ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ধর্ম

যে ফুলের খুশবুতে সারা জাহান মাতোয়ারা

ইসলাম ডেস্ক | প্রকাশিত: ০৫:৫৬ পিএম, ০৬ অক্টোবর ২০২২

ফখরুল ইসলাম নোমানী

মানবতার মুক্তির দিশারী সাইয়েদুল মুরসালিন রাহমাতুল্লিল আলামিন হজরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমন বিশ্ববাসীর জন্য রহমত। তিনি জগতের সর্বোত্তম সৃষ্টি, তিনি মহান আদর্শের অধিকারী, তিনি মানব জাতির শ্রেষ্ঠতম পথিকৃৎ, তিনি মহান আল্লাহপাকের প্রিয়তম রাসুল, প্রিয় বন্ধু, বিশ্ব সভ্যতায় যাঁর অবদান সর্বাধিক। আল্লাহ তাআলা তাঁকে সমগ্র বিশ্ব মানবের কল্যাণের জন্য পাঠিয়েছেন। যুগ যুগ ধরে লক্ষাধিক আম্বিয়ায়ে কেরাম যাঁর আগমনের অপেক্ষা করেছেন। তিনি সাইয়েদুল মুরসালিন, খাতামুন নবিয়্যিন। যাঁর দিদার না পেলে ব্যাকুল হতেন ফেরেশতা জিবরিল আমিন। নবিজির সঙ্গে ২৩ বছরের জীবনে ২৪ হাজার বার দেখা করেছেন তিনি। অবশেষে তিনি মহান আল্লাহ পাকের দিদার পেয়ে ধন্য হয়েছেন। তিনি সর্বপ্রথম মহাশূণ্য পরিভ্রমণকারী। বর্তমান বিশ্বে রয়েছে তাঁর কয়েক শত কোটি অনুসারী। তিনি ছিলেন আদর্শে অতুলনীয়, অদ্বিতীয়, চিরস্মরণীয়, চির অনুকরণীয়, চির সংরক্ষিত ও প্রশংসিত। তিনিই সেই অনন্য ব্যক্তিত্ব; ‘যে ফুলের খুশবুতে সারা জাহান মাতোয়ারা’।

বিখ্যাত সাহাবি হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, ‘আমি কোনো কস্তরী, কোনো আম্বর এবং কোনো সুগন্ধি বস্তু পাইনি; যা হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামের চেয়ে অধিকতর খুশবুদার। যদি কারও সঙ্গে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মোসাফাহা (করমর্দন) করতেন তবে সমস্ত দিন ঐ ব্যক্তির হাতে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মোসাফাহার খুশবু লেগেই থাকতো।

আর যদি কখনও কোনো শিশুর মাথায় তিনি হাত বুলিয়ে দিতেন তবে খুশবুর কারণে ঐ শিশু হাজারো শিশুর মাঝে অত্যন্ত সহজে পরিচিত হতো।

একবার নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর ঘরে বিশ্রাম করছিলেন। (এ সময় গরমে) নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দেহ মোবারক ঘেমে উঠলো। হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর মা নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দেহ মোবারকের ঘাম একটি শিশিতে  পুরে নিচ্ছিলেন। নবিজি সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি করছো? তিনি জবাব দিলেন, হুজুর! আমরা এগুলোকে আমাদের সুগন্ধির সঙ্গে মিশ্রিত করবো। কেননা আপনার ঘাম সর্বোত্তম সুগন্ধি।

ইমাম বুখারি রাহমাতুল্লাহি আলাইহির বর্ণনায় হজরত যাবের রাদিয়াল্লাহু  আনহু  সুত্রে ‘তারিখে কবির’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যদি কোনো দলের সঙ্গে কোথাও গমন করতেন, যদি কেউ তাঁর অনুসন্ধান করতো তবে সে শুধু খুশবুর কারনেই তাঁর সন্ধান পেয়ে যেতো। তাই তিনি সেই অপূর্ব বিশ্ময়কর ফুল- ‘যে ফুলের খুশবুতে সারা জাহান মাতোয়ারা’।

নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ প্রদত্ত অহির আলোকে মানব সমাজকে ইসলামের দাওয়াত দেন। ইসলামের আলোকে আলোকিত হয়ে সাহাবিগণ পৃথিবীর শ্রেষ্ট মানুষে পরিণত হন। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সাহাবিগণ ইসলামের আলো সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দেন।

নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব। তাঁর পবিত্র জন্মও হয়েছে অলৌকিক পন্থায়। তাঁর জন্মে গোটা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনা। পৃথিবীর ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি, যাঁর স্মরণ সব জাতি, সব যুগে করেছে। কিন্তু কবে এই মহামানব জন্মগ্রহণ করেছেন তা নিয়ে সব আলোচনা রবিউল আউয়াল মাস ঘিরেই হয়ে থাকে। পবিত্র ১২ রবিউল আউয়াল। ইসলামের ইতিহাসে দিনটি অত্যন্ত তাৎপর্যমন্ডিত। বিশেষত দুটি কারণে ১২ রবিউল আউয়াল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ দিন।

প্রথমত : সব ইতিহাসবিদের ঐকমত্য বর্ণনা মতে এই দিনেই নবিজি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-লক্ষ-কোটি ভক্ত-অনুরক্তকে এতিম বানিয়ে এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন।

দ্বিতীয়ত : প্রসিদ্ধ অভিমত অনুযায়ী এই ১২ রবিউল আউয়াল নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জন্মগ্রহণ করেছেন।

