পর্যন্ত লোকেরাও তার চারপাশে বসে থাকত। এরপর তিনি তার প্রত্যেক স্ত্রীর কাছে যেতেন, তাদের সালাম দিতেন, তাদের জন্য দোয়া করতেন আর যার দিন থাকত তার কাছে গিয়ে বসতেন।’ (তাবরানি ৮৭৬৪)
পরিবারে স্ত্রীকে মানসিক সহযোগিতা করা ও সঙ্গ দেওয়া, তাদের খোঁজ-খভর নেওয়া আদর্শ স্বামীর দায়িত্ব। স্ত্রী-সন্তানদের সব ধরনের অধিকার পূরণ করাও তার কর্তব্য। যথাযথভাবে তাদের সঙ্গে সময় ব্যয় করাও চাই।
হজরত উকবা ইবনে আমের রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমি একদিন আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে উভয় জাহানের মুক্তির পথ কী জানতে চাইলাম। উত্তরে তিনি বললেন, ‘কথাবার্তায় সংযমী হও, পরিবারের সঙ্গে তোমার অবস্থান যেন দীর্ঘ হয় এবং নিজের ভুলের জন্য আল্লাহর কাছে অনুতপ্ত হও।’ (তিরমিজি ২৪০৬)
৩. পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি থাকা
স্ত্রীর সামনে নিজেকে পরিপাটি রাখা মুমিনের গুণ। নিজের পরিচ্ছন্নতা ও পরিপাটি ধরে রাখাও আবশ্যক। স্বামীকে গোছালো পাওয়া প্রতিটি স্ত্রীর অধিকার। হাদিসে পাকে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু (সা.) বলেন, ‘আমি আমার স্ত্রীর জন্য পরিপাটি থাকতে পছন্দ করি; যেমনটা আমিও চাই স্ত্রী আমার জন্য সাজুক।’ (বায়হাকি, হাদিস : ১৪৭২৮)
৪. আনন্দ বিনোদনের ব্যবস্থা করা
স্ত্রীর মানসিক আনন্দ-বিনোদনের জন্য বিভিন্ন রকম ব্যবস্থা রাখা জরুরি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্ত্রীদের সঙ্গে ক্রীড়া-কৌতুক ও আনন্দ করতেন। হাদিসে পাকে এসেছে-
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, এক সফরে তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে ছিলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সঙ্গীদের বললেন, তোমরা এগিয়ে যাও। এরপর তিনি হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে বললেন, এসো দৌড় প্রতিযোগিতা করি। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, ‘আমি তার সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগিতা করলাম এবং দৌড়ে তার চেয়ে এগিয়ে গেলাম। (নাসাঈ ৮৯৪৫)
৫. সহানুভূতি জানানো
কখনো যদি কোনো কারণে স্ত্রীরা মান-অভিমান করে বা মন খারাপ করে তবে সে সময় তাদের সহানুভূতি জানানো সুন্নত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের প্রতি তেমন সহানুভূতির আচরণ করতেন। এক সফরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটু সামনে এগিয়ে যান; আর সাফিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহা সামান্য পেছনে পড়ে যান। এতে তিনি কেঁদে ফেলেন। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন নিজ হাতে তার চোখ মুছে দেন এবং কাঁদতে নিষেধ করেন।’ (নাসাঈ ৯১৬২)
৬. খুনসুটি ও সখ্যতা গড়ে তোলা
স্ত্রীদের প্রতি আচার-আচরণে ভালোবাসা প্রকাশ করতেন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তাদের সঙ্গে নানা ধরনের খুনসুটি করতেন। এতে পারস্পরিক আন্তরিকতা ও সখ্যতা বৃদ্ধি পায়। হাদিসে পাকে এসেছে-
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেছেন, ‘আমি ও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একই পাত্র থেকে গোসল করতাম যা আমাদের মধ্যে থাকত। তিনি আমার চেয়ে অগ্রগামী হলে (দ্রুত গোসল করে পানি নিলে) আমি বলতাম, আমার জন্য রাখুন! আমার জন্য রাখুন!’ (মুসলিম, হাদিস : ৩২১)
৭.ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ
