অপমৃত্যু থেকে বাঁচার ৪ উপায়
জীবনের শেষ সময় প্রতিটি মানুষের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শেষ সময়ের ভালো ও মন্দ পরিণতির উপর পরকালের ভালো-মন্দও অনেকাংশে নির্ভর করে। শেষ পরিণতিই বলে দেয় কে জান্নাতি আর কে জাহান্নামি। এ কারণেই মানুষের প্রকাশ্য দুশমন শয়তান শেষ মুহূর্তে মানুষকে খারাপ কাজের দিকে ধাবিত করে। যার ফলে ঘটে অপমৃত্যুর মতো ঘটনা। তা থেকে বাঁচার উপায় কী?
শেষ ভালো যার, সব ভালো তার। এজন্য প্রত্যেক মুমিন মুসলমানের জীবনের শেষ পরিণতি যেন হয় ভালো। অন্তিম মুহূর্তের এ সময়গুলো শয়তান যেন মন্দের দিকে ধাবিত করতে না পারে সে জন্য ৪টি উপায় অবলম্বন করা জরুরি।
অপমৃত্যু কী?
কোনো ব্যক্তির স্বাভাবিক মৃত্যুর বাইরে মৃত্যু হওয়াই অপমৃত্যু। অজানা কেউ তাকে হত্যা করলে বা নিজে নিজে আত্মহত্যা করলে বা জীবজন্তুর আঘাতে মারা গেলে বা দুর্ঘটনায় মারা গেলে সেই মৃত্যুকেই সাধারণত অপমৃত্যু বলে। এ অপমৃত্যু মুমিনের জন্য সবচেয়ে বড় বিপদজ্জনক। তবে অপমৃত্যু যে সব সময় খারাপ মানুষেরই হয়, তা কিন্তু নয়। বরং অনেক সময় ভালো মানুষেরও অপমৃত্যু ঘটে। ৪টি উপায় অবলম্বন করতে পারলেই অপমৃত্যু থেকে বেঁচে থাকা সহজ। তাহলো-
১. আকিদা-বিশ্বাস মজবুত করা
অনেক সময় আকীদা-বিশ্বাসে গণ্ডগোল হলে অপমৃত্যুর মতো ঘটনা ঘটে। অনেক সময় দেখা যায়, জীবনভর সঠিক পথে চলার চেষ্টায় লিপ্ত। আত্মশুদ্ধিমূলক জীবন-যাপনে অভ্যস্ত। কিন্তু আকীদা-বিশ্বাসগিত সমস্যা থাকে। ফলে মৃত্যু যন্ত্রণার সময় তার আসল চেহারা বেরিয়ে আসে। দেখা গেছে, মৃত্যু যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে নিজেই আত্মহত্যা করে বসেছে। এ জন্য অপমৃত্যু থেকে বাঁচতে নিজের আকিদা-বিশ্বাস মজবুত করার বিকল্প নেই।
২. গুনাহ থেকে বিরত থাকা
অনবরত গুনাহ করে যাওয়ার কারণেই অনেকে জীবনের শেষ মুহূর্তে আত্মহত্যা কিংবা কোনো না কোনোভাবে অপমৃত্যুর শিকারে পরিণত হন। কারণ যে বা যারা অনবরত গুনাহে লিপ্ত থাকে। গুনাহের কাজ তাদের অন্তরে জেঁকে বসে। মৃত্যুর সময় হলে এসব গুনাহের স্মরণ হলেই সে নিজের উপর আস্থা বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। নিজেই নিজের জীবন শেষ করে দেওয়ার চিন্তায় মগ্ন থাকে। ফলে অপমৃত্যুর মতো ঘটনা ঘটে।
সুতরাং গুনাহুমুক্ত জীবনই মানুষকে শেষ জীবনে কিংবা অন্তিম মুহূর্তে আপমৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। তাওবা-ইসতেগফারের মাধ্যমে গুনাহমুক্ত জীবনই অপমৃত্যু থেকে বাঁচার অন্যতম উপায়।
৩. সঠিক পথে চলা
অনেক সময় সঠিক পথ থেকে বিচ্যুতির আক্ষেপের কারণে অপমৃত্যু ঘটে থাকে। শুরুতে সঠিক পথের ওপর থাকলেও পরবর্তীকালে কোনো না কোনো কারণে তার অবস্থার পরিবর্তন হয়। সঠিক ছেড়ে অন্যায় পথের দিকে ধাবিত হয়। যা তাকে হতাশার দিকে নিয়ে যায়। সঠিক পথ বিচ্যুতির এ হতাশার কারণেই শয়তানের প্ররোচনায় মানুষ অপমৃত্যুর পথ বেঁচে নেয়। তাই অপমৃত্যু থেকে বেঁচে থাকার অন্যতম উপায়ই হচ্ছে সঠিক পথে থাকা। শয়তানের পথ পরিহার করা।
