কল্যাণের দোয়ায় শেষ হবে রহমতের দশক
রহমতের দশকের শেষ দিন আজ। হাফেজে কোরআনগণ এ দশকের শেষ তারাবিতে রহমত ও বরকতের দোয়া পড়বেন। সে সঙ্গে ১৩তম পারার তেলাওয়াত শেষ হবে। রোজাদার মুমিন মুসলমানের জন্য সান্ত্বনা ও কল্যাণের অনেক দোয়া ও নসিহত রয়েছে আজকের তারাবিহতে। রয়েছে বাবা-মার জন্য রয়েছে বিশেষ ক্ষমা প্রার্থনা।
১০ রমজানের তারাবিতে হাফেজে কোরআনগণ সুরা ইউসুফের ৫৩নং আয়াত থেকে শেষ পর্যন্ত, সুরা রাদ এবং সুরা ইবরাহিম-এর তেলাওয়াত শেষ করবেন। তারাবি নামাজ আদায়কারীরা শুনাবেন হজরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের জীবনের সুন্দর ঘটনা।
সুরা ইবরাহিমে রয়েছে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দোয়া। বাদ যায়নি বাবা-মা ও নিজেদের কল্যাণ কামনার দোয়া। বাবা-মা ও নিজেদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা দোয়া। দোয়াগুলো তুলে ধরা হলো-
১. رَبَّنَا اغْفِرْ لِي وَلِوَالِدَيَّ وَلِلْمُؤْمِنِينَ يَوْمَ يَقُومُ الْحِسَابُ
উচ্চারণ : 'রাব্বানাগফিরলি ওয়ালিওয়ালিদাইয়্যা ওয়া লিলমুমিনিনা ইয়াওমা ইয়াকুমুল হিসাব।'
'হে আমাদের পালনকর্তা! আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে এবং সব মুমিনকে ক্ষমা করুন, যেদিন হিসাব কায়েম হবে।' (সুরা ইবরাহিম : আয়াত ৪১)
২. رَّبَّنَا إِنِّي أَسْكَنتُ مِن ذُرِّيَّتِي بِوَادٍ غَيْرِ ذِي زَرْعٍ عِندَ بَيْتِكَ الْمُحَرَّمِ رَبَّنَا لِيُقِيمُواْ الصَّلاَةَ فَاجْعَلْ أَفْئِدَةً مِّنَ النَّاسِ تَهْوِي إِلَيْهِمْ وَارْزُقْهُم مِّنَ الثَّمَرَاتِ لَعَلَّهُمْ يَشْكُرُونَ
উচ্চারণ : 'রাবানা ইন্নি আসকাংতু মিন জুররিয়াতি বিওয়াদিন জাইরি জি যারয়িন ইংদা বাইতিকাল মুহাররাম। রাব্বানা লিইউকিমুস সালাতা ফাঝআল আফয়িদাতাম মিনান্নাসি তাহওয়ি ইলাইহিম ওয়ারযুকহুম মিনাছ-ছামারাতি লাআল্লাহুম ইয়াশকুরুন।'
'হে আমাদের পালনকর্তা! আমি নিজের এক সন্তানকে তোমার পবিত্র গৃহের সন্নিকটে চাষাবাদহীন উপত্যকায় আবাদ করেছি; হে আমাদের পালনকর্তা! যাতে তারা নামাজ প্রতিষ্ঠা করে। অতপর আপনি কিছু লোকের অন্তরকে তাদের প্রতি আকৃষ্ট করুন এবং তাদেরকে ফলাদি দ্বারা রুজি দান করুন, সম্ভবতঃ তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে।' (সুরা ইবরাহিম : আয়াত ৩৭)
৩. رَبَّنَا إِنَّكَ تَعْلَمُ مَا نُخْفِي وَمَا نُعْلِنُ وَمَا يَخْفَى عَلَى اللّهِ مِن شَيْءٍ فَي الأَرْضِ وَلاَ فِي السَّمَاء
উচ্চারণ : 'রাব্বানা ইন্নাকা তালামু মা নাখফি ওয়া মা নালিনু ওয়া মা ইয়াখফা আলাল্লাহি মিং শাইয়িন ফিল আরদি ওয়া লা ফিস সামায়ি।'
'হে আমাদের পালনকর্তা! আপনি তো জানেন আমরা যা কিছু গোপনে করি এবং যা কিছু প্রকাশ্য করি। আল্লাহর কাছে পৃথিবীতে ও আকাশে কোন কিছুই গোপন নয়।' (সুরা ইবরাহিম : আয়াত ৩৮)
৪. رَبِّ اجْعَلْنِي مُقِيمَ الصَّلاَةِ وَمِن ذُرِّيَّتِي رَبَّنَا وَتَقَبَّلْ دُعَاء
উচ্চারণ : 'রাব্বিঝআলনি মুকিমাস সালাতি ওয়া মিং জুররিয়াতি রাব্বানা ওয়া তাকাব্বাল দুআ।'
