জুমার প্রথম খুতবা : নবিজির (সা.) প্রতি ভালোবাসা
আজ শুক্রবার। জুমার দিন। ১৬ ডিসেম্বর ২০২২ ইংরেজি, ০১ পৌষ ১৪২৯ বাংলা, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৪ হিজরি। আজ জমাদিউল আউয়াল মাসের তৃতীয় জুমা। আজকের জুমার আলোচ্য বিষয়- নবিজির (সা.) প্রতি ভালোবাসা। এ বিষয়টিও কোরআন সুন্নাহর বর্ণনায় বিশেষ স্থান দখল করে আছে।
আলহামদুলিল্লাহ! সব প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি একক, তার কোনো অংশীদার নেই। যিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি দরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক। যার পরে আর কোনো নবি নেই। মহান রাব্বুল আলামিন মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে উম্মতের জন্য অনুগ্রহ করে পাঠিয়েছেন। মহান আল্লাহ তাআলা বিষয়টি ঘোষণা দেন এভাবে-
لَقَدْ مَنَّ اللهُ عَلَی الْمُؤْمِنِیْنَ اِذْ بَعَثَ فِیْهِمْ رَسُوْلًا مِّنْ اَنْفُسِهِمْ یَتْلُوْا عَلَیْهِمْ اٰیٰتِهٖ وَ یُزَكِّیْهِمْ وَ یُعَلِّمُهُمُ الْكِتٰبَ وَ الْحِكْمَةَ وَ اِنْ كَانُوْا مِنْ قَبْلُ لَفِیْ ضَلٰلٍ مُّبِیْنٍ.
‘আল্লাহ মুমিনদের প্রতি বড় অনুগ্রহ করেছেন; তিনি তাদেরই নিজেদের মধ্য থেকে তাদের কাছে রাসুল প্রেরণ করেছেন। যিনি তাদের সামনে আল্লাহর আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করেন, তাদের পরিশুদ্ধ করেন এবং তাদের কিতাব ও হিকমাহ শিক্ষা দেন, যদিও তারা এর আগে সুস্পষ্ট গোমরাহীতে লিপ্ত ছিল।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ১৬৪)
প্রিয় মুসল্লিগণ!
গত জুমার আলোচনাও ছিল নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ভালোবাসা। হেদায়াত ও সফলতার পথ সম্পর্কে মানুষ অজ্ঞ ছিল। ছিল পথহারা, দিশেহারা। অতপর মহান রাব্বুল আলামিন হেদায়েতের বার্তা দিয়ে প্রেরণ করলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে। তিনি এসে মানুষকে সত্য-মিথ্যার পথ চিনিয়েছেন। মানুষের জন্য সত্য দ্বীন নিয়ে এসেছেন। নাজাতের পথ দেখিয়েছেন। আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের পদ্ধতি শিখিয়েছেন। এ ছিল মানুষের প্রতি আল্লাহর মহা অনুগ্রহ। এই অনুগ্রহের বর্ণনা পবিত্র কোরআনে এভাবে এসেছে-
لَقَدْ مَنَّ اللهُ عَلَی الْمُؤْمِنِیْنَ اِذْ بَعَثَ فِیْهِمْ رَسُوْلًا مِّنْ اَنْفُسِهِمْ یَتْلُوْا عَلَیْهِمْ اٰیٰتِهٖ وَ یُزَكِّیْهِمْ وَ یُعَلِّمُهُمُ الْكِتٰبَ وَ الْحِكْمَةَ وَ اِنْ كَانُوْا مِنْ قَبْلُ لَفِیْ ضَلٰلٍ مُّبِیْنٍ.
আল্লাহ মুমিনদের প্রতি বড় অনুগ্রহ করেছেন; তিনি তাদেরই নিজেদের মধ্য হতে তাদের কাছে রাসুল প্রেরণ করেছেন। যিনি তাদের সামনে আল্লাহর আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করেন, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমাহ শিক্ষা দেন, যদিও তারা এর আগে সুস্পষ্ট গোমরাহীতে লিপ্ত ছিল।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ১৬৪)
প্রিয় মুসল্লিগণ!
হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করেছেন-
لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ، حَتّى أَكُونَ أَحَبّ إِلَيْهِ مِنْ وَالِدِهِ وَوَلَدِهِ وَالنّاسِ أَجْمَعِينَ
‘তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও সমস্ত মানুষ থেকে প্রিয় হব।’ (বুখারি ১৫)
এ হাদিস শুধু নীতিবাক্যই নয় বরং বাস্তবেই নবিপ্রেমের এ স্তরে প্রত্যেক মুমিনকে পৌঁছাতে হবে। সকলের উপর, সবকিছুর উপর প্রাধান্য দিতে হবে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে। এমনকি নিজের জানের উপরও।
প্রিয় মুসল্লিগণ!
তাহলে শুনুন হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর ঘটনা। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে হিশাম রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন-
كُنّا مَعَ النّبِيِّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ وَهُوَ آخِذٌ بِيَدِ عُمَرَ بْنِ الخَطّابِ، فَقَالَ لَهُ عُمَرُ: يَا رَسُولَ اللهِ، لَأَنْتَ أَحَبّ إِلَيّ مِنْ كُلِّ شَيْءٍ إِلّا مِنْ نَفْسِي، فَقَالَ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: لاَ، وَالَذِي نَفْسِي بِيَدِهِ، حَتّى أَكُونَ أَحَبّ إِلَيْكَ مِنْ نَفْسِكَ، فَقَالَ لَهُ عُمَرُ: فَإِنّهُ الآنَ، وَاللهِ، لَأَنْتَ أَحَبّ إِلَيّ مِنْ نَفْسِي، فَقَالَ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: الآنَ يَا عُمَرُ!
