মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার পরিণাম কী?
দুনিয়া ও আখেরাতের অত্যাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সাক্ষ্য দেওয়া। দুনিয়াতে যেভাবে সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে বিচার-ফয়সালা করা হয়। তেমনি পরকালেও বিচার-ফয়সালায় এ সাক্ষ্যের বিষয়টি থাকবে। এ কারণেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানুষকে সত্য সাক্ষ্য দেওয়ার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন। মিথ্যা সাক্ষ্য থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। কারণ মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া মারাত্মক অপরাধ। হাদিসে এসেছে-
হজরত আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমি কি তোমাদেরকে সবচেয়ে বড় তিনটি বড় (কবিরা) গুনাহ সম্পর্কে অবহিত করব না? উপস্থিত সবাই বললেন, হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসুল! অবশ্যই বলুন। তিনি বললেন, (সেগুলো হলো)-
১. আল্লাহর সঙ্গে শিরক করা;
২. পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া, তিনি হেলান দিয়ে বসা অবস্থায় ছিলেন। এবার সোজা হয়ে বসলেন এবং বললেন, শুনে রাখ
৩. মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া। এ কথাটি এত অধিকবার বলতে থাকলেন যে, সাহাবাগণ মনে মনে বলতে লাগলেন, ‘আর যদি তিনি না বলতেন। (বুখারি)
মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া মারত্মক অপরাধ। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হেলান দিয়ে বসা থেকে সোজা হয়ে বসে একাধিকবার মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার ব্যাপারে তাগিদ করাই প্রমাণিত হয় যে, মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া মারাত্মক অপরাধ। পাশাপাশি সত্য সাক্ষ্যকে গোপন করাও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া নামান্তর।
মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার পরিণাম
১. কবিরা গুনাহ
কবিরা গুনাহের অন্যতম হলো মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করা। হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কবিরা গুনাহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, الإِشْرَاكُ بِاللهِ، وَعُقُوْقُ الْوَالِدَيْنِ، وَقَتْلُ النَّفْسِ، وَشَهَادَةُ الزُّوْرِ، ‘আল্লাহর সঙ্গে শরিক করা, পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া, কাউকে হত্যা করা এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া।’ (বুখারি ২৬৫৩; মুসলিম৮৮) ।
২. শিরকের সমতুল্য আপরাধ
মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া শিরকের ন্যায় মহাপাপ। এ সম্পর্কে হজরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন-
عُدِلَتْ شَهَادَةُ الزُّوْرِ بِالْإِشْرَاكِ بِاللهِ ثُمَّ قَرَأَ فَاجْتَنِبُوا الرِّجْسَ مِنَ الأَوْثَانِ وَاجْتَنِبُوْا قَوْلَ الزُّوْرِ حُنَفَاءَ لِلَّهِ غَيْرَ مُشْرِكِيْنَ بِهِ-
‘মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া আল্লাহর সঙ্গে শিরক করার সাথে সমতুল্য। এরপর তিনি কোরআনের আয়াত পড়লেন- ‘অতএব তোমরা মূর্তির অপবিত্রতা থেকে দূরে থাক, মিথ্যা কথা পরিহার কর, একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর বান্দা হয়ে যাও। তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক কর না (সুরা হজ : আয়াত ৩০-৩১)। (বায়হাকি)
৩. অন্যের প্রতি জুলুম
মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া অন্যের প্রতি জুলুম করার শামিল। এই জুলুমের দ্বারা কখনো অন্যের সম্পদ এমনকি কখনো অন্যের জীবনও চলে যেতে পারে। হজরত উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেছেন, ‘একদিন দুই ব্যক্তি উত্তরাধিকার সম্পর্কীয় ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হয়ে সাক্ষী ছাড়া শুধু প্রাপ্যের দাবি নিয়ে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসেছিল। এমতাবস্থায় তিনি বললেন-
