নিয়তে গরমিল হলে পরিণাম কী হবে?
ইসলামে যে কোনে কাজে বিশুদ্ধ নিয়তের গুরুত্ব অনেক বেশি। নিয়তে বিশুদ্ধতা না থাকলে ভালো কাজেরও কোনো মূল্য নেই। এমনকি নিয়তে গরমিল থাকার কারণে ভালো কাজ করেও কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়। হাদিসের বর্ণনা থেকে তা প্রমাণিত। নিয়তের গরমিল সম্পর্কে কী বলেছেন বিশ্বনবি?
হাদিসে কুদসিতে এসেছে বহু নেক আমলধারী জীবনভর ভালো কাজ করা সত্বেও জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপিত হবে। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে- নিয়তের গরমিল। তাহলে নিয়ত বলতে কী বোঝায়?
নিয়ত হচ্ছে মনের একান্ত ইচ্ছা বা সংকল্প। মানুষের মনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত। আর ইসলামে বিশুদ্ধ নিয়ত হচ্ছে- একনিষ্ঠার সঙ্গে শুধু মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমল বা কাজ করার ইচ্ছা পোষণ করা। এ প্রসঙ্গে হাদিসে পাকে এসেছে-
হজরত আলকামাহ ইবনু ওয়াক্কাস আল-লাইসি বর্ণনা করেন, আমি হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহুকে মিম্বারের ওপর দাঁড়িয়ে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন- আমি আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি-
‘নিশ্চয়ই প্রত্যেক কাজ (এর প্রাপ্য প্রতিদান হবে) নিয়ত অনুযায়ী। আর মানুষ তার নিয়ত অনুযায়ী প্রতিফল পাবে। তাই যার হিজরত হবে দুনিয়া অথবা কোনো নারীকে বিবাহ করার উদ্দেশ্যে; তবে তার হিজরত সে উদ্দেশ্যেই হবে, যে জন্যে সে হিজরত করেছে।’ (বুখারি, মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ)
আল্লাহর জন্য কোনো কাজ করা হলে, আল্লাহ তাআলা বান্দার কর্মের সঙ্গে সঙ্গে অন্তরের বিষয়টিও দেখেন। হাদিসে পাকে এ বিষয়টিও ওঠে এসেছে এভাবে-
প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ বলেন- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা কারো বাহ্যিক অবকাঠামো ও সম্পদের দিকে লক্ষ্য করেন না। আল্লাহ তাআলা তার বান্দার অন্তরের দিকে এবং কর্মের দিকে লক্ষ্য করেন।’ (মুসলিম)
নিয়তে গরমিল হলে
যে ব্যক্তির নিয়তে গরমিল থাকে। যার নিয়ত নষ্ট হয়; তার জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত। নিয়তে গরমিল থাকা নেক আমলকারী ৩ ব্যক্তির বর্ণনা ওঠে এসেছে হাদিসে কুদসির বর্ণনায়-
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
প্রথম ব্যক্তি : শহিদ
নিশ্চয়ই কেয়ামতের দিন যে ব্যক্তির ওপর সর্বপ্রথম ফয়সালা করা হবে, সে ব্যক্তি শহিদ। তাকে ডাকা হবে এবং তার ওপর আল্লাহর দেওয়া নেয়ামতগুলো একে একে স্মরণ করানো হবে।
এরপর জিজ্ঞাসা করা হবে, তুমি কি এসব নেয়ামত ভোগ করেছিলে? সে স্বীকার করে নেবে। বলবে, হ্যাঁ, এসব নেয়ামত আমি ভোগ করেছি। তখন আল্লাহ বলবেন, ওই সব নেয়ামতের শুকরিয়ায় তুমি কী আমল করেছ?
সে বলবে, আমি আপনার রাস্তায় লড়াই করে শাহাদাতবরণ করেছি।
আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ; তুমি তো এই জন্য লড়াই করেছ, যেন তোমাকে লোকেরা বীর বলে ডাকবে। তোমাকে দুনিয়াতে তা দেওয়া হয়েছে।
এরপর আল্লাহর নির্দেশে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে, তাকে তার চেহারার ওপর ভর করে টেনে-হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (নাউজুবিল্লাহ)
দ্বিতীয় ব্যক্তি : কোরআন তেলাওয়াতকারী
যে নিজে ইলম শিখেছে, কোরআন পড়েছে এবং অপরকে শিক্ষা দিয়েছে। তাকেও পূর্ববর্তী ব্যক্তির মতো আল্লাহর নেয়ামতগুলো স্মরণ করানো হবে এবং সে তা স্বীকার করে নেবে।
আল্লাহ তাআলা প্রশ্ন করবেন, এর বিপরীতে তুমি কী আমল করেছ?
