জিলহজ মাস : আমল-ইবাদতের অনন্য মৌসুম
জিলহজ মাস। মুমিন মুসলমানের গোনাহমুক্তি, রিজিকবৃদ্ধি ও কল্যাণের মাস। এ মাসটি ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন ও ইবাদতে ভরপুর। যেন ইবাদতের অনন্য মৌসুম। গোনাহমুক্তি রিজিকবৃদ্ধি ও কল্যাণে ভরপুর জিলহজ মাসটি মুসলিম উম্মাহ কিভাবে গ্রহণ করবেন?
জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন রোজা, হজ, ঈদ, কুরবানি ও আইয়ামে তাশরিকের দিনগুলোতে রয়েছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এ সব ইবাদতে করনীয়-বর্জনীয় সব ফরজ ওয়াজিব এবং সুন্নাত কাজগুলো যথাযথভাবে গ্রহণ করলেই জান্নাতি মানুষে পরিণত হয় মুমিন। আসে দুনিয়ার সচ্ছলতা ও পরকালের সফলতা।
আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের প্রতি অধিক দয়ালু ও ক্ষমাশীল। তিনি তার বান্দাদের যে কোনো উপায়ে ক্ষমা করতে, রিজিক বাড়িয়ে দিতে, অভাবমুক্ত করতে এবং তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখাতে পছন্দ করেন। এ কারণেই আল্লাহ বান্দাদের বিভিন্ন আমলের বিনিময়ে অগণিত অসংখ্য পুরস্কার ঘোষণা করেন।
অসংখ্য নেয়ামত দিতে বিভিন্ন সময়ে আল্লাহ তাদের আমল করার সুযোগ দিয়ে নাজাতের ব্যবস্থা করেন। এর মধ্যে জিলহজ মাস অন্যতম। এ মাসের প্রথম দশ দিন, রোজা, ঈদ, কুরবানি ও আইয়ামে তাশরিকের দিনসমূহ করনীয়, বর্জনীয় ও সুন্নাহ পালনে রয়েছে গোনাহ থেকে মুক্তি, অভাব মোচন, রিজিক বৃদ্ধি ও সরাসরি জান্নাত প্রাপ্তির ঘোষণা।
জিলহজ মাসে গোনাহ মুক্তির অন্যতম উপায় আরাফার দিনে রোজা পালন। এদিন যারা রোজা রাখবে তাদের আগের এবং পরের এক বছরের গোনাহ মাফ হয়ে যাবে। যারা হজ করবে আল্লাহ তাআলা তাদের অভাব দূর করে দেবেন। রিজিক বাড়িয়ে দেবেন। সদ্যভূমিষ্ট নিষ্পাপ শিশুতে পরিণত করে দেবেন। এভাবেই আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ দেখিয়ে নেয়ামতে ভরপুর জীবন দান করেন। আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ পাওয়ার অনন্য মৌসুমই হলো জিলহজ মাস।
একজন মানুষের জীবনে ইবাদত ও অনুগ্রহ পাওয়ার এ মাসটি বারবার আসে। সৌভাগ্যবান সেই ব্যক্তি যে আল্লাহর দেওয়া সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ধন্য হতে পারে। আর দুর্ভোগ ও হতাশা তাদের জন্য যারা এ সুযোগটি পেয়েও কাজে লাগাতে পারেনি। নিজেরে গোনাহ থেকে মুক্ত হতে পারেনি। অভাব-অনটন দূর করতে পারেনি। রিজিক বাড়াতে পারেনি। রহমত ও বরকত গ্রহণ করতে পারেনি।
জিলহজ মাসের এ সুযোগ কাজে লাগানোর সময় এখনই...