হজরত আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, আখেরি জামানার শেষ নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, ‘আমি মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আবদুল্লাহর পুত্র, আবদুল মোত্তালেবের পৌত্র। আল্লাহপাক সমগ্র সৃষ্টি জগতের মাঝে আমাকে সর্বোত্তম হিসাবে সৃষ্টি করেছেন। অর্থাৎ মানব রুপে সৃষ্টি করেছেন; মানুষকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন, আরব এবং আজম। আমাকে উত্তম ভাগ অর্থাৎ আরবের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন। আর আরবের মধ্যে কয়েকটি গোত্র রয়েছে। আমাকে উত্তম গোত্র অর্থাৎ কোরাইশ গোত্রে সৃষ্টি করেছেন। আর কোরাইশদের মধ্যেও কয়েকটি বংশ সৃষ্টি করেছেন। আমাকে সর্বোত্তম বংশ বনি হাশেম বংশে সৃষ্টি করেছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে উত্তম আর বংশের দিকেও আমি সর্বোত্তম। সুবহানাল্লাহ। (মিশকাত, তিরমিজি)

হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন যে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন যে ব্যক্তি একবার আমার প্রতি দরুদ পাঠ করে আল্লাহপাক তার প্রতি দশটি রহমত নাজিল করেন এবং তার দশটি গুনাহ ক্ষমা করে দেন এবং তার দশটি মর্যাদা  বৃদ্ধি করেন।’

হজরত ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন যে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, কেয়ামতের দিন সেব্যক্তি আমার সর্বাধিক নৈকট্য লাভ করবে যে বেশি পরিমানে আমার প্রতি দরুদ প্রেরণ করবে। ওলামায়ে কেরাম এ হাদিসের পরিপ্রেক্ষিতে বলেন, ‘যে দয়াল নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র নাম শোনার পর প্রথমবার দরুদ পাঠ করা ওয়াজেব। তারপর সেই মজলিশে যতবার তাঁর মহান নাম শুনবে ততবার দরুদ পাঠ করা মুস্তাহাব।

মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন সর্বোত্তম চরিত্রের মানুষ। ক্ষমা, উদারতা, ধৈর্য-সহিষ্ণুতা, সততা, সত্যবাদিতা, দয়া, দানে, কাজ-কর্মে, আচার-আচরণে, মানবতা ও মহত্ত্বে তিনি ছিলেন সর্বকালের সকল মানুষের জন্য উত্তম আদর্শ। তাই সবারই উচিত, তাঁর জীবনাদর্শ মেনে চলা।

নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দুনিয়ায় আগমন আল্লাহর বিশেষ রহমত। তাঁর আবির্ভাবে মানুষের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও সমগ্র বিশ্ব পরিণত হয় এক বেহেশতি পরিবেশে। তাই তো আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হে নবি! আমি আপনাকে পাঠিয়েছি বিশ্বজগতের জন্য শান্তি ও রহমতস্বরূপ।’ (সুরা আম্বিয়া : আয়াত ১০৭)

নবিজি ছিলেন যেমন বিনয়ী, তেমন মিষ্টভাষী। অতি রাগের মুহুর্তেও তিনি কোনো দিন কাউকে কটু কথা বলেননি। তার মধুময় ব্যবহারে শত্রুও মুগ্ধ হয়ে যেতো। অসতর্ক মুহুর্তেও তার মুখ থেকে কোনো দিন মিথ্যা কথা বের হয়নি। সত্যবাদিতার জন্যই আরববাসীরা তাকে ‘আল-আমিন’ ‘আস সাদিক’ উপাধিতে ভুষিত করেছিল।

অভাবগ্রস্থকে তিনি কখনো হতাশ করেননি। নিজে না খেয়েও তিনি গরিব মুসাফির ও ক্ষুধার্তের ক্ষুধা নিবৃত্তি করতেন। শত্রু-মিত্র, স্বজন-পরজন সকলের জন্য তার করুনা সমভাবে বর্ধিত হতো। বিপদের মুহুর্তেও তিনি কোনো দিন অসৎ পন্থা অবলম্বন করেননি বা মিথ্যার আশ্রয় নেননি।

আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন দৃঢ় মনোবল ও অসীম ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তিনি ছিলেন ক্ষমার মূর্ত প্রতীক। তিনি আমাদের জন্য অনুকরণীয় অনুসরণীয় একমাত্র ‘উসওয়াতুন হাসানা’ তথা ‘সর্বোত্তম মহান আদর্শ’। তিনি ছিলেন মানবতার মুক্তির দূত। তাহার আদর্শ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আসতে পারে দুনিয়া ও পরকালের শান্তি।

পৃথিবীতে যারাই মহান ও মহৎ গুণের অধিকারী হয়েছেন তাদের সবাই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র গুণে গুণান্বিত হয়ে সর্বোচ্চ মর্যাদাবান হয়েছেন। আল্লাহ তাআলা তাঁর নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ফুলের ঘ্রাণে পুলোকিত হওয়ার জন্য তাওফিক দান করুন।

আসুন, আমরা সবাই নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর বেশি বেশি দরুদ পাঠ করি; সবাই পড়ি- ‘আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা সাইয়েদিনা মুহাম্মদ, ওয়া আলা আলিহি ওয়া আসহাবিহি ওয়া সাল্লাম’। আমাদের হৃদয়ে জারি থাকুক তার ভালোবাসা। আমিন।

লেখক : ইসলামি চিন্তক ও গবেষক।

এমএমএস/জিকেএস

আরও পড়ুন