কুরবানি সম্পর্কে বিশ্বনবির ১৭ দিকনির্দেশনা
সুন্নাতে ইবরাহিমি কুরবানির দিনকে ঈদুল আজহা বা ইয়াওমুন নাহর বলা হয়। বাংলা ভাষাভাষী মানুষসহ পাশ্ববর্তী দেশগুলোতে এ দিনটি কুরবানির ঈদের দিন হিসেবে পরিচিত। ইসলামের নিদর্শনাবলী মাঝে কুরবানি অন্যতম। আর ক’দিন পরেই অনুষ্ঠিত হবে এ কুরবানি। তাই কুরবানি বিষয়ক এমন কিছু হাদিস তুলে ধরা হলো; যা জানা মুমিন মুসলমানের জন্য খুবই জরুরি। তাহলো-
১. কুরবানির ঈদ
ইসলামে দুইটি ঈদ। একটি ঈদুল ফিতর অন্যটি ঈদুল আজহা। হাদিসে এসেছে-
হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন হিজরত করে মদিনায় আসলেন তখন মদিনাবাসীর দুটি (আনন্দ) উৎসবের দিন ছিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, এ দিন দুটি কীসের? (কী হিসেবে তোমরা এ দুই দিন উৎসব পালন কর?) তারা বলল, জাহেলিয়াত তথা ইসলামপূর্ব যুগে আমরা এ দুই দিন উৎসব পালন করতাম। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আল্লাহ তোমাদেরকে এ দুটি দিনের পরিবর্তে এর চেয়ে উত্তম দুইটি দিন দান করেছেন- (একটি) ঈদুল আজহা ও (অন্যটি) ঈদুল ফিতর।’ (দাউদ নাসাঈ, মুসনাদে আহমাদ)
২. ঈদ পালনের নির্দেশ
আর এ ঈদ পালনের নির্দেশ আল্লাহ তাআলা পক্ষ থেকে এসেছে। হাদিসের বর্ণনায় তা প্রমাণিত-
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আমাকে ‘ইয়াওমুল আজহা’র আদেশ করা হয়েছে (অর্থাৎ, এ দিন কুরবানি করার আদেশ করা হয়েছে); এ দিনকে আল্লাহ তাআলা এই উম্মতের জন্য ঈদ (খুশির দিন) বানিয়েছেন।’ (মুসনাদে আহমাদ, ইবনে হিব্বান, আবু দাউদ, নাসাঈ)
৩. ঈদের দিনের খাওয়া
ঈদুর আজহার দিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদের নামাজের পর খাবার খেতেন। হাদিসে এসেছে-
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদুল ফিতরের দিন কোনো কিছু না খেয়ে ঈদগাহে যেতেন না। আর ঈদুল আজহার দিন নামাজ না পড়ে কিছু খেতেন না।’ (তিরমিজি)
কুরবানির ঈদে নামাজের পর খাওয়ার কারণ সম্পর্কে অনেকেই বলে থাকেন যে, এ দিনটি আল্লাহর পক্ষ থেকে এক ধরনের দাওয়াত ও আপ্যায়ন। যেন সবার আগে কুরবানির গোশতই মুখে উঠে; এ কারণেই ঈদের নামাজের পর খাবার গ্রহণ করতে বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
আবার ঈদুল ফিতরের দিন সকালে নামাজের আগে কিছু খেয়ে নেওয়ার কারণ সম্পর্কে অনেকেই বলে থাকেন যে, আল্লাহর নির্দেশে রমজান মাসজুড়ে দিনের বেলা পানাহার বন্ধ ছিল। ঈদুল ফিতরের দিন খাবারের অনুমতি মিলে যাওয়ায় খুশির কারণেই ঈদগাহে যাওয়ার আগে কিছু মিষ্টান্ন খাবার গ্রহণ করতেন।
৪. কুরবানির দিন ঈদের নামাজে যাওয়া
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরবানির দিন পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যেতেন এবং পায়ে হেঁটে ঈদগাহ থেকে বাড়ি ফিরতেন। হাদিসে এসেছে-
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যেতেন এবং পায়ে হেঁটে ঈদগাহ থেকে ফিরতেন।’ (ইবনে মাজাহ)
৫. আসা-যাওয়া ভিন্ন পথ ব্যবহার
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদগাহে আসা-যাওয়া ভিন্ন পথ ব্যবহার করতেন। যে পথে ঈদগাহে যেতেন সে পথে বাড়ি ফিরতেন না। হাদিসে এসেছে-
হজরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদের দিন এক পথ দিয়ে (ঈদগাহে) যেতেন এবং ভিন্ন পথ দিয়ে (বাড়ি) ফিরতেন।’ (বুখারি)
৬. ভাব বিনিময়
কুরবানি কিংবা ঈদুল ফিতরের দিন একে অপরের সঙ্গে দেখা হলে পরস্পরের কবুলিয়তের জন্য দোয়া করতেন। হাদিসে এসেছে-
হজরত জুবায়ের ইবনে নুফাইর রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, সাহাবায়ে কেরাম ঈদের দিন পরস্পর সাক্ষাৎ হলে বলতেন-
