সত্য কথা বলার গুরুত্ব ও ফজিলত
দুনিয়ার সব কাজ, বিচার-ফয়সালা সত্য কথা বা সত্যবাদিতার ওপর নির্ভরশীল। আসামি কিংবা বিচারপ্রার্থী উভয়ই বিচারকের সামনে এ মর্মে হলফ করেন যে, ‘যা বলিব সত্য বলিব; সত্য বৈ মিথ্যা বলিব না’। এ সত্যবাদিতায় রয়েছে জীবনের পরম সুখ-শান্তি; সত্যবাদিতার মর্যাদা ও উপকারিতাও রয়েছে অনেকটা। কোরআন-সুন্নায় সত্যবাদিতার এসব গুরুত্ব ও ফজিলত বর্ণনায় বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। তাহলো-
সত্যবাদিতায় কোরআনের নির্দেশ
সত্যবাদীরাই আল্লাহকে ভয় করে। আল্লাহকে ভয় করা, সঠিক পথে চলা সত্যবাদীদের অন্যতম গুণ। এ কারণেই আল্লাহ তাআলা কোরআনুল কারিমে ঈমানদারদের লক্ষ্য করে আল্লাহকে ভয় করার কথা বলেছেন আবার সত্যবাদীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার কথা বলেছেন। কোরআনের একাধিক আয়াতে সত্যবাদিতার উপকারিতা ও মর্যাদার কথা তুলে ধরেছেন এভাবে-
১. يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱتَّقُواْ ٱللَّهَ وَكُونُواْ مَعَ ٱلصَّٰدِقِينَ
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সঙ্গী হও।’ (সুরা তওবা : আয়াত ১১৯)
২. وَٱلصَّٰدِقِينَ وَٱلصَّٰدِقَٰتِ
‘সত্যবাদী পুরুষ ও সত্যবাদিনী নারী’; এদের জন্য মহান আল্লাহ ক্ষমা ও মহাপ্রতিদান রেখেছেন।’(সুরা আহযাব : ৩৫)
৩. فَلَوۡ صَدَقُواْ ٱللَّهَ لَكَانَ خَيۡرٗا لَّهُمۡ
‘সুতরাং যদি তারা আল্লাহর সঙ্গে সত্য বলতো, তাহলে তাদের জন্য এটা মঙ্গলজনক হতো।’ (সুরা মুহাম্মাদ : আয়াত ২১)
হাদিসে সত্যবাদিতার মর্যাদা ও উপকারিতা
হাদিসে পাকে প্রিয়নবি মানুষকে সত্য কথা বলার নির্দেশ দিয়েছেন। সত্যবাদিতার অনেক গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। মানুষকে সত্যবাদী হতে অনেক মর্যাদা ও উপকারিতার কথা তুলে ধরেছেন। হাদিসের বর্ণনায় সত্যবাদিতার যেসব উপকারিতা উঠে এসেছে; তাহলো-
১. সত্যবাদিতা জান্নাতের দিকে নিয়ে যায়
হজরত ইবনু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই সত্য (মানুষকে) পুণ্যের পথ দেখায় আর পুণ্য জান্নাতের দিকে নিয়ে যায়। একজন মানুষ (অবিরত) সত্য বলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত আল্লাহর কাছে তাকে খুব সত্যবাদী বলে লেখা হয়। পক্ষান্তরে মিথ্যা পাপের পথ দেখায় এবং পাপ জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। একজন মানুষ (সর্বদা) মিথ্যা বলতে থাকে, শেষ অবধি আল্লাহর কাছে তাকে মহা মিথ্যাবাদী বলে লেখা হয়।‘ (বুখারি, মুসলিম, তিরমিজি, আবু দাউদ, ইবনু মাজাহ, মুসনাদে আহমাদ, মুওয়াত্তা মালিক, দারেমি)
২. সত্যবাদিতা প্রশান্তির কারণ
হজরত আবু মুহাম্মাদ হাসান ইবনু আলি ইবনু আবি ত্বালেব রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এই শব্দগুলো স্মরণ রেখেছি যে, ‘তুমি ঐ জিনিস পরিত্যাগ কর, যে জিনিস তোমাকে সন্দেহে ফেলে এবং তা গ্রহণ কর যাতে তোমার সন্দেহ নেই। কেননা, সত্য প্রশান্তির কারণ এবং মিথ্যা সন্দেহের কারণ।’ (তিরমিজি, নাসাঈ, মুসনাদে আহমাদ, দারেমি)
৩. সত্যবাদিতা নবুয়তি গুণ
হজরত আবু সুফিয়ান সাখর ইবনু হারব রাদিয়াল্লাহু আনহু একটি দীর্ঘ হাদিস বর্ণনা করেন যাতে (রোমের বাদশাহ) হিরাক্লিয়াসের ঘটনা উঠে এসেছে। হিরাক্লিয়াস আবূ সুফিয়ানকে জিজ্ঞাসা করলেন (তখনও তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেননি) ‘তিনি... অর্থাৎ নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম...তোমাদেরকে কোন কাজের আদেশ করছেন?’