'হে আমার পালনকর্তা! আমাকে নামাজ কায়েমকারী করুন এবং আমার সন্তানদের মধ্যে থেকেও। হে আমাদের পালনকর্তা! কবুল করুন আমাদের দোয়া।' (সুরা ইবরাহিম : আয়াত ৪০)
৫. رَبَّنَا أَخِّرْنَا إِلَى أَجَلٍ قَرِيبٍ نُّجِبْ دَعْوَتَكَ وَنَتَّبِعِ الرُّسُلَ
উচ্চারণ : 'রাব্বানা আখারিনা ইলা আঝাল্লিন কারিবিন নুঝিব দাওয়াতাকা ওয়া নাত্তাবিয়ির রুসুল।'
'হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদেরকে সামান্য মেয়াদ পর্যন্ত সময় দিন, যাতে আমরা আপনার আহবানে সাড়া দিতে এবং পয়গম্বরগণের অনুসরণ করতে পারি।' (সুরা ইবরাহিম : আয়াত ৪৪)
এ সুরাগুলোতে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সান্ত্বনা দেয়া হয়েছে। নবুয়তের দায়িত্ব পালনকালে প্রিয়নবি মক্কার শেষ সময়গুলোতে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা ও কষ্টের মাঝে অতিবাহিত করছিলেন। সেই কঠিন পরিস্থিতিতে আল্লাহ তাআলা এ সুরাগুলোর মাধ্যমে প্রিয়নবিকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন। সুরাগুলোর বক্তব্য সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো-
সুরা ইউসুফ
সুরা ইউসুফ মক্কায় নাজিল হয়েছে। এ সুরাটির আয়াত সংখ্যা ১১১ এবং রুকু সংখ্যা ১২। এ সুরার বিষয়বস্তু থেকে বোঝা যায় যে, সুরাটি প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মক্কায় অবস্থানের শেষ যুগে নাজিল হয়েছিল।
তখন মক্কার ইসলাম বিদ্বেষীরা প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হত্যা বা দেশান্তর বা বন্দি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিল। আজ এ সুরার ৫৩নং আয়াত থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠ করা হবে।
সুরা ইউসুফের শেষাংশে পুরুষদের থেকে নবি পাঠানো এবং কুরআনের নসিহত বা ঘটনোগুলো শিক্ষামূলক এবং বুদ্ধিমানের জন্য উপযোগী বলে ঘোষণা দেন। আল্লাহ বলেন-
وَ مَاۤ اَرۡسَلۡنَا مِنۡ قَبۡلِکَ اِلَّا رِجَالًا نُّوۡحِیۡۤ اِلَیۡهِمۡ مِّنۡ اَهۡلِ الۡقُرٰی ؕ اَفَلَمۡ یَسِیۡرُوۡا فِی الۡاَرۡضِ فَیَنۡظُرُوۡا کَیۡفَ کَانَ عَاقِبَۃُ الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِهِمۡ ؕ وَ لَدَارُ الۡاٰخِرَۃِ خَیۡرٌ لِّلَّذِیۡنَ اتَّقَوۡا ؕ اَفَلَا تَعۡقِلُوۡنَ
'আপনার আগে আমি যতজনকে রাসুল করে পাঠিয়েছি, তারা সবাই পুরুষই ছিল জনপদবাসীদের মধ্য থেকে। আমি তাঁদের কাছে ওহি পাঠাতাম। তারা কি দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করে না, যাতে দেখে নিত কিরূপ পরিণতি হয়েছে তাদের যারা আগে ছিল? সংযমকারীদের জন্যে পরকালের আবাসই উত্তম। তারা কি এখনও বোঝে না?' (সুরা ইউসুফ : আয়াত ১০৯)
حَتّٰۤی اِذَا اسۡتَیۡـَٔسَ الرُّسُلُ وَ ظَنُّوۡۤا اَنَّهُمۡ قَدۡ کُذِبُوۡا جَآءَهُمۡ نَصۡرُنَا ۙ فَنُجِّیَ مَنۡ نَّشَآءُ ؕ وَلَا یُرَدُّ بَاۡسُنَا عَنِ الۡقَوۡمِ الۡمُجۡرِمِیۡنَ
'এমনকি যখন পয়গম্বরগণ নৈরাশ্যে পতিত হয়ে যেতেন, এমনকি এরূপ ধারণা করতে শুরু করতেন যে, তাদের অনুমান বুঝি মিথ্যায় পরিণত হওয়ার উপক্রম হয়েছিল, তখন তাদের কাছে আমার সাহায্য পৌছে। অতঃপর আমি যাদের চেয়েছি তারা উদ্ধার পেয়েছে। আমার শাস্তি অপরাধী সম্প্রদায় থেকে প্রতিহত হয় না।' (সুরা ইউসুফ : ১১০)