৪. ঈমানের মজবুতি
মানুষ ঈমানের দুর্বলতার কারণেও অপমৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়। কেবল ঈমানের মজবুতিই মানুষকে অপমৃত্যুর হাত থেকে সুরক্ষা দিতে পারে। অন্তরে ঈমানি দুর্বলতা থাকলে তার মধ্যে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা কমে যায় আর দুনিয়ার আসক্তি বেড়ে যায়। দুনিয়া তার ওপর এমনভাবে জেঁকে বসে যে, তার অন্তরে আল্লাহকে ভালোবাসার কোনো স্থান অবশিষ্ট থাকে না। ফলে অন্তর ধীরে ধীরে গুনাহের দিকে ধাবিত হয়। একসময় নিভু নিভু ঈমানও গুনাহের ভারে অন্ধকারে ডুবে যায়। আর তখনই মানুষ দুনিয়ার মোহে এমনভাবে জড়িয়ে পড়ে যে, দুনিয়ার মোহ ছাড়ার আর কিছুই ভালো লাগে না। আর এ পরিণতিই মানুষকে অপমৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। তাই কেবল ঈমানের মজবুতিই অপমৃত্যুকে রোধ করতে পারে।
৫. সুস্থতার দোয়া করা
নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের শরীর মোবারককে সুস্থ রাখতে সকাল-সন্ধ্যায় এ দোয়া ৩ বার পড়তেন-
اَللَّهُمَّ عَافِنِىْ فِىْ بَدَنِى - اَللَّهُمَّ عَافِنِىْ فِىْ سَمْعِىْ - اَللَّهُمَّ عَافِنىِ فِىْ بَصَرِىْ – لَا اِلَهَ اِلَّا اَنْتَ
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা আফেনি ফি বাদানি, আল্লাহুম্মা আফেনি ফি সাময়ি, আল্লাহুম্মা আফেনি ফি বাসারি; লা ইলাহা ইল্লা আন্তা।’
অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আমার দেহ সুস্থ রাখুন। হে আল্লাহ! আমাকে সুস্থ রাখুন আমার শ্রবণ ইন্দ্রিয়ে। হে আল্লাহ! আমাকে সুস্থ রাখুন আমার দৃষ্টিশক্তিতে। আপনি ছাড়া কোনো ইলাহ নাই।’ (আবু দাউদ, মুসনাদে আহামদ)
৬. ঈমানি মৃত্যু পেতে দোয়াগুলো পড়া-
> رَبَّنَا أَفْرِغْ عَلَيْنَا صَبْرًا وَتَوَفَّنَا مُسْلِمِينَ
উচ্চারণ : ‘রাব্বানা আফরিগ আলাইনা সাবরাও ওয়া তাওয়াফ্ফানা মুসলিমিন।’
অর্থ : ‘হে আমাদের পরওয়ারদেগার! আমাদের জন্য ধৈর্য্যের দ্বার খুলে দিন এবং আমাদের মুসলমান হিসাবে মৃত্যু দান করুন।’ (সুরা আরাফ : আয়াত ১২৬)
> رَبَّنَا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَكَفِّرْ عَنَّا سَيِّئَاتِنَا وَتَوَفَّنَا مَعَ الْأَبْرَارِ
উচ্চারণ : ‘রাব্বানা ফাগ্ফিরলানা জুনুবানা ওয়া কাফ্ফির আন্না সাইয়্যিআতিনা ওয়া তাওয়াফ্ফানা মাআল আবরার।’
অর্থ : ‘হে আমাদের পালনকর্তা! তুমি আমাদের সব গুনাহ মাফ করে দাও। আমাদের সব দোষ-ত্রুটি দূর করে দাও। আর নেককার লোকদের সাথে আমাদের মৃত্যু দাও।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ১৯৩)
> أَنتَ وَلِيِّي فِي الدُّنُيَا وَالآخِرَةِ تَوَفَّنِي مُسْلِمًا وَأَلْحِقْنِي بِالصَّالِحِينَ
