ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ধর্ম

বদনজরের কুপ্রভাব ও চিকিৎসার নিয়ম

ধর্ম ডেস্ক | প্রকাশিত: ১২:১৮ পিএম, ০৬ জুলাই ২০২১

বদনজর হলো হিংসাত্মক দৃষ্টির কুফল। আল্লাহর জিকির ছাড়া গাফেল অবস্থায় তীক্ষ্ণ কুদৃষ্টির ফলে জিন শয়তান মানুষের ক্ষতি করে। তাছাড়া যদি কেউ মজা করে বা আশ্চর্য হয়ে দোয়া ছাড়া কারো গুণ বর্ণনা করে তবে ওই ব্যক্তির ওপর নজর লাগতে পারে। এ বদনজরের কুপ্রভাবে আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা কী? বদনজরের চিকিৎসায় ইসলাম কী বলে?

হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, নজর লাগা সত্য; যদি ভাগ্যের আগে কিছু অগ্রগামী হত তবে নজর লাগায় হতো। আর যখন তোমাদের গোসল করতে বলা হবে তখন যেন সে গোসল করে।’ (মুসলিম)

বদনজরের প্রভাব ও লাগার পদ্ধতি
হিংসুক ও খারাপ দৃষ্টিতে তাকানো ব্যক্তির পক্ষ থেকে যার প্রতি হিংসা ও বদনজর করা হয় তার ওপর বিষাক্ত তীর নিক্ষেপ হয়। এই খারাপ দৃষ্টিতে তাকানো কখনো কার্যকর হয় আবার কখনো হয় না। যার প্রতি বদনজর করা হয়; তাকে যদি উন্মুক্ত ও প্রতিরক্ষাহীনভাবে পায় তবে এ কুদৃষ্টিতে ক্রিয়া হয়। আর কুদৃষ্টি যদি প্রতিরক্ষা অবস্থায় তার কাছে পৌছতে না পারে, তবে কোনো প্রতিক্রিয়া করতে পারে না।

কারো প্রতি দৃষ্টি দিয়ে আল্লাহর নাম না নিয়ে বা তার জন্য বরকতের দোয়া না করে যখন গুণ বর্ণনা করা হয়, তখন সেখানে উপস্থিত শয়তানি আত্মাগুলো তার এ দৃষ্টি ও বরকতহীন গুণের কথাগুলো লুফে নিয়ে তার সঙ্গে ঢুকে পড়ে। অতঃপর আল্লাহর ইচ্ছায় এবং তার মধ্যে প্রতিরক্ষার কোনো ব্যবস্থা না থাকলে বদনজরের কুপ্রভাব দেখা দেয়।