تَقَبّلَ اللّهُ مِنّا وَمِنْكَ
উচ্চারণ : ‘তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকা।’
অর্থ : আল্লাহ কবুল করুন আমাদের পক্ষ থেকে ও আপনার পক্ষ থেকে।’ (ফাতহুল বারি)
৭. সকালে নামাজ পড়া
কুরবানি কিংবা রোজার ঈদ; উভয় ঈদের নামাজ সকাল সকাল পড়তেন বিশ্বনবি। আর কুরবানির ঈদের দিন যেহেতু পশু কুরবানির বিষয় থাকে সে কারণে সকাল সকাল নামাজ পড়াই উত্তম। হাদিসের এক বর্ণনায় এসেছে-
> বিখ্যাত তাবেঈ হজরত ইয়াজিদ ইবনে খুমাইর রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাহাবি হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে বুসর রাদিয়াল্লাহু আনহু ঈদুল ফিতর অথবা ঈদুল আজহার দিন লোকদের সঙ্গে ঈদের নামাজ পড়ার জন্য ঈদগাহে গেলেন। ইমামের আসতে বিলম্ব হলে তিনি এর প্রতিবাদ করলেন এবং বললেন, এ সময় তো আমরা (রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সঙ্গে) নামাজ পড়ে ফারেগ (অবসর) হয়ে যেতাম। (রাবী বলেন) আর এটা নফলের (অর্থাৎ ইশরাক পরবর্তী চাশতের) সময় ছিল।’ (আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ)
> সাহাবি হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে বুসর রাদিয়াল্লাহু আনহু সিরিয়ায় অবস্থান অবলম্বন করে নিয়েছিলেন এবং সেখানকার ‘হিম্স’ নামক স্থানে তাঁর ইনতিকাল হয়। সম্ভবত সেখানকার এ ঘটনা যে, ঈদের নামাজে ইমামের বিলম্ব করার উপর তিনি আপত্তি উঠালেন এবং বললেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যুগে আমরা ঈদের নামায সকাল সকাল পড়ে ফারেগ হয়ে যেতাম। (মাআরিফুল হাদীস)
> হজরত বারা ইবনে আজিব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের উদ্দেশে খুতবাহ দিলেন। তাতে বললেন, আমাদের এই (আজকের) দিনের প্রথম কাজ নামাজ আদায় করা, এরপর কুরবানি করা। সুতরাং যে এভাবে করবে তার কাজ আমাদের তরিকাহ মতো হবে। আর যে আগেই যবেহ করেছে (তার কাজ তরিকাহ মতো হয়নি অতএব) তা পরিবারের জন্য প্রস্তুতকৃত গোশত, (আল্লাহর জন্য উৎসর্গিত) কুরবানি নয়।’ (বুখারি, মুসলিম, ইবনে হিব্বান)
৮. প্রতি বছর কুরবানি দেওয়া
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতি বছরই কুরবানি করতেন। এমনটি হয়নি যে, তিনি এ বছর কুরবানি করেছেন পরের বছর করেননি; তারপর আবার তৃতীয় বছর কুরবানি করেছেন। বরং তিনি প্রতি বছরই কুরবানি করতেন। হাদিসে এসেছে-
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনার দশ বছরের (জীবনে) প্রতি বছরই কুরবানি করেছেন।’ (তিরমিজি, মুসনাদে আহমাদ)
৯. বিশ্বনবির কুরবানির পশু ও দোয়া
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিবছরই কুরবানি করতেন কিন্তু কীভাবে, কী পশু দিয়ে তিনি কুরবানি করতেন। হাদিসে এসেছে-
> হজরত জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরবানির দিন দুইটি সাদা-কালো, বড় শিং বিশিষ্ট, খাসি-দুম্বা জবেহ করেছেন। যখন তিনি তাদের শায়িত করলেন তখন বললেন-
إِنِّي وَجّهْتُ وَجْهِيَ لِلّذِي فَطَرَ السّموَاتِ وَالْأَرْضَ عَلَى مِلّةِ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا، وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ، إِنّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ لَا شَرِيكَ لَهُ، وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا مِنَ الْمُسْلِمِينَ، اللّهُمّ مِنْكَ وَلَكَ، وَعَنْ مُحَمّدٍ وَأُمّتِهِ بِاسْمِ اللّهِ، وَاللّهُ أَكْبَرُ
এরপর জবেহ করলেন।’ (আবু দাউদ, মুসনাদে আহমাদ, মুসতাদরাকে হাকেম)
> হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদগাহে জবেহ করতেন এবং নহর করতেন।’ (বুখারি)
১০.কুরবানির পশু জবেহ ও নহর করা
তবে নিয়ম হলো- গরু, ছাগল, দুম্বা জবেহ করা এবং উট নহর করা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমনই করেছেন। একাধিক হাদিসে এসেছে-
> হজরত আনাস ইবনে মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুইটি সাদা-কালো বর্ণের (বড় শিং বিশিষ্ট) নর দুম্বা কুরবানি করেছেন। আমি দেখেছি, তিনি দুম্বা দুটির গর্দানে পা রেখে ‘বিসমিল্লাহি ওয়াল্লাহু আকবার’ বললেন। অতঃপর নিজ হাতে জবেহ করলেন।’ (বুখারি, মুসলিম)
> হজরত জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, একটি দীর্ঘ হাদীসে এসেছে, ‘অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরবানির স্থানে এলেন এবং নিজ হাতে তেষট্টিটি উট নাহর করলেন। ( মুসলিম, আবু দাউদ)
১১. স্ত্রীদের পক্ষ থেকে স্বামীর কুরবানি
> হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর স্ত্রীদের পক্ষ থেকে গরু দ্বারা কুরবানি করেছেন।’ (বুখারি, মুসলিম)
গরু দ্বারা কুরবানির বিষয়টি হজরত জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর সূত্রেও বর্ণিত হয়েছে। (মুসলিম)
১২. কুরবানির পশুর বয়স
হজরত জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমরা (কুরবানিতে) ‘মুছিন্না’ (পশু) ছাড়া জবেহ করবে না। তবে সংকটের অবস্থায় ছয় মাস বয়সী ভেড়া-দুম্বা জবেহ করতে পারবে।’ (মুসলিম, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ)
তবে কুরবানির পশুর বয়স হতে হবে এমন-
> উট : অন্তত পাঁচ বছর বয়সী হতে হবে।
> গরু-মহিষ : অন্তত দুই বছর বয়সী হতে হবে।
> ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা এক বছর হতে হবে। তবে ভেড়া ও দুম্বার ক্ষেত্রে উপরোক্ত হাদিস থেকে জানা যায় যে, তা ছয় মাসের হলেও চলবে, এর কম হওয়া যাবে না।
১৩. যে পশু কুরবানি করা যাবে না
> হজরত বারা ইবনে আজেব রাদিয়াল্লাহু আনহু কুরবানির পশু সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাত দিয়ে ইশারা করেছেন -আমার হাত তো তাঁর হাত থেকে ছোট এবং বলেছেন, ‘চার ধরনের পশু দ্বারা কুরবানি করা যায় না-
- যে পশুর এক চোখের দৃষ্টিহীনতা স্পষ্ট;
- যে পশু অতি রুগ্ণ;
- যে পশু সম্পূর্ণ খোড়া এবং
- যে পশু এত শীর্ণ যে, তার হাড়ে মগজ নেই।’
লোকেরা বলল, আমরা তো দাঁত, কান ও লেজে ত্রুটিযুক্ত প্রাণী (দ্বারা কুরবানি করা)ও অপছন্দ করি? তিনি বললেন, যা ইচ্ছা অপছন্দ করতে পার। তবে তা অন্যের জন্য হারাম করো না।’ (ইবনে হিব্বান, আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ)
> হজরত আলি ইবনে আবি তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের আদেশ করেছেন, আমরা যেন (কুরবানির পশুর) চোখ ও কান ভালোভাবে লক্ষ করি এবং ওই পশু দ্বারা কুরবানি না করি, যার কানের অগ্রভাগ বা পশ্চাদভাগ কর্তিত। তদ্রূপ যে পশুর কান ফাড়া বা কানে গোলাকার ছিদ্রযুক্ত।’ (আবু দাউদ, নাসাঈ, তিরমিজি)
> অন্য হাদিসে হজরত আলি ইবনে আবি তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের শিং-ভাঙ্গা বা কান-কাটা পশু দ্বারা কুরবানি করতে নিষেধ করেছেন।’ (ইবনে মাজাহ, আবু দাউদ)
মনে রাখতে হবে
এই কুরবানি প্রকৃতপক্ষে বান্দার পক্ষ থেকে আল্লাহর দরবারে নজরানা নিবেদনের নাম। এ জন্য এটা জরুরি যে, নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী সর্বোত্তম ও ভাল পশু নির্বাচন করা। এটা খুবই খারাপ কথা যে, লোলা, ল্যাংড়া, অন্ধ, কানা, অসুস্থ, পক্ষাঘাতগ্রস্ত, শিং ভাঙ্গা ও কানকাটা কম দামের পশু আল্লাহর দরবারে পেশ করা।