সে বলবে, আমি তোমার জন্য ইলম শিখেছি, কোরআন পড়েছি এবং অপরকে শিখিয়েছি।
আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছ; বরং তুমি তো এই জন্য ইলম শিখেছ যাতে লোকেরা তোমাকে আলেম বলে, কোরআনের ক্বারি বলে। দুনিয়ায় তা তো বলা হয়েছে।
এরপর তাকে আল্লাহর নির্দেশে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। তাকে তার চেহারার ওপর ভর করে টেনে-হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
তৃতীয় ব্যক্তি : দানকারী
যাকে আল্লাহ তাআলা স্বচ্ছলতা দিয়েছেন ও সর্বপ্রকার সম্পদ দান করেছেন। তাকে আল্লাহর নেয়ামতের কথা জানানো হবে, সে তা স্বীকার করবে।
আল্লাহ বলবেন, তুমি, এর প্রতিদানে কী আমল করেছ?
সে বলবে, যেখানে খরচ করা আপনি পছন্দ করেন, এমন কোনো খাত বাকি নেই, যেখানে আমি খরচ করিনি।
আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছ; বরং তুমি তা করেছ যেন লোকে তোমাকে দানবীর বলে। অতএব তোমাকে দানশীল বলা হয়েছে।
এরপর তার ব্যাপারে জাহান্নামে নিক্ষেপের নির্দেশ দেওয়া হবে। তাকে তার চেহারার ওপর ভর করে টেনে-হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।’ (মুসলিম ও নাসাঈ)।
সুতরাং সাবধান ও সতর্কতা সেসব আমলকারীর জন্য; যারা দুনিয়াতে নেক আমল করে; অথচ নিয়তের পরিশুদ্ধতা না থাকার কারণে পরকালে এর কোনো অংশই পাবে না। যা ওই সব নেক আমলকারীদের জন্য দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কিছুই নয়।
নিয়তের বিশুদ্ধতা ও মর্যাদা
ভালো করার সক্ষমতা না থাকলেও বেশি বেশি নেক আমল করার ইচ্ছা পোষণ করা জরুরি। কেননা নেক আমলের নিয়তের সঙ্গে সঙ্গেই মহান আল্লাহ সাওয়াব দান করেন। আর নিয়ত অনুযায়ী কাজ করতে থাকলে আল্লাহ তাআলা সাওয়াবও দিতে থাকেন। হাদিসের বর্ণনা থেকে তা প্রমাণিত-
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ বলেন- ‘আমার বান্দা যখন কোনো পাপ করার ইচ্ছা করে, তখন তোমরা তা লিখ না; যতক্ষণ না সে তা করে। যদি সে তা করে তবে সমান পাপ লিখ। আর যদি সে তা আমার কারণে (আল্লাহর ভয়ে অন্যায়) ত্যাগ করে, তাহলে তার জন্য তা নেকি হিসাবে লিখ।
আর যদি সে নেকি (ভালো কাজ) করার ইচ্ছা করে কিন্তু তা সে করেনি, তার জন্য তা নেকি হিসাবে লিখ। অতপর যদি সে তা (কাজটি) করে তাহলে তার জন্য তা দশগুণ থেকে সাত শ’ গুণ পর্যন্ত (নেকি) লিখ। (বুখারি, মুসলিম)
নিয়তের বিশুদ্ধ ও গরমিল সংক্রান্ত হাদিসগুলো থেকে প্রমাণিত যে, নিয়তের বিশুদ্ধ খুবই জরুরি। নিয়তের কারণে অনেক ভালো কাজও নিষ্ফল প্রমাণিত হয়। আর ভালো করতে না পারলেও শুধু নিয়ত করার কারণেই মহান আল্লাহ সাওয়াব দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
মনে রাখা জরুরি
দুনিয়া ও পরকালের সফলতায় নিয়তের বিশুদ্ধতা খুবই জরুরি। নিয়তের কারণেই দুনিয়া ও পরকালে মিলবে জান্নাত ও নেয়ামত। আর নিয়তের গরমিলের কারণে ভালো কাজ করেও দুনিয়া ও পরকালে হতে হবে অপমানিত ও লাঞ্ছিত। যেতে হবে জাহান্নামে।
সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, প্রথমেই নিয়ত ঠিক করে নেওয়া। এরপর আমল করা। যদি নিয়ত ঠিক হয় তবে আমলেরও পাওয়া যাবে পরিপূর্ণ প্রতিদান। আর যদি নিয়ত ঠিক না হয় তবে ভালো কাজেও সাওয়াব পাওয়া যাবে না বরং তার জন্য জাহান্নামের আজাব সুনিশ্চিত।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে যে কোনো কাজে নিয়ত বিশুদ্ধ করার তাওফিক দান করুন। নিয়তের গরমিল থেকে হেফাজত করুন। আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হাদিসের ওপর যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/এএসএম