বদনজরের চিকিৎসা
দুইভাবে বদনজরের চিকিৎসার করার পদ্ধতি এসেছে হাদিসে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বদনজরের চিকিৎসা ও করণীয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। তাহলো-
১. বদনজরকারী পরিচিত হলে
বদনজরকারী ব্যক্তি যদি পরিচিত হয়, বা তাকে চেনা যায় তবে তাকে গোসল করার নির্দেশ দিতে হবে। আর বদনজরকারী ব্যক্তির উচিত হলো- আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের অনুসরণ করে গোসল করা। অতঃপর বদনজরকারী ব্যক্তির গোসলের পানি আক্রান্ত ব্যক্তির পেছন থেকে তার শরীরের ওপর ঢেলে দেওয়া। আল্লাহর ইচ্ছায় আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ হয়ে যাবে। হাদিসে এসেছে-
> হজরত আবু উমামাহ বিন হুনাইফ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, আমির বিন রাবিয়াহ রাদিয়াল্লাহু আনহু সাহল বিন হুনাইফ রাদিয়াল্লাহুর কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি তখন গোসল করছিলেন। আমির বিন রাবিয়াহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি এমন খুবসুরত সুপুরুষ দেখিনি; এমনকি পর্দানশীন নারীকেও এরুপ সুন্দর দেখিনি, যেমন আজ দেখলাম।
অতঃপর কিছুক্ষণের মধ্যেই সাহল রাদিয়াল্লাহু আনহু বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেলেন। তাকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নিয়ে যাওয়া হল এবং তাঁকে বলা হলো- ধরাশায়ী সাহলকে রক্ষা করুন।
তিনি (রাসুলুল্লাহ) জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমরা কাকে অভিযুক্ত করছো? তারা বললো, আমির বিন রাবিয়াহকে।
তিনি বলেন, তোমাদেরকেও বদনজর লাগিয়ে তার ভাইকে কেন হত্যা করতে চায়? তোমাদের কেউ তার ভাইয়ের মনোমুগ্ধকর কিছু দেখলে যেন তার জন্য বরকতের দোয়া করে।
অতঃপর তিনি পানি নিয়ে ডাকলেন অতঃপর আমির বিন রবিয়াহকে অজু করতে নির্দেশ দিলেন। তিনি তার মুখমণ্ডল, দুই হাত কনুই পর্যন্ত, দুই পা টাখনু পর্যন্ত ও লজ্জাস্থান ধুয়ে নিলেন।
তিনি (রাসুলুল্লাহ) আমিরকে পাত্রের (অবশিষ্ট) পানি সকলের উপর ঢেলে দেয়ার নির্দেশ দিলেন। তিনি সাহলের পেছন দিক থেকে পানি ঢেলে দেয়ার জন্য আমিরকে নির্দেশ দেন।‘ (ইবনে মাজাহ)

> হজরত আবু উমামা ইবনে সাহল ইবনে হুনাইফ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, তার বাবা তাকে বর্ণনা করেছেন, মক্কার পথ অতিক্রম করার সময় তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে ছিলেন। (দীর্ঘ হাদিস) সাহলকে বদনজর লাগালে তাঁকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নিয়ে যাওয়া হল। বলা হলো- হে আল্লাহর রাসুল! আপনি কি সাহল সম্পর্কে জানেন? আল্লাহর শপথ! সে মাথা ওঠাতে পারছে না এবং জ্ঞানও ফিরছে না।
তিনি বললেন, তোমরা কি কাউকে সন্দেহ করছ যে, যার বদনজর লেগেছে?
তারা বলল, হ্যাঁ, তার দিকে আমর ইবনে রবিয়াহ নজর দিয়েছিল।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়া সাল্লাম আমেরকে ডেকে তার ওপর রাগ করে বললেন, ‘তোমাদের কেউ তার ভাইকে কেন হত্যা করছ? যা দেখে তোমাকে আশ্চর্য করে; তার জন্য বরকতের দোয়া করলে না কেন?
তারপর তিনি তাকে বললেন- তার জন্য তুমি গোসল কর। অতঃপর সে তার মুখমণ্ডল, উভয় হাত কনুইসহ, হাটুদ্বয়, পাদ্বয়ের পাশ্র্ব এবং লুঙ্গির শরীরে লেগে থাকা অংশ (লজ্জাস্থান) একটি পাত্রে ধুয়ে নিল। তারপর সে পানিগুলো সাহলের ওপর ঢেলে দেওয়া হলো।
একজন তার পেছন থেকে মাথা ও পিঠের ওপর পানি ঢালবে। অতঃপর সে (পানির) পাত্রটি বার বার মাটিতে উপুড় করে দেবে।
এরূপ করার পর সাহল সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে সবার সঙ্গে যেতে লাগলো।’ (মুসনাদে আহমাদ)

২. বদনজরকারী পরিচিত না হলে
কোন ব্যক্তির বদনজর লেগেছে যদি তা জানা না যায় তবে আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে আক্রান্ত ব্যক্তিকে কুরআনের আয়াত ও নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে প্রমাণিত দোয়া দিয়ে ঝাড়ফুঁক বা চিকিৎসা করতে হবে।
এক্ষেত্রে রোগী ও চিকিৎসকের এ বিশ্বাস রাখতে হবে যে, আরোগ্যদানকারী শুধুই মহান আল্লাহ তাআলা। আর কুরআন হলো আরোগ্যের উপকরণ।

সুতরাং চিকিৎসকের উচিত কুরআনের আয়াত ও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে প্রমাণিত দোয়া দ্বারা ঝাড়ফুঁক বা চিকিৎসা করা। বদনজরের চিকিৎসায় কিছু দোয়া তুলে ধরা হলো-
> সুরা ফাতেহা পড়া;
> আয়াতু কুরসি পড়া;
> সুরা বাকারার শেষ দুই আয়াত পড়া;
> সুরা ইখলাস পড়া;
> সুরা ফালাক পড়া;
> সুরা নাস পড়া।
অতঃপর কুরআনের এ আয়াতগুলো পড়া
১. فَإِنْ آمَنُواْ بِمِثْلِ مَا آمَنتُم بِهِ فَقَدِ اهْتَدَواْ وَّإِن تَوَلَّوْاْ فَإِنَّمَا هُمْ فِي شِقَاقٍ فَسَيَكْفِيكَهُمُ اللّهُ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ
অতএব তারা যদি ঈমান আনে, তোমাদের ঈমান আনার মত, তবে তারা সুপথ পাবে। আর যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তারাই হঠকারিতায় রয়েছে। সুতরাং এখন তাদের জন্যে আপনার পক্ষ থেকে আল্লাহই যথেষ্ট। তিনিই শ্রবণকারী, মহাজ্ঞানী।’ (সুরা বাকারাহ : আয়াত ১৩৭)

২. وَإِن يَكَادُ الَّذِينَ كَفَرُوا لَيُزْلِقُونَكَ بِأَبْصَارِهِمْ لَمَّا سَمِعُوا الذِّكْرَ وَيَقُولُونَ إِنَّهُ لَمَجْنُونٌ
কাফেররা যখন কোরআন শুনে, তখন তারা তাদের দৃষ্টি দ্বারা যেন আপনাকে আছাড় দিয়ে ফেলে দিবে এবং তারা বলেঃ সে তো একজন পাগল।’ (সুরা ক্বলাম : আয়াত ৫১)

৩. أَمْ يَحْسُدُونَ النَّاسَ عَلَى مَا آتَاهُمُ اللّهُ مِن فَضْلِهِ فَقَدْ آتَيْنَا آلَ إِبْرَاهِيمَ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَآتَيْنَاهُم مُّلْكًا عَظِيمًا
‘নাকি যাকিছু আল্লাহ তাদেরকে স্বীয় অনুগ্রহে দান করেছেন সে বিষয়ের জন্য মানুষকে হিংসা করে। অবশ্যই আমি ইব্রাহীমের বংশধরদেরকে কিতাব ও হেকমত দান করেছিলাম আর তাদেরকে দান করেছিলাম বিশাল রাজ্য।’ (সুরা নিসা : আয়াত ৫৪)

৪. وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْآنِ مَا هُوَ شِفَاء وَرَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِينَ وَلاَ يَزِيدُ الظَّالِمِينَ إَلاَّ خَسَارًا
‘আমি কোরআনে এমন বিষয় নাযিল করি যা রোগের সুচিকিৎসা এবং মুমিনের জন্য রহমত। গোনাহগারদের তো এতে শুধু ক্ষতিই বৃদ্ধি পায়।’ (সুরা বনি-ইসরাইল : আয়াত ৮২)