আজ শুরু হয়েছে জিলহজ মাস। ইবাদতের মৌসুম এ মাসে প্রত্যেক মুমিন বান্দার দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে-
১. বেশি বেশি তাওবাহ করা।
২. কুরবানির আগে নখ, চুল কাটা থেকে বিরত থাকা।
৩. কুরবানির আগ পর্যন্ত ৯ দিন রোজা রাখা।
৪. আইয়ামে তাশরিকের দিনগুলোতে তাকবির পড়া।
৫. ইয়াওমে আরাফা তথা ৯ জিলহজ রোজা রাখা।
৬. কুরবানির আগ পর্যন্ত নখ, চুল ও অন্যান্য পশম না কাটা।
৭. ঈদের নামাজ পড়া।
৮. কুরবানি করা।
৯. বেশি বেশি দান-সাদকা করা।
১০. আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশি ও গরিব-দুঃখীর মাঝে কুরবানির গোশত বিতরণ করা।
বিশেষে করে...
১১. যাবতীয় গোনাহ ও অবাধ্যতা থেকে বিরত থাকা।
কারণ, গোনাহ মানুষকে আল্লাহর সব অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত করে দেয়। গোনাহ ব্যক্তির অন্তর ও আল্লাহর মাঝে পর্দা তৈরি করে দেয়। নেক আমলে বাধার সৃষ্টি করে।
এ কারণেই কল্যাণ পাওয়ার নির্ধারিত দিনগুলোতে বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগি করা। এমনসব আমলে দিন অতিবাহিত করা; যা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে সহায়ক হয়। যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে চলার চেষ্টা-সাধনা করবে, আল্লাহ তাআলা তার জন্য হেদায়াতের সব পথ খুলে দেবেন বলেও একাধিক আয়াতে ঘোষণা দিয়েছেন এভাবে-
১. وَٱلَّذِينَ جَٰهَدُواْ فِينَا لَنَهۡدِيَنَّهُمۡ سُبُلَنَاۚ
‘আর যারা আমাদের পথে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়, তাদেরকে আমরা অবশ্যই আমার পথে পরিচালিত করব।’ (সুরা আনকাবুত : আয়াত ৬৯)
২. وَسَارِعُوٓاْ إِلَىٰ مَغۡفِرَةٖ مِّن رَّبِّكُمۡ وَجَنَّةٍ عَرۡضُهَا ٱلسَّمَٰوَٰتُ وَٱلۡأَرۡضُ أُعِدَّتۡ لِلۡمُتَّقِينَ
‘আর তোমরা দ্রুত অগ্রসর হও তোমাদের রবের পক্ষ থেকে মাগফেরাত ও জান্নাতের দিকে, যার পরিধি আসমানসমূহ ও জমিনের সমান, যা মুত্তাকিদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ১৩৩)
সুতরাং মুমিন বান্দার উচিত, জিলহ মাসের এ গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোতে ইবাদত-বন্দেগিতে সতর্ক ও সজাগ থাকা। কোনোভাবেই যেন অবহেলায় এ গুরুত্বপূর্ণ সময় অতিবাহিত না হয়। অবহেলায় ইবাদতের মৌসুমগুলো অপচয় হলে এমন দিন লজ্জিত হতে হবে; যে দিন আজাব ছাড়া এ লজ্জা কোনো কাজে আসবে না।
এখনই সঠিক চিন্তা সময়। যথাযথ আমল-ইবাদত করার সময়। এখনই দুনিয়া থেকে আমলের পুঁজি সঞ্চয় করার সময়। কোনোভাবেই আমল সম্পর্কে বেখবর হওয়ার সুযোগ নেই।
মানুষ যাতে এ কথা বলতে না পারে যে, ‘আমি তো এসব পূণ্য বা নেকি পাওয়া সম্পর্কে বেখবর ছিলাম। সে কারণেই আল্লাহ তাআলা মানুষকে সজাগ করে দিতে কুরআনুল কারিমের একাধিক স্থানে এ সতর্কতা জারি করেছেন এভাবে-
১. وَلَا تَكُونُواْ كَٱلَّذِينَ نَسُواْ ٱللَّهَ فَأَنسَىٰهُمۡ أَنفُسَهُمۡۚ أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡفَٰسِقُونَ
