ইতিকাফের গুরুত্ব ও ফজিলত
মাওলানা মুহাম্মদ আনিসুর রহমান রিজভি
ইতিকাফ মাহে রমজানের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। মাহে রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করা সুন্নত। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই ইতিকাফ করতেন। সাহাবায়ে কেরামও ইতিকাফ করতেন। ইতিকাফের মাধ্যমে মুসলমানগণ আল্লাহর জিকির ও ইবাদতের মাধ্যমে শবে কদর তালাশ করে। সর্বোপরি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহর রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত কামনা করে বিশেষ দোয়া করে থাকে।
ইতিকাফ কি?
ইতিকাফ আরবি শব্দ। এর সাধারণ অর্থ—অবস্থান করা। শরিয়তের পরিভাষায় ইতিকাফ বলা হয়, পুরুষের জন্য নিয়তসহ এমন মসজিদে অবস্থান করা, যেখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। আর মহিলাদের ইতিকাফ হলো, নিয়তসহ ঘরের ভেতরে নামাজের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করা।
ইতিকাফের কয় ধরনের?
ইতিকাফ তিন ধরনের। যথা—
১. ওয়াজিব : ওয়াজিব ইতিকাফ হলো, মানতের ইতিকাফ; অর্থাৎ কেউ যদি মানত করে, ‘আমার কাজটি সুচারুরূপে সম্পন্ন হলে আমি আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ার্থে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে ইতিকাফ করব।’ কাজটি সুচারুরূপে সম্পন্ন হয়ে গেলে অবশ্যই ইতিকাফ করতে হবে। এই ইতিকাফের জন্য রোজা রাখা শর্ত। রোজা ছাড়া এই ইতিকাফ আদায় হবে না।
২. সুন্নতে মুয়াক্কাদা : সুন্নতে মুয়াক্কাদা ইতিকাফ হলো, মাহে রমজানের শেষ দশকের ইতিকাফ। এটি মহল্লাবাসীর পক্ষ থেকে কমপক্ষে একজন মানুষ হলেও আদায় করতে হবে। নতুবা সবাই গোনাহগার হবে।
৩. মুস্তাহাব : মুস্তাহাব ইতিকাফ হলো, কিছুক্ষণের জন্য ইতিকাফের নিয়ত করে মসজিদে অবস্থান করা। এটা অত্যন্ত বরকতময় ও সওয়াবের কাজ। স্বাভাবিকভাবে সবাই মসজিদে প্রবেশ করার সময় ইতিকাফের নিয়ত করলে ইতিকাফও আদায় হবে, সওয়াব পাওয়া যাবে।
রমজানের শেষ দশকের ইতিকাফ
মাহে রমজানের শেষ দশকে অর্থাৎ বিশ রমজান নিয়তসহ সূর্যাস্তের আগে মসজিদে প্রবেশ করে ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখার আগ পর্যন্ত মসজিদে অবস্থান করা বা ইতিকাফ করাই হলো সুন্নতে মুয়াক্কাদা আলাল কিফায়া। অর্থাৎ মহল্লাবাসীর পক্ষ থেকে একজন ব্যক্তি ইতিকাফ করলে সবার পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে। মহল্লাবাসীর কেউ যদি ইতিকাফ না করে, তাহলে সবাই গোনাহগার হবে।
ইতিকাফের ফজিলত
ইতিকাফ দ্বারা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নতের অনুসরণ হয়। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বদা মাহে রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। আয়েশা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, ‘নিশ্চয়ই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাহে রমজানের শেষ দশকে আজীবন ইতিকাফ করতেন।’ (তিরমিজি : ৭৯০)।
ইতিকাফকারীর জন্য হজ ও ওমরার সওয়াব
ইমাম বায়হাকি বর্ণনা করেন, হুসাইন ইবনে আলী (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি মাহে রমজানের শেষ দশদিন ইতিকাফ করবে, সে যেন দুটি হজ ও দুটি ওমরা করেছে।’ (কাশফুল গুম্মাহ : ১/২১২)।
ইতিকাফকারী আল্লাহর মেহমান
যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশে মাহে রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করে, তাদেরকে আল্লাহতায়ালা মেহমান হিসেবে গ্রহণ করেন। তখন তারা যা দোয়া করে, আল্লাহতায়ালা তা কবুল করেন। ইবনে আব্বাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘ইতিকাফকারী ইতিকাফের কারণে গোনাহ থেকে মুক্ত হয়ে যায় এবং সব নেকির সওয়াব অর্জন করে।’