আবু সুফিয়ান বললো, ‘তিনি বলছেন যে, ‘তোমরা শুধু এক আল্লাহর উপাসনা কর, তাঁর সাথে কাউকে শরিক করো না এবং ঐসব কথা পরিহার কর, যা তোমাদের বাপ-দাদারা বলত (এবং করত)।’ আর তিনি আমাদেরকে-
> নামাজ পড়ার আদেশ দেন;
> সত্য কথা বলার আদেশ দেন;
> চারিত্রিক পবিত্রতা রক্ষার আদেশ দেন এবং
> আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখার আদেশ দেন।’ (বুখারি, মুসলিম, তিরমিজি, আবু দাউদ, মুসনাদে আহমাদ)
৪. শাহাদাতের মর্যাদা পায় সত্যবাদী
হজরত আবু সাবেত মতান্তরে আবু সাঈদ বা আবুল অলিদ সাহল ইবনু হুনাইফ রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বর্ণনা করেন, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সত্য অন্তর নিয়ে আল্লাহর কাছে শাহাদত প্রার্থনা করবে, তাকে আল্লাহ তাআলা শহীদদের মর্যাদায় পৌঁছাবেন; যদিও তার মৃত্যু নিজ বিছানায় হয়।’ (মুসলিম, তিরমিজি, নাসাঈ, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ, দারেমি)
৫. সত্যবাদিতায় বরকত হয়
হজরত আবু খালেদ হাকিম ইবনু হিজাম রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের জন্য ততক্ষণ পর্যন্ত (চুক্তি পাকা বা বাতিল করার) স্বাধীনতা রয়েছে, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা পৃথক (স্থানান্তরিত) না হবে। আর যদি তারা সত্য কথা বলে এবং (পণ্যদ্রব্যের প্রকৃতি) খুলে বলে, (দোষ-ত্রুটি গোপন না রাখে,) তাহলে তাদের কেনা-বেচার মধ্যে বরকত দেওয়া হয়। আর তারা যদি (দোষ-ত্রুটি) গোপন রাখে এবং মিথ্যা বলে, তাহলে তাদের দু’জনের কেনা-বেচার বরকত কমে যায়।’ (বুখারি, মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ)
এ কারণেই কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে সত্য আসলে অন্ধকার থাকবে না। সত্য অন্ধকারকে আলোকিত করে দেয়। আল্লাহর ঘোষণা-
وَ قُلۡ جَآءَ الۡحَقُّ وَ زَهَقَ الۡبَاطِلُ ؕ اِنَّ الۡبَاطِلَ کَانَ زَهُوۡقًا
‘আর (হে রাসুল আপনি) বলুন! ‘সত্য এসেছে এবং মিথ্যা বিলীন হয়েছে; নিশ্চয়ই মিথ্যা বিলীন হওয়ারই ছিল।’ (সুরা বনি ইসরাইল : আয়াত ৮১)
সুতরাং মানুষের উচিত, সব সময় সত্য কথা বলা। সত্যবাদিতার আদলে নিজেদের তৈরি করা। সত্যবাদিতার মর্যাদা ও উপকারিতা পাওয়ার চেষ্টা করা।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সত্য কথা বলার; সত্যবাদিতার গুণে নিজেদের তৈরি করার তাওফিক দান করুন। সত্যবাদিতার মর্যাদা ও উপকারিতাগুলো পাওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/এএসএম