বিশ্বনবির মক্কায় অবস্থানকালীন কষ্টকর সময়ের শেষ দিকে এ সুরাটি নাজিল হয়। কারণ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সংগ্রামী জীবনের অনেক ঘটনাই হজরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের সংগ্রামী ঘটনার সঙ্গে মিলে যায়। আল্লাহ যেভাবে হজরত ইউসুফ আলাইহিস সালামকে সত্য স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। যা তিনি তার বাবার কাছে বর্ণনা করেছিলেন। ঠিক তেমনি আল্লাহ তাআলা বিশ্বনবিকেও নবুয়তের আগে এ রকম সত্য স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন।
হজরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম যেভাবে আপন ভাইদের কাছে কষ্ট ও নির্যাতন পেয়েছেন ঠিক বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও আপনজনদের কাছে অনেক নির্যাতন ভোগ করেছেন।
হজরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম নির্যাতনকারী ভাইদের প্রতি যেমন প্রতিশোধ নেননি। বিশ্বনবিও নিজ আপনজনদের থেকে ইসলামের বিজয়ের পর আগের নির্যাতনের কোনো প্রতিশোধই গ্রহণ করেননি।
বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হিজরতের আগে অত্যাচার নির্যাতনের চরম সময়ে মক্কার শেষ দিনগুলোতে সুরা ইউসুফ থেকেই গ্রহণ করেছিলেন পরম সান্ত্বনা। যেখানে বর্ণিত হয়েছে আপন ভাইদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হজরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের সে ঐতিহাসিক বর্ণনা।
পরবর্তী সময়ে হজরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম বাদশাহ হওয়ার পরও তিনি তার ভাইদের প্রতি ইহসান করেছেন। কোনো প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি।
বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়অ সাল্লামও মদিনায় হিজরত করলেন আবার মক্কা বিজয় করলেন। তাঁর প্রতি কোনো অত্যাচার নির্যাতনের প্রতিশোধ তিনি গ্রহণ করেননি। যা তিনি ওহি হিসেবে সুরা ইউসুফে পেয়েছিলেন। মুসলিম উম্মাহর শিক্ষা গ্রহণের জন্য অনন্য হোক সুরা ইউসুফ।
সুরা রাদ
কয়েকটি আয়াত ছাড়া বাকি পুরো সুরাটি মক্কায় নাজিল হয়েছে। ৪৩ আয়াতের সুরাটিতে দ্বীন ইসলামের মৌলিক আকিদ্বা বিশ্বাস সংক্রান্ত আলোচনা রয়েছে। সুরা রাদ-এ তাওহিদ, রেসালাত, ওহি, শেষ দিবসের কর্মফল, হক ও বাতিলের তাৎপর্য ও পার্থক্য সম্পর্কে রয়েছে বিশেষ আলোচনা। তাই সুরার প্রথমেই এসেছে হকের আলোচনা।
সুরা ইবরাহিম
মক্কায় অবর্তীণ ৫২ আয়াত বিশিষ্ট সুরা হলো 'সুরা ইবরাহিম'। এ সুরাটি কুরআনুল কারিমের ১৪তম সুরা। মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের ঘটনা বর্ণনার পাশাপাশি সুরাটিতে প্রিয়নবির রেসালাত, নবুয়ত এবং কিছু বৈশিষ্ট্য আলোচিত হয়েছে। সুরাটির আলোচনা মানুষকে গোমরাহীর অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসে।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কুরআনের বিষয়বস্তুগুলো অধ্যয়ন করার পাশাপাশি সুরা ইবরাহিমের দোয়াগুলোর মাধ্যমে তার কাছে দোয়া করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/এএসএম