একদিন আমরা নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে ছিলাম। নবিজি ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাত ধরা ছিলেন। ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলে উঠলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনি আমার কাছে সবকিছু থেকে প্রিয়, তবে আমার জান ছাড়া। তখন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, না ওমর, এতে হবে না। যে সত্তার হাতে আমার জান; তাঁর কসম! (ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি পূর্ণাঙ্গ মুমিন হতে পারবে না,) যতক্ষণ না আমি তোমার কাছে তোমার জানের চেয়েও প্রিয় না হই। পরক্ষণেই ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, হাঁ এখন তা হয়েছে; আল্লাহর কসম! (এখন থেকে) আপনি আমার কাছে আমার জানের চেয়েও প্রিয়। তখন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হাঁ ওমর! এখন হয়েছে।’ (বুখারি ৬৬৩২)
প্রিয় মুসল্লিগণ!
নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ভালবাসাই হলো মুমিনের সম্বল। মুমিনের সবচে বড় দৌলত ঈমান। এই মহা দৌলতের স্বাদ যার নসীব হয়, সমস্ত দুঃখ কষ্ট তার কাছে তুচ্ছ মনে হয়। ভালোবাসার কারণে সকল তিক্ত মিষ্টে পরিণত হয়।
আর এই স্বাদ সে-ই পায়, যার কাছে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের ভালোবাসা সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে থাকে। হাদিসে পাকে এসেছে, হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু এক হাদিসে বর্ণনা করেছেন, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
ثَلَاثٌ مَنْ كُنّ فِيهِ وَجَدَ بِهِنّ حَلَاوَةَ الْإِيمَانِ: مَنْ كَانَ اللهُ وَرَسُولُهُ أَحَبّ إِلَيْهِ مِمّا سِوَاهُمَا...
তিনটি গুণের অধিকারী ব্যক্তি ঈমানের স্বাদ আস্বাদন করবে। তন্মধ্যে প্রথম হল, যার কাছে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সবচেয়ে প্রিয় হবে।’ (মুসলিম ৬৭)
ঈমানের স্বাদ আস্বাদনের নগদ ও সবচেয়ে বড় ফায়দা হল ইবাদত ও আনুগত্যে আগ্রহ লাভ হওয়া। বরং ইবাদতই তখন প্রশান্তির কারণ হয়ে যায়। হৃদয়ে যখন ঈমানের মিষ্টতা সঞ্চারিত হয়, তখন ইবাদতে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ উদ্যমী হয়ে ওঠে।
তাই নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ভালবাসা যেমনিভাবে ঈমান ও আমলে উৎকর্ষ লাভের উপায়, তেমনি তা আখিরাতে মহাসাফল্য অর্জনের সম্বল। আর প্রত্যেক মুমিনের কাঙ্ক্ষিত সে সাফল্য হল আখেরাতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গলাভ। স্বয়ং নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলে গেছেন-
المَرْءُ مَعَ مَنْ أَحَبّ
‘যে ব্যক্তি যাকে ভালোবাসবে তার সঙ্গেই তার হাশর হবে।’ (মুসলিম ২৬৪০)
প্রিয় মুসল্লিগণ!
এ সম্পর্কে বড়ই শিক্ষণীয় ও চমৎকার একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু। তিনি বলেছেন, ‘এক ব্যক্তি রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলো : ইয়া রাসুলাল্লাহ! কেয়ামত কবে হবে? তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন, কী প্রস্তুতি নিয়েছ কেয়ামতের জন্য? সে জবাব দিল- আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের ভালোবাসা। তখন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘নিশ্চয়ই যাকে তুমি ভালোবাস, (কেয়ামতের দিন) তার সঙ্গেই থাকবে।
হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ইসলাম গ্রহণের পর আমাদের কাছে সবচে’ খুশির বিষয় ছিল নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই কথা- ‘নিশ্চয়ই যাকে তুমি ভালোবাস, (কেয়ামতের দিন) তার সঙ্গেই থাকবে।’
হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আর আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে ভালোবাসি। আবু বকর ও উমরকেও। তাই আশা রাখি, আখেরাতে আমি তাঁদের সঙ্গেই থাকব, যদিও তাঁদের মতো আমল আমি করতে পারিনি।’ (মুসলিম ২৬৩৯)
সুতরাং আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলের ভালোবাসা যদি সবকিছুর উপরে না হয় তাহলে মুমিন পথ চলবে কীভাবে? আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলের আদেশের সামনে সমর্পিত হবে কীভাবে? আজ বাধা হবে সন্তান, কাল স্ত্রী, পরশু পিতা। কখনো বা জানের মায়ায় লংঘিত হবে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নির্দেশ। আর মুমিন তো সেই, যে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের মহব্বত ও নির্দেশের সামনে সবকিছু পিছে ঠেলতে জানে।
আল্লাহ তাআলা যেন আমাদের সবাইকে আখেরাতে তাঁর রাসুলের সঙ্গ দান করেন। আমিন।
এমএমএস/জেআইএম