৫. وَلَوْ جَعَلْنَاهُ قُرْآنًا أَعْجَمِيًّا لَّقَالُوا لَوْلَا فُصِّلَتْ آيَاتُهُ أَأَعْجَمِيٌّ وَعَرَبِيٌّ قُلْ هُوَ لِلَّذِينَ آمَنُوا هُدًى وَشِفَاء وَالَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ فِي آذَانِهِمْ وَقْرٌ وَهُوَ عَلَيْهِمْ عَمًى أُوْلَئِكَ يُنَادَوْنَ مِن مَّكَانٍ بَعِيدٍ
‘আমি যদি একে অনারব ভাষায় কোরআন করতাম, তবে অবশ্যই তারা বলত, এর আয়াতসমূহ পরিস্কার ভাষায় বিবৃত হয়নি কেন? কি আশ্চর্য যে, কিতাব অনারব ভাষায় আর রসূল আরবী ভাষী! বলুন, এটা বিশ্বাসীদের জন্য হেদায়েত ও রোগের প্রতিকার। যারা মুমিন নয়, তাদের কানে আছে ছিপি, আর কোরআন তাদের জন্যে অন্ধত্ব। তাদেরকে যেন দূরবর্তী স্থান থেকে আহবান করা হয়।‘ (সুরা হামিম সাজদাহ : আয়াত ৪৪)

অতাপর হাদিসের এ দোয়াগুলো পড়া-
১. بِسْمِ الله أرْقِيكَ، مِنْ كُلِّ شَيْءٍ يُؤْذِيكَ، مِنْ شَرِّ كُلِّ نَفْسٍ أَوْ عَيْنِ حَاسِد، اللهُ يَشْفِيك، بِسمِ اللهِ أُرقِيك
উচ্চারণ : ‘বিসমিল্লাহি আরক্বিকা মিন কুল্লি শাইয়িন ইয়ুজিকা মিন শাররি কুল্লি নাফসিন আও আইনিন হাসাদিন, আল্লাহু ইয়াশফিকা, বিসমিল্লাহি আরক্বিকা।’ (মুসলিম)

২. بِاسْمِ اللهِ يُبْرِيكَ، وَمِنْ كُلِّ دَاءٍ يَشْفِيكَ، وَمِنْ شَرِّ حَاسِدٍ إِذَا حَسَدَ، وَشَرِّ كُلِّ ذِي عَيْنٍ
উচ্চারণ : বিসমিল্লাহি ইয়ুবরিকা ওয়া মিন কুল্লি তায়িন ইয়াশফিকা ওয়া মিন শাররি হাসাদিন ইজা হাসাদা ওয়া শাররি কুল্লি জি আইনিন।’ (মুসলিম)

৩. أَمْسَحِ البَأْسَ رَبَّ النَّاسِ بِيَدِكَ الشِّفَاَءُ لَا كَاشِفَ لَهُ اِلَّا اَنْتَ
উচ্চারণ : ‘আমসাহিল বাসা রাব্বান্নাসি বিইয়াদিকাশ শিফাউ লা কাশিফা লাহু ইল্লা আংতা।’

৪. أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّةِ مِنْ كُلِّ شَيْطَانِ وَهَامَّةٍ وَمِنْ كُلِّ عَيْنٍ لَامَّةٍ
উচ্চারণ : ‘আউজু বিকালিমাতিল্লাহিত তাম্মাতি মিন কুল্লি শায়ত্বানি ওয়া হাম্মাতিন ওয়া মিন কুল্লি আইনিন লাম্মাতিন।’

সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, কারো গুণ বর্ণনার ক্ষেত্রে বরকতের নিয়ে আল্লাহর স্মরণের সঙ্গে করা। আর তাতে সে বদনজরের হাত থেকে মুক্তি পাবে। আর যদি কেউ বদনজরে আক্রান্ত হয়ে পড়ে তবে সুন্নাতের অনুসরণে বদনজর থেকে মুক্তির চেষ্টা করা।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে বদনজরের কুপ্রভাব থেকে হেফাজত করুন। হাদিসের ওপর যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

এমএমএস/এএসএম

আরও পড়ুন