ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ধর্ম

রমজানে জাকাত আদায়ের গুরুত্ব

ইসলাম ডেস্ক | প্রকাশিত: ১০:১১ এএম, ১৭ এপ্রিল ২০২২

যে পাঁচটি স্তম্ভের ওপর ইসলামের সুরম্য প্রাসাদ নির্মিত, তার অন্যতম জাকাত। ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভসমূহের সমান্তরালে এর অবস্থান। মহাগ্রন্থ আল কোরআনের ৩২ স্থানে জাকাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কোরআন শরিফের বহু আয়াতে নামাজের সঙ্গে সঙ্গে জাকাতের আলোচনা করা হয়েছে। তাই প্রতিটি মুসলিমকে জাকাত ফরজ হবার বিশ্বাস অন্তরে পোষণ করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে সামর্থ্যবান প্রতিটি ব্যক্তির জাকাত আদায়ে সচেষ্ট হতে হবে। রমজানে যে কোনো আমল করলে তার সওয়াব ৭০ গুণ বেড়ে যায়। তাই রমজান মাসে জাকাত আদায়ে আমরা বেশি তৎপর হয়ে উঠি। জাকাতের আদ্যোপান্ত নিয়ে লিখেছেন আবদুল কাইয়ুম শেখ

জাকাত কি?
জাকাত একটি আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হলো, পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতা, শুদ্ধতা, বর্ধনশীলতা ও প্রাচুর্যময়তা। আর ইসলাম ধর্মের বিধান অনুযায়ী প্রতি বছর সঞ্চিত সম্পদের মোট মূল্যের আড়াই শতাংশ হারে নির্ধারিত দরিদ্র ব্যক্তিকে আল্লাহতায়ালা কর্তৃক আরোপিত অবশ্য প্রদেয় অর্থকে শরিয়তের পরিভাষায় জাকাত বলা হয়। বাংলা উইকিপিডিয়ার ভাষ্যমতে ‘প্রত্যেক স্বাধীন, পূর্ণবয়স্ক, মুসলমান নর-নারীকে প্রতিবছর স্বীয় আয় ও সম্পত্তির একটি নির্ধারিত অংশ, যদি তা ইসলামি শরিয়ত নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করে, তবে গরিব-দুঃস্থদের মধ্যে বিতরণের নিয়মকে জাকাত বলা হয়।’ জাকাত দানের মাধ্যমে যেহেতু চারিত্রিক শুদ্ধতা ও নিষ্কলুষতা অর্জিত হয় এবং সম্পদের সুষম বণ্টন ও প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা যায়, তাই একে জাকাত বলে অভিহিত করা হয়।

জাকাত আবশ্যক হবার প্রমাণ
মহাগ্রন্থ আল কোরআনের বহু ভাষ্যের আলোকে নেসাবধারী প্রতিটি মুসলিম ব্যক্তির ওপর জাকাত প্রদান করা ফরজ হবার বিষয়টি অকাট্যভাবে প্রমাণিত। জাকাত প্রদান করার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা নামাজ আদায় করো ও জাকাত প্রদান করো এবং রুকুকারীদের সঙ্গে রুকু করো।’ (সুরা বাকারা : ৪৩)। অন্য এক আয়াতে জাকাত প্রদানকে সঠিক ধর্ম বলে আখ্যায়িত করে বলা হয়েছে, ‘তাদেরকে এ ছাড়া আর কোনো নির্দেশ প্রদান করা হয়নি যে, তারা খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে, নামাজ কায়েম করবে এবং জাকাত প্রদান করবে। এটাই সঠিক ধর্ম।’ (সুরা বায়্যিনাহ : ৫)।

অনুরূপভাবে বহু হাদিসের আলোকেও সামর্থ্যবান প্রতিটি মুসলিম ব্যক্তির ওপর জাকাত প্রদান করা ফরজ হবার বিষয়টি প্রমাণিত। সহিহ বোখারি শরিফে এসেছে, ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুআজ (রা.)-কে ইয়ামেন দেশে শাসক হিসেবে প্রেরণ করেন। প্রেরণকালে তিনি বলেন, সেখানকার অধিবাসীদের (প্রথমে) এ সাক্ষ্য দানের প্রতি আহ্বান করবে যে, আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোনো উপাস্য নেই এবং আমি আল্লাহর রাসুল। যদি তারা তা মেনে নেয়, তাহলে তাদের অবহিত করবে যে, আল্লাহতায়ালা তাদের ওপর দিনে ও রাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেছেন। যদি সেটাও তারা মেনে নেয়, তাহলে তাদেরকে জানাবে, আল্লাহতায়ালা তাদের ওপর তাদের সম্পদের মধ্য থেকে জাকাত ফরজ করেছেন। এটা ধনীদের থেকে গ্রহণ করা হবে এবং দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করা হবে। (সহিহ বোখারি : ১৩৯৫)।