‘তোমরা তাদের মত হয়ো না যারা আল্লাহকে ভুলে গিয়েছিল ফলে আল্লাহও তাদেরকে ভুলিয়ে দিয়েছিলেন; আর তারাই হল ফাসিক (গোনাহগার)।’ (সুরা হাসর : আয়াত ১৯)
২. إِنَّهُمۡ كَانُواْ يُسَٰرِعُونَ فِي ٱلۡخَيۡرَٰتِ وَيَدۡعُونَنَا رَغَبٗا وَرَهَبٗاۖ وَكَانُواْ لَنَا خَٰشِعِينَ
‘(তুমি তাদের মত হও) তারা (যারা) সৎ কাজে প্রতিযোগিতা করত। আর আমাকে আশা ও ভীতিসহ ডাকত। আর তারা ছিল আমার কাছে বিনয়ী।’ (সুরা আম্বিয়া : আয়ত ৯০ )
সুতরাং ইবাদত-বন্দেগি ও নেক আমলের সেরা মৌসুম জিলহজ মাসে আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি স্মরণ ও ইবাদত-বন্দেগি করার বিকল্প নেই।
মনে রাখা জরুরি
জিলহজ মাসের এ দিনগুলোসহ সব সময় রাতের গভীরে ইবাদত-বন্দেগি ও ক্ষমা প্রার্থনার আগে ও পরে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং দোয়া কবুলে এভাবে তার প্রশংসা ও প্রিয় নবির প্রতি দরূদ পড়া-
إِنَّ الْحَمْدُ للهِ ، نَحْمَدُهُ وَنَسْتَعِيْنُهُ وَنَسْتَغْفِرُهُ ، وَنَعُـوْذُ بِاللهِ مِنْ شُرُوْرِ أَنْفُسِنَا ، وَمِنْ سَيِّئَاتِ أَعْمَالِنَا ، مَنْ يَّهْدِهِ اللهُ فَلاَ مُضِلَّ لَهُ ، وَمَنْ يُّضْلِلِ اللهُ فَلاَ هَادِيَ لَهُ ، وَأَشْهَدُ أَنْ لاَّ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ ، وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ
উচ্চারণ : ইন্নাল হামদা লিল্লাহ; নাহমাদুকা ওয়া নাসতায়িনুকা ওয়া নাসতাগফিরুকা; ওয়া নাউজু বিল্লাহি মিন শুরুরি আনফুসিনা; ওয়া মিন সায়্যিআতি আমালিনা; মাই ইয়্যাহদিহিল্লাহু ফালা মুদিল্লালাহু; ওয়া মাই ইয়ুদলিলিল্লাহু ফালা হাদিয়ালাহ; ওয়া আশহাদু আন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহু; ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহু।
অর্থ : ‘নিশ্চয়ই সব প্রশংসা আল্লাহ তাআলার জন্য। আমরা আপনারই প্রশংসা করি, আপনার কাছেই সাহায্য চাই, আপনার কাছেই ক্ষমা প্রার্থনা করি। আর আল্লাহর কাছে আমরা আমাদের প্রবৃত্তির অনিষ্টতা ও আমাদের কর্মসমূহের ক্ষতি থেকে আশ্রয় কামনা করি। আল্লাহ যাকে হেদায়াত দেন, তাকে গোমরাহ করার কেউ নেই। আর যাকে গোমরাহ করেন তাকে হেদায়াত দেওয়ারও কেউ নেই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্যিকার ইলাহ নেই, তিনি একক, তার কোনো শরিক নাই। আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। সালাত ও সালাম নাজিল হোক তার উপর, তার পরিবার-পরিজন ও তার সাহাবীদের উপর এবং যারা কিয়ামত অবধি কল্যাণের সাথে তাদের অনুসরণ করেন তাদের উপর।
উল্লেখ্য, আজ (১২ জুলাই) জিলহজ মাসের প্রথম দিন। আগামী ১৯ জুলাই হজ ও আরাফার দিন। ২১ জুলাই কুরবানি।
আল্লাহ তাআলা উম্মতে মুসলিমাহকে ইবাদতের মৌসুম জিলহজে যাবতীয় ইবাদত-বন্দেগি যথাযথভাবে পালন করার মাধ্যমে নিজেদের গোনাহমুক্ত করার তাওফিক দান করুন। অভাব-অনটন থেকে হেফাজত করুন। রিজিকে বরকত দিন এবং জান্নাতের মেহমান হিসেবে কবুল করুন। আমিন।
এমএমএস/এএসএম