(আল মুগনি : ৩/৪৫৫)।
ইতিকাফকারীর জন্য জান্নাতে মহল তৈরি
যারা আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টির উদ্দেশে নিজের আরাম-আয়েশ এবং আলিশান ঘরবাড়ি ত্যাগ করে অল্প সময়ের জন্য মসজিদে ইতিকাফ করবে, আল্লাহতায়ালা বেহেশতে তাদের জন্য মনোরম মহল তৈরি করবেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি মাগরিব ও এশার মধ্যবর্তী সময়ে জামাত প্রতিষ্ঠিত হয় এমন মসজিদে ইতিকাফে থাকবে, নামাজ এবং কোরআন তেলাওয়াত ছাড়া কোনো কথা বলবে না, তার জন্য বেহেশতে মহল তৈরি করা আল্লাহর দায়িত্ব হয়ে যাবে।’ (কাশফুল গুম্মাহ : ১/২১২)।
ইতিকাফের শর্তাবলি
১. নিয়ত করা। নিয়ত ছাড়া সারাজীবন মসজিদে অবস্থান করলেও ইতিকাফ হবে না।
২. এমন মসজিদে ইতিকাফ করা, যেখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের নিয়মিত জামাত হয়। জাওয়াহিরুল ফিকহ গ্রন্থে বলা হয়েছে, নির্দিষ্ট ইমাম ও মুয়াজ্জিন যারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করে, এমন মসজিদ ছাড়া ইতিকাফ শুদ্ধ হবে না।
ইতিকাফ শুদ্ধ হওয়ার জন্য শর্ত
১. মুসলমান হওয়া।
২. অপবিত্রতা ও হায়েজ-নেফাস থেকে পবিত্র হওয়া।
মনে রাখতে হবে
১. ইতিকাফের জন্য প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া শর্ত নয়। তাই ছোটরাও ইতিকাফ করতে পারবে।
২. মহিলাদের ক্ষেত্রে ইতিকাফের জন্য স্বামীর অনুমতি নিতে হবে। স্বামীর অনুমতি ছাড়া ইতিকাফ শুদ্ধ হবে না।
ইতিকাফের জন্য সর্বোত্তম স্থান
১. ইতিকাফের জন্য সর্বোত্তম স্থান হলো, মসজিদে হারাম।
২. এরপর মসজিদে নববি।
৩. এরপর বায়তুল মুকাদ্দাস।
৪. তারপর জামে মসজিদ।
৫. এরপর যে মসজিদে মুসল্লি সংখ্যা বেশি হয়।
৬. মহিলারা নিজ গৃহের এক কোণায় নামাজের স্থানে ইতিকাফ করবেন।
ইতিকাফ ভঙ্গের কারণ
পুরুষরা বিনা ওজরে মসজিদ থেকে বেরুতে পারবেন না। বেরুলে ইতিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে। তবে প্রস্রাব, পায়খানা এবং জামে মসজিদে জুমার উদ্দেশে বের হওয়া যাবে। অনুরূপভাবে মসজিদ ভেঙ্গে যাওয়ার কারণে অথবা কেউ জোরপূর্বক মসজিদ থেকে বের করে দিলে সঙ্গে সঙ্গে অন্য মসজিদে প্রবেশ করলে ইতিকাফ ভঙ্গ হবে না। সহবাসের দিকে আকর্ষণ করে, এমন কাজ দিনের বেলায় হোক কিংবা রাতের বেলায়, ইতিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে। তবে স্বপ্নদোষের দ্বারা ইতিকাফ ভঙ্গ হবে না।
ইতিকাফ অবস্থায় করণীয়
১. পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতে পড়া।
২. কোরআনুল কারিম তেলাওয়াত করা।
৩. দুরুদ শরিফ পাঠ করা।
৪. জিকির-আজকার করা।
৫. দীনি কিতাবাদি পড়া।
৬. দীনি কিতাবাদি রচনা করা।
৭. ফিকহ-ফতোয়া নিয়ে গবেষণা করা।
৮. কোরআন ও হাদিসের দরস প্রদান করা।
৯. দীনি ইলম অর্জন করা।
১০. দীনি ইলম অর্জনে সময় ব্যয় করা।
ইতিকাফ অবস্থায় নিষিদ্ধ
১. ওজর ছাড়া পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ছেড়ে দেওয়া।
২. অনর্থক কথাবার্তা বলা।
৩. দুনিয়াবি কথা বলা।
৪. ব্যবসা-বাণিজ্য করা।
৫. প্রয়োজন ছাড়া মসজিদ থেকে বের হয়ে যাওয়া।
৬. পারিবারিক কাজ-কর্ম করা।
৭. অহেতুক সময় নষ্ট করা।
৮. ইবাদত-বন্দেগি না করে চুপচাপ বসে থাকা।
৯. মোবাইলে কারও সঙ্গে দুনিয়াবি কথা বলা।
১০. ইবাদত-বন্দেগি না করে ঘুমিয়ে থাকা।
লেখক : সহকারী মাওলানা, চরণদ্বীপ রজভীয়া ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদরাসা, বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম ও এমফিল গবেষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
মুনশি/এসইউ/জিকেএস