অন্য এক হাদিসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জাকাত আদায়কে ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের অন্যতম বলে অভিহিত করে বলেন, ‘ইসলামের ভিত্তি রাখা হয়েছে পাঁচটি জিনিসের ওপর। এ কথার সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহতায়ালা ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রাসুল। নামাজ কায়েম করা, জাকাত প্রদান করা, হজ করা ও রমজান মাসের রোজা রাখা।’ (সহিহ বোখারি : ৮)।

জাকাত আদায় করার ফজিলত
জাকাত আদায় করা ও সাধারণ দান-অনুদান প্রদান করার রয়েছে বহুবিধ ফজিলত ও মর্যাদা। যে ব্যক্তি ইসলাম কর্তৃক নির্ধারিত জাকাত সঠিক পন্থায় ও যথাযথ নিয়মে আদায় করবে, সে তা আল্লাহর কাছে আরও বর্ধিতরূপে পাবে। এ মর্মে মহাগ্রন্থ আল কোরআনে এসেছে, ‘তোমরা নামাজ কায়েম করো, জাকাত প্রদান করো এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ দাও। তোমরা নিজেদের জন্য যা কিছু অগ্রে পাঠাবে, তা আল্লাহর কাছে উত্তম আকারে ও পুরস্কার হিসেবে বর্ধিতরূপে পাবে।’ (সুরা মুজ্জাম্মিল : ২০)।

আল কোরআনের স্পষ্ট ভাষ্যমতে আল্লাহ দান-অনুদানকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেন। ইহকালেও এর সুফল ভোগ করা যায় এবং পরকালেও পুণ্য অর্জিত হয়। পরকালে জাকাতের প্রতিদান প্রদান করা হবে মর্মে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা নামাজ প্রতিষ্ঠা করো এবং জাকাত দাও। তোমরা নিজের জন্য পূর্বে যে সৎকর্ম প্রেরণ করবে, তা আল্লাহর কাছে পাবে। তোমরা যা কিছু করো, নিশ্চয়ই আল্লাহ তা প্রত্যক্ষ করেন।' (সুরা বাকারা : ১১০)। অন্য এক আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে, সৎকাজ করেছে, নামাজ প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং জাকাত দান করেছে, তাদের জন্য তাদের পুরস্কার তাদের পালনকর্তার কাছে রয়েছে। তাদের কোনো শঙ্কা নেই এবং তারা দুঃখিত হবে না।’ (সুরা বাকারা : ২৭৭)।

অনুরূপভাবে হাদিস শরিফেও জাকাত আদায় করার বহু ফজিলত বর্ণিত হযেছে। যদি কোনো ব্যক্তি নিজের ওপর অবধারিত জাকাত আদায় করে এবং সাধারণ দান-অনুদান প্রদান করে, তাহলে আল্লাহতায়ালা তার ধনৈশ্বর্য আরও বাড়িয়ে দেন। তাকে অকাতরে দান করতে থাকেন। একটি হাদিসে এসেছে, আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা আমাকে বলেছেন, খরচ করো, তোমার ওপরও খরচ করা হবে।' রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন, ‘আল্লাহতায়ালার হাত প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ। রাতদিন ব্যয় করা সত্ত্বেও তা মোটেই কমছে না। একটু ভেবে দেখ! আসমান-জমিন সৃষ্টি থেকে যে বিপুল পরিমাণ ব্যয় করেছেন, এতে তার হাত একটুও খালি হয়নি।' (সহিহ মুসলিম : ২১৯৯)। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা বলেন, হে আদম সন্তান! তোমরা অকাতরে দান করতে থাক। আমিও তোমাদের ওপর ব্যয় করব।'

জাকাত ব্যয়ের খাত
ইসলাম কর্তৃক জাকাত ব্যয়ের খাত নির্ধারিত রয়েছে। তাই নির্ধারিত খাতেই জাকাত আদায় করতে হবে। নির্দিষ্ট খাতের বাইরে জাকাত ব্যয় করলে তা আদায় হবে না। মহাগ্রন্থ আল কোরআনে জাকাত ব্যয়ের খাত নির্ধারণ করে বলা হয়েছে, ‘জাকাত হলো কেবল ফকির, মিসকিন, জাকাত আদায়কারী ও যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন, তাদের হক এবং তা দাস-মুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জিহাদকারীদের জন্য এবং মুসাফিরদের জন্য। এ হলো আল্লাহর নির্ধারিত বিধান।' (সুরা তওবা : ৬০)। অতএব, কোরআন শরিফে বর্ণিত উক্ত নির্ধারিত খাতেই জাকাত আদায় করতে হবে। রাস্তাঘাট, পুল নির্মাণ, ইসলামি টিভি বা দল পরিচালনার জন্য কিংবা নির্দিষ্ট খাতের বাইরে অন্য কোনো কল্যাণমূলক কাজে জাকাত ব্যয় করা হলে তা শরিয়তের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য হবে না।