উচ্চারণ : ‘আংতা ওয়ালিয়্যি ফিদ দুনইয়া ওয়াল আখিরাতে তাওয়াফফানি মুসলিমাও ওয়া আলহিক্বনি বিসসালিহিন।’
অর্থ : ‘(হে আল্লাহ!) আপনিই দুনিয়া ও পরকালে আমার কার্যনির্বাহী। আমাকে ইসলামের উপর মৃত্যুদান করুন এবং আমাকে স্বজনদের সাথে মিলিত করুন।’ (সুরা ইউসুফ : আয়াত ১০১)
> নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভালো ও সুন্দর মৃত্যুর জন্য কখনো এ দোয়া করতেন-
اَللَّهُمَّ أَحْسِنْ عَاقِبَتَنَا فِيْ الْأُمُورِ كُلِّهَا، وَأجِرْنَا مِنْ خِزْيِ الدُّنْيَا وَعَذَابِ الآخِرَةِ
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা আহসিন আক্বিবাতানা ফিল উমুরি কুল্লিহা ওয়া আঝিরনা মিন খিযয়িদ দুনইয়া ওয়া আজাবিল আখিরাহ।’
অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আমাদের সব কাজের শেষ ফল সুন্দর করুন এবং আমাদেরকে দুনিয়ার লাঞ্ছনা ও কবরের আজাব থেকে মুক্ত রাখুন।’ (মুসনাদে আহমদ)
সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, দুনিয়াতে অপমৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে আকিদা-বিশ্বাস মজবুত করা, গুনাহের কাজ ছেড়ে দেওয়া, সঠিক পথে চলা এবং ঈমানকে সুদৃঢ় করা। অপমৃত্যু থেকে মুক্তি চাওয়া। মুমিন বান্দাকে যাতে জাহান্নামে যেতে না হয়, জাহান্নামের কঠিন আজাব থেকে মুক্তি পায়, হাশরের ময়দানে লাঞ্ছিত হতে না হয় এবং ঈমানি মৃত্যু নসিহ হয়; সে জন্য আল্লাহ তাআলা কোরআনুল কারিমেও তুলে ধরেছেন একটি দোয়া। তাহলো-
رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هَٰذَا بَاطِلًا سُبْحَانَكَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ - رَبَّنَا إِنَّكَ مَن تُدْخِلِ النَّارَ فَقَدْ أَخْزَيْتَهُ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنصَارٍ - رَّبَّنَا إِنَّنَا سَمِعْنَا مُنَادِيًا يُنَادِي لِلْإِيمَانِ أَنْ آمِنُوا بِرَبِّكُمْ فَآمَنَّا ۚ رَبَّنَا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَكَفِّرْ عَنَّا سَيِّئَاتِنَا وَتَوَفَّنَا مَعَ الْأَبْرَارِ
উচ্চারণ : রাব্বানা মা খালাক্বতা হাজা বাত্বিলান, সুব্হানাকা ফাক্বিনা আজাবান নার। রাব্বানা ইন্নাকা মান তুদখিলিন নারা ফাক্বাদ্ আখঝাইতাহু ওয়া মা লিজজালিমিনা মিন আংছার। রাব্বানা ইন্নানা সামিনা মুনাদিআই ইউনাদি লিল ঈমানি আন আমিনু বিরাব্বিকুম ফাআমান্না; রাব্বানা ফাগ্ফিরলানা জুনুবানা ওয়া কাফ্ফির আন্না সাইয়্যিআতিনা ওয়া তাওয়াফ্ফানা মাআল আবরার।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ১৯১-১৯৩)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে অপমৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন। উল্লেখিত আমল করার এবং দোয়াগুলো পড়ার তাওফিক দান করুন। গুনাহমুক্ত জীবন গঠনের তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/এএসএম