‘আমি যদি তোমাদের কাউকে তার ভাইয়ের হক (তোমাদের একজনের মিথ্যা বলার কারণে) দিয়ে দেই, তখন আমার সে ফয়সালা দোষী ব্যক্তির জন্য হবে জাহান্নামের একখন্ড আগুন। এ কথা শুনে তারা উভয়েই বলে উঠলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমার অংশটি আমার সঙ্গীকে দিয়ে দিন। তখন তিনি বললেন, না, বরং তোমরা উভয়ে (সমানভাবে) বণ্টন করে নাও। আর বণ্টনে হক পন্থা অবলম্বন করবে এবং পরস্পরের মধ্যে লটারি করে নেবে। এরপর তোমরা একে অপরকে ঐ অংশ থেকে ক্ষমা করে দেবে।’ (আবু দাউদ ৩৫৮৪; মিশকাত ৩৭৭০)
৪. অন্যের হক নষ্ট করা হয়
মিথ্যা সাক্ষ্যর দেওয়ার মাধ্যমে অন্যের হক নষ্ট করা হয়। একজনের হক অন্যকে দিয়ে দেওয়া হয় এবং অন্যকে তার প্রাপ্য হক থেকে বঞ্চিত করা হয়। আর এটা যেহেতু বান্দার হক সেহেতু বান্দা ক্ষমা না করলে আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘তোমরা কি জান নিঃস্ব কে? সাহাবীগণ বললেন, আমাদের মাঝে নিঃস্ব সেই ব্যক্তি যার কোনো অর্থ ও বাহন নেই। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘আমার উম্মতের মধ্যে নিঃস্ব হচ্ছে ঐ ব্যক্তি, যে নামাজ, রোজা ও জাকাতের নেকি নিয়ে কেয়ামতের মাঠে উপস্থিত হবে। অপরদিকে সে (দুনিয়াতে) অন্যায়ভাবে কাউকে গালি দিয়েছে, অপবাদ দিয়েছে, কারো সম্পদ ভক্ষণ করেছে, কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে, এমন ব্যক্তিরাও উপস্থিত হবে। তখন তার নেকি থেকে তাদের এক এক করে পরিশোধ করা হবে। কিন্তু তাদের পাপ্য পরিশোধের আগে তার নেকি শেষ হয়ে গেলে তাদের পাপ থেকে (জুলুম পরিমাণ) নিয়ে তার উপর চাপানো হবে এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।’ (মুসলিম ২৫৮১; তিরমিজি ২৪১৮; মিশকাত ৫১২৮)
৫. মিথ্যা সাক্ষ্যদাতার ভাল আমল কবুল হবে না
মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার কারণে ব্যক্তির ভাল আমলও আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। হাদিসে এসেছে-
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রোজা সম্পকে বলেন-
مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُّوْرِ وَالْعَمَلَ بِهِ وَالْجَهْلَ فَلَيْسَ لِلَّهِ حَاجَةٌ أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ،
‘যে লোক মিথ্যা কথা বলে এবং সে অনুসারে কাজ করা আর মূর্খতা পরিহার করে না, আল্লাহর কাছে তার পানাহার বর্জনের কোনো প্রয়োজন নেই।’ (বুখারি ৬০৫৭; আবু দাউদ ২৩৬২; তিরমিজি ৭০৭; ইবনু মাজাহ ১৬৮৯)
৬. হালাল-হারামে রদবদল হয়
মিথ্যা সাক্ষ্যের দ্বারা আল্লাহর হালালকৃত বিষয় অনেক সময় হারাম করা হয় আবার অনেক সময় হারামকে হালাল করা হয়।
৭. কেয়ামতের অন্যতম আলামত
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
إِنَّ بَيْنَ يَدَىِ السَّاعَةِ تَسْلِيمَ الْخَاصَّةِ وَفُشُوَّ التِّجَارَةِ حَتَّى تُعِيْنَ الْمَرْأَةُ زَوْجَهَا عَلِى التِّجَارَةِ وَقَطْعَ الأَرْحَامِ وَشَهَادَةَ الزُّوْرِ وَكِتْمَانَ شَهَادَةِ الْحَقِّ وَظُهُوْرَ الْقَلَمِ-
‘কেয়ামতের কাছাকাছি সময়ে ব্যক্তি বিশেষকে নির্দিষ্ট করে সালাম দেওয়ার প্রচলন ঘটবে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। ফলে স্বামীর ব্যবসায়ে স্ত্রীও সহযোগিতা করবে। রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়তা ছিন্ন করা হবে। মিথ্যা সাক্ষ্যদানের প্রচলন হবে এবং সত্য সাক্ষ্য গোপন করা হবে, লেখনীর প্রসার ঘটবে।’ (মুসনাদে আহমাদ ৩৮৭০; আদাবুল মুফরাদ ৮০১)
৮. জাহান্নামে যাওয়ার কারণ
মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার কারণে অনেকেরই জাহান্নামে যাওয়ার কারণও হতে পারে। হজরত আবু যার রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছেন, কোনো লোক জ্ঞাতসারে নিজ পিতাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে পিতা বলে দাবি করলে সে আল্লাহর সঙ্গে কুফরি করলো এবং যে ব্যক্তি নিজেকে এমন বংশের সঙ্গে সম্পর্কিত দাবি করল যে বংশের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই, সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নামে বানিয়ে নিল।’ (বুখাবি ৩৫০৮; মুসলিম ৬১)
সুতরাং সব সময় সত্য সাক্ষ্য প্রদান করতে হবে। সত্য সাক্ষ্য গোপন থেকে বিরত থাকতে হবে। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে সাক্ষ্যের ক্ষেত্রে সত্য সাক্ষ্য দেয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/জিকেএস