যাদের ওপর জাকাত দেওয়া ফরজ
সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ (৭.৫০) বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা (৫২.৫০) হলো জাকাতের নেসাব। যদি কোনো ব্যক্তি সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা কিংবা এর সমমূল্যের মালিক হয়, এই সম্পত্তি তার মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত হয়, তার ওপর পূর্ণ এক বছর অতিবাহিত হয়, সে ঋণমুক্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে সুস্থমস্তিষ্ক, মুসলমান, প্রাপ্তবয়স্ক ও স্বাধীন হয়, তাহলে তার ওপর জাকাত প্রদান করা ফরজ। (আদ্দুররুল মুখতার : ২/২৫৯)। এর দ্বারা বোঝা গেল, অমুসলিম, পাগল, অপ্রাপ্তবয়স্ক বালক/বালিকা ও পরাধীন দাস-দাসীদের ওপর জাকাত দেওয়া ফরজ নয়।

জাকাত না দেওয়ার পরিণাম
যারা আল্লাহর পথে খরচ না করে সম্পদ ও স্বর্ণ-রূপা পুঞ্জীভূত করে রাখে, তাদের প্রতি কঠোর হুঁশিয়ার বাণী উচ্চারণ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা স্বর্ণ ও রূপা জমা করে রাখে এবং আল্লাহর পথে তা ব্যয় করে না, তাদের কঠোর আজাবের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন, সেদিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তার দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্ব ও পৃষ্ঠদেশকে দগ্ধ করা হবে। (সেদিন বলা হবে) এগুলো যা তোমরা নিজেদের জন্য জমা রেখেছিলে, সুতরাং এখন আস্বাদ গ্রহণ করো সঞ্চয় করে রাখার।’ (সুরা তওবা : ৩৪-৩৫)।

হাদিস শরিফেও জাকাত না দেবার দরুণ ভয়াবহ শাস্তির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সহিহ বোখারি শরিফে এসেছে, আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যাকে আল্লাহতায়ালা সম্পদ দান করেছেন, কিন্তু সে এর জাকাত আদায় করেনি, কেয়ামতের দিন তার সম্পদকে টেকো মাথা বিশিষ্ট বিষধর সাপের আকৃতি দান করে তার গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হবে। সাপটি তার মুখের দু'পার্শ্ব কামড়ে ধরে বলবে, আমি তোমার সম্পদ, আমি তোমার সঞ্চিত মাল।' এরপর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তেলাওয়াত করেছেন, ‘আল্লাহ যাদের সম্পদশালী করেছেন, অথচ তারা সে সম্পদ নিয়ে কার্পণ্য করছে, তাদের ধারণা করা উচিত নয় যে, সেই সম্পদ তাদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে; বরং তাদের জন্য তা অকল্যাণকর হবে। অচিরেই কেয়ামত দিবসে যা নিয়ে কার্পণ্য করেছে, তা দিয়ে তাদের গলদেশ শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হবে।' (সহিহ বোখারি : ১৪০৩)।

শেষ কথা
জাকাত আদায়ের মাধ্যমে পরকালীন জবাবদিহিতা থেকে মুক্ত থাকা যায়। এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত হয়। তা ছাড়া জাকাত আদায়ের মাধ্যমে হৃদয়ের সংকোচন ও কৃপণতা থেকে মুক্ত থাকা যায়। সঙ্গে সঙ্গে ধনী ও দরিদ্রদের মধ্যে হৃদ্যতা ও সম্প্রীতির বন্ধন গড়ে তোলা সম্ভব হয়। সম্পদের একচেটিয়া সুবিধাভোগ ধনৈশ্বর্যকে বিশেষ বলয় ও সবিশেষ শ্রেণির মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলে। বিত্তশালীকে আরও বিত্তশালী করে। দরিদ্রকে করে আরও হতদরিদ্র। এই দুঃখজনক অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার অনন্য উপায় হলো জাকাত। তাই নেসাবের অধিকারী সামর্থ্যবান প্রতিটি মুসলিমকে জাকাত আদায়ে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ও যত্নশীল হতে হবে।

লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ, পোস্তা, চকবাজার, ঢাকা

মুনশি/এসইউ/এমএস

আরও পড়ুন