মহামারিতে অসহায়দের সহযোগিতায় ইসলামের নির্দেশনা
গরিব-অসহায় মানুষকে দান-সহযোগিতা করা অনেক বড় সাওয়াবের কাজ। বৈশ্বিক মহামারি করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী অনেক মানুষ খাদ্য-সামগ্রীসহ নানন অভাব ভোগ করছে। ইসলাম এসব দুর্যোগ ও মাহমারির সময় অসহায়দের সহযোগিতা করার নির্দেশনা দেয়।
গরিব-অসহায় এবং কর্মক্ষম-ক্ষুধার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো শুধু মানবিকতার পরিচয়ই নয় বরং তা সাওয়াবের কাজও বটে। অসহায়দের দান-সহযোগিতায় রয়েছে এমন সওয়াব, যার মাধ্যমে আল্লাহর দয়া ও করুণা বর্ষিত হয়। এতে আল্লাহ তাআলা বান্দার জন্য রিজিকের ভান্ডার খুলে দেন।
>> ক্ষুধার্তকে খাবার খাওয়ানো সর্বোত্তম আমল
ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে খাবার দান করা ইসলামের অন্যতম নির্দেশনা। কুরআন-সুন্নায় ক্ষর্ধাত ব্যক্তিকে খাবার দেয়ার বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘ আমি তাকে দুটি পথ প্রদর্শন করেছি। (মানুষকে এত গুণবৈশিষ্ট্য ও মেধা দেয়া সত্ত্বেও) সে (ধর্মের) দুর্গম গিরি পথে প্রবেশ করল না। তুমি কি জান দুর্গম গিরিপথ কী? (তা হচ্ছে) দাসমুক্তি। অথবা দুর্ভিক্ষের দিনে নিকটাত্মীয় ইয়াতীমকে, অথবা দারিদ্র-ক্লিষ্ট মিসকীনকে খাদ্য দান করা।‘ (সুরা বালাদ : আয়াত ১০-১৬)
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে খাবার দেওয়ার বিষয়টি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। ‘মানুষের কল্যাণ সংশ্লিষ্ট যত কাজ আছে, তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম কাজও ক্ষুধার্তকে খাবার দেয়া। হাদিসে এসেছে-
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! ইসলামে কোন জিনিসটি সর্বোত্তম। তিনি বললেন, ক্ষুধার্তকে (দরিদ্র-অসহায়) খাদ্য খাওয়াবে। চেনা-অচেনা সবাইকে সালাম দেবে।’ (বুখারি)
মানুষের ভালো কাজ তