হিজরি সনের সূচনা ও প্রভাব
বিভিন্ন উপলক্ষ্যকে কেন্দ্র করে সন গণনার প্রস্তাব এলেও ইসলামি খেলাফতের সময়ে বিভিন্ন ঘটনার বিভ্রান্তি নিরসনকল্পে পরামর্শের ভিত্তিতে হিজরতের ঘটনা থেকে হিজরি সন বা বছর গণনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এ সন গণনা মুসলমানদের জীবনে রয়েছে অত্যধিক গুরুত্বপূণ প্রভাব। তাই হিজরি সনের সূচনা ও মুসলমানদের জীবনে হিজরি সনের গুরুত্ব ও প্রভাব সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো-
হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর খেলাফতের সময় হিজরতের ১৭তম বছর থেকে মূলত হিজরি সন গণনা শুরু হয়। হিজরি সন গণনার প্রেক্ষাপট ছিল এরকম—
হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে রাষ্ট্রীয় কাজে বিভিন্ন জাতি-গোত্র ও অঞ্চল থেকে চিঠি আসত। সেসব চিঠিতে প্রত্যেক জাতি-গোষ্ঠী ও অঞ্চলের লোকেরা দিন-তারিখ ও মাসের নাম লেখা হতো। কিন্তু কোনো সন বা বছরের সংখ্যা উল্লেখ থাকতো না। এ কারণে তারিখ ও মাসের মিল হয়ে গেলে সেখানে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়।
হিজরি সন গণনা শুরু হয় যেভাবে—
সন গণনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে আলোচনায় ঈসায়ী সনের সূচনার সঙ্গে মিল রেখে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মের সন থেকে ইসলামি সন শুরু করার প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। এ রকম আরও বেশি কিছু উপলক্ষ ও ঘটনার কথা আলোচিত হয়। কিন্তু হিজরতের সময় থেকে সন গণনা চূড়ান্ত হওয়ার পেছনে তাৎপর্য হলো-
প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঐতিহাসিক হিজরতকে মূল্যায়ন করা। কেননা প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরত ছিল ‘আল ফারিকু বাইনাল হাক্কি ওয়াল বাতিল’ অর্থাৎ সত্য-মিথ্যার মাঝে সুস্পষ্ট পার্থক্যকারী। হিজরতের পর থেকেই মুসলমানরা প্রকাশ্যে ইবাদত-বন্দেগি করতে শুরু করে। হিজরতের পর থেকেই মদিনায় ইসলামি রাষ্ট্র ও সমাজ-গঠনের রূপরেখা বাস্তবায়িত হয়।
হিজরতের পর মক্কার মুহাজির ও মদিনার আনসারদের মধ্যে আজান, নামাজ, জুমআ, ঈদ সবকিছু প্রকাশ্যে শুরু হয়। এ সব তাৎপর্যের দিকে লক্ষ্য রেখেই মুসলমানদের সন গণনা হিজরত থেকেই শুরু হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
প্রশ্ন থেকে যায়—
হিজরি সনের যে মাসগুলো গণনা করা হয়, এগুলো আগে থেকে এ নামেই ছিল। সে হিসেবে হিজরি সনকে কেবল আরবি সন হিসেবে সাব্যস্ত করা যায় কি না?
হিজরি মাসগুলোর নাম আরবি হলেও সনটি গোটা মুসলিম উম্মাহর কাছে হিজরি সন হিসেবেই গ্রহণ করা অপরিহার্য। কেননা মাসগুলো মূলত চন্দ্র বছরের মাস। যা চাঁদ দেখার উপর নির্ভরশীল। সে কারণে হিজরি সনও একটি চন্দ্রবর্ষ। যেভাবে ঈসায়ী সনকে বলা হয়, আশশুহুরুশ শামসিয়্যা বা সৌরবর্ষ। আর হিজরি সনকে বলা হয় আশশুহুরুল কামারিয়্যা তথা চন্দ্রবর্ষ।। এ কারণেই চন্দ্রবর্ষকে আরবি বর্ষ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না।
মুসলমানের জীবনে হিজরি সনের প্রভাব—
মুমিন মুসলমানের জীবনে হিজরি সন বা চন্দ্রবর্ষের প্রভাব ব্যাপক। এ সনের গুরুত্বও অত্যধিক। বিশেষ করে মুসলমানের জন্য ঈমানের অন্যতম রোকন ও ইবাদত রোজা, ঈদ, হজ ও কুরবানি ও জাকাত- এ হিজরি তারিখের উপর নির্ভরশীল। চন্দ্র বছরের তারিখ ও ক্ষণ গণনা করেই এ ইবাদতের সময় নির্ধারণ করতে হয়।
শুধু তা-ই নয়, কোনো নারীর স্বামীর মৃত্যু হলে কিংবা কেউ তালাকপ্রাপ্ত হলে চাঁদের সময় হিসাব করেই তাদের ইদ্দত পালন করতে হয়। সন্তান-সন্তুতির জন্ম ও দুধ পানের হিসাবও চন্দ্র মাসের হিসাব অনুযায়ী ধরতে হয়।
একটি বিষয় লক্ষণীয় যে—
চন্দ্রবর্ষ ছাড়া অন্যান্য বর্ষের হিসাব-নিকাশ করলে দেখা যায়, শীত, গরম, বর্ষা ও ফলের মৌসুমগুলো বিভিন্ন বর্ষে একই সময়ে হয়ে থাকে। আর হিজরি বা চন্দ্র বর্ষে এসব একেক সময় অনুষ্ঠিত হয়। হিজরি সনের এ হিসাব মূলত দ্বীনুল ফিতরাহ বা স্বভাব অনুকূল ধর্ম। এ কারণেই সব জাতি-গোষ্ঠীর মানুষ যার যার নিজ নিজ অনুকূল সময়ে ইবাদত-বন্দেগির সময় পান।
যেমন কোনো বছর ছোট দিনে রোজা হয়, আবার কোনো সময় বড় দিনে রোজা হয়। কোনো কোনো সময় বর্ষায় হজ-কুরবানি ও ঈদ উদযাপিত হয় আবার কোনো কোনো সময় শীত কিংবা গরমে হজ-কুরবানি ও ঈদ অনুষ্ঠিত হয়। আর এতে সব জাতি-গোষ্ঠীর মানুষই উপকারিতা লাভ করতে সক্ষম হয়।
সর্বোপরি মুসলমানদের জীবনে ইবাদতের ক্ষেত্রে হিজরি সনের গুরুত্ব বেশি হওয়ার কারণেই সব ঘটনা ও উপলক্ষ্যকে পাশ কাটিয়ে বিশ্বব্যাপী সব মানুষের সুবিধার্থে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হিজরতকে উপলক্ষ্য করেই শুরু হয় হিজরি সন। এ হিজরি সন বা চন্দ্রবর্ষ অনুযায়ী তারিখ গণনা মুমিন মুসলমানর জন্য ফরজে কেফায়া। এ সনটি আরবদের সন নয়, বরং এটি মুসলমানদের সন। ইসলামি সন।
মুমিন মুসলমানের উচিত হিজরি সন, মাস, তারিখ ব্যবহার ও চর্চা করা। হিসাব-নিকাশসহ যাবতীয় কাজে হিজরি সন মেনে চলা।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে জীবনের প্রতিটি কাজে হিজরি সনের ব্যবহার ও চর্চা করার এবং তা অব্যাহত রাখার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/পিআর