কাজে ও আচরণে ভালোবাসা প্রকাশ করা। স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা বহিঃপ্রকাশ নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নত। আল্লাহর রাসুল (সা.) বিভিন্ন সময়ে স্ত্রীদের সঙ্গে বিভিন্ন রোমাঞ্চকর কথা বলতেন। হৃদয়াপ্লুত কথায় তাদের মুগ্ধ করতেন। এক হাদিসে আছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা সম্পর্কে বলেছেন, ‘আমার মনে তার প্রতি ভালোবাসা ঢেলে দেওয়া হয়েছে।’ (মুসলিম ২৪৩৫)
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার প্রশংসা করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘খাবারের মধ্যে সারিদ যেমন সবার সেরা; নারীদের মধ্যে আয়েশা সবার সেরা।’ (বুখারি ৩৪১১)
৮. স্ত্রীকে সুন্দর নামে ডাকা
স্ত্রীদের সঙ্গে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আচরণ একটি আদর্শ দাম্পত্য জীবনের শ্রেষ্ঠ উপমা। তার পবিত্র জীবনীতে স্ত্রীদের সঙ্গে আন্তরিকতা পূর্ণ ও প্রেমময় সব চিত্র ছিল উজ্জ্বল। পরবর্তী সময়ে তাঁর সম্মানিতা স্ত্রীগণ আবেগ-উচ্ছ্বাসের সঙ্গে তা বর্ণনা করেছেন। এক হাদিসে এসেছে-
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো কখনো ভালোবেসে আমাকে হুমায়রা বা লাল গোলাপ বলে ডাকতেন।’ (ইবনে মাজাহ ২৪৭৪)
৯. ঘরের কাজে সহযোগিতা করা
স্ত্রীকে ঘরের কাজে হযোগিতা করা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নত। এটা আদর্শ স্বামীর বৈশিষ্ট্যও বটে। এক হাদিসে এসেছে-
হজরত আসওয়াদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি একবার হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে জিজ্ঞাসা করলাম, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘরে কী কাজ করতেন? উত্তরে তিনি বললেন, ‘তিনি ঘরের কাজে ব্যস্ত থাকতেন, অর্থাৎ গৃহস্থালি কাজে পরিবার-পরিজনের সহযোগিতায় থাকতেন। যখন নামাজের সময় হতো, তখন নামাজে চলে যেতেন। (বুখারি ৬৭৬)
অন্য বর্ণনায় হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, ‘তিনি নিজের কাপড় নিজেই সেলাই করতেন। নিজের জুতা নিজেই মেরামত করতেন এবং সাধারণ মানুষের মতোই ঘরের কাজকর্ম করতেন।’ (তিরমিজি)
১০. একই পাত্রে আহার করা
নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর স্ত্রীদের সঙ্গে একই পাত্রে খাবার গ্রহণ করতেন। হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেছেন, ‘আমি হাড় থেকে গোশত কামড়ে নিতাম। তারপর আমি যেখানে মুখ রাখতাম আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখানে তার মুখ রাখতেন। অথচ তখন আমি ঋতুমতী ছিলাম। আমি পাত্র থেকে পানি পান করতাম। তারপর তিনি সে স্থানে মুখ রাখতেন, যেখানে আমি মুখ রাখতাম। অথচ আমি তখন ঋতুমতী ছিলাম।’ (নাসাঈ ৭০)
১১. ভালো কাজে বাহবা দেওয়া
স্ত্রীর যে কোনো ভালো কাজে উৎসাহ বা বাহবা দেওয়া। তাঁর ভালো কাজের স্বীকৃতি দেওয়া চাই। হজরত খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘মানুষ যখন আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে তখন সে আমার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে, মানুষ যখন আমাকে বঞ্চিত করেছে তখন সে তার সম্পদ দ্বারা আমাকে সমৃদ্ধ করেছে, আল্লাহ আমাকে তার গর্ভ থেকে সন্তান দিয়েছেন যখন আল্লাহ অন্য স্ত্রীদের সন্তান থেকে আমাকে বঞ্চিত করেছেন।’ (মুসনাদে আহমদ ২৪৮৬৪)
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাম্পত্য জীবন ছিল আন্তরিকতা ও অসংখ্য রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতায় ভরপুর। জীবনের সবক্যিছুর মতো একজন আদর্শ স্বামীর জন্য সর্বোত্তম আদর্শ রেখে গেছেন তিনি। তাঁর আদর্শ অনুসরণেই গড়ে ওঠবে সুখ-শান্তিময় আদর্শ দাম্পত্য জীবন।
এমএমএস/জিকেএস