বরং কুরবানির পশুর মূলনীতি হবে কুরআনের এ নির্দেশনার মতো- لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتّٰی تُنْفِقُوْا مِمَّا تُحِبُّوْنَ অর্থাৎ তোমরা পুণ্যের স্তরে পৌঁছতে পারবে না, যে পর্যন্ত না তোমাদের প্রিয় ও পছন্দনীয় বস্তু আল্লাহর রাহে খরচ করবে।
সুতরাকুরবানি সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এসব দিকনির্দেশনার প্রাণবস্তু ও এগুলোর মুখ্য উদ্দেশ্য এটাই। (মাআরিফুল হাদীস)
১৪. গরু ও উটে কুরবানির শরিক
হজরত জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমরা হজ্বের ইহরাম বেঁধে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সঙ্গে বের হলাম। …তিনি আমাদের আদেশ করলেন যেন আমরা প্রতিটি উট ও গরুতে ৭ জন করে শরীক হয়ে কুরবানি করি।’ (মুসলিম)
অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, (একটি) গরু ৭ জনের পক্ষ থেকে এবং (একটি) উট ৭ জনের পক্ষ থেকে (কুরবানি করা যায়)।’ (আবু দাউদ, তিরমিজি, বায়হাকি, ইবনে হিব্বান, ইবনে খুযাইমা)
১৫. কুরবানির পশুকে কষ্ট না দেওয়া
জবাই করার সময় অহেতুক কুরবানির পশুকে কষ্ট না দিয়ে সুন্দরভাবে জবেহ করার কথা বলেছেন বিশ্বনবি। হাদিসে এসেছে-
হজরত শাদ্দাদ ইবনে আওছ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আল্লাহ তাআলা সব কিছুর উপর অনুগ্রহকে অপরিহার্য করেছেন। অতএব যখন তোমরা হত্যা করবে তো উত্তম পদ্ধতিতে হত্যা কর। যখন জবেহ করবে তো উত্তম পদ্ধতিতে জবেহ কর। প্রত্যেকে তার ছুরিতে শান দেবে এবং তার পশুকে শান্তি দেবে।’ (মুসলিম, আবু দাউদ, নাসাঈ, তিরমিজি, ইবনে মাজাহ)
১৬. কুরবানির পশুরু গোশত
কুরবানির পশুরু গোশত কতদিন রেখে খাওয়া যাবে। এ সম্পর্কে হাদিসে সুস্পষ্ট নির্দেশনা এসেছে-
হজরত জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (বিশেষ একটি কারণে) তিন রাত পর কুরবানির গোশত খেতে নিষেধ করেছিলেন। এরপর (অবকাশ দিয়ে) বলেন, ‘খাও, পাথেয় হিসাবে সঙ্গে নাও এবং সংরক্ষণ করে রাখ।’ (মুসলিম)
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার এক বর্ণনায় আছে- فَكُلُوا وَادّخِرُوا وَتَصَدّقُوا. ‘খাও, সংরক্ষণ কর এবং সাদকা কর।’ (মুসলিম)
তবে কুরবানির পশুর গোশত-চামড়া বিক্রি করা বা পারিশ্রমিক হিসেবে কসাইকে দেওয়া যাবে না। কেননা এটা গরিবের হক। হাদিসে এসেছে-
হজরত আলি ইবনে আবি তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে তাঁর (কুরবানির উটের) আনুষঙ্গিক কাজ সম্পন্ন করতে বলেছিলেন। তিনি কুরবানির পশুর গোশত, চামড়া ও আচ্ছাদনের কাপড় সাদকা করতে আদেশ করেন এবং এর কোনো অংশ কসাইকে দিতে নিষেধ করেন। তিনি বলেছেন, আমরা তাকে (তার পারিশ্রমিক) নিজেদের পক্ষ থেকে দেব।’ (মুসলিম, বুখারি)
১৭. কুরবানির না করা সম্পর্কে সতর্কতা…
সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানি না করলে তার ব্যাপারে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সতর্ক করেছেন এভাবে-
مَنْ كَانَ لَهُ سَعَةٌ، وَلَمْ يُضَحِّ، فَلَا يَقْربَنّ مُصَلّانَا
সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কুরবানি করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।’ (ইবনে মাজাহ, দারাকুতনি)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কুরবানির সম্পর্কে বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উল্লেখিত হাদিসগুলোর ওপর যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। কুরবানির মাধ্যমে সুন্নাহ বাস্তবায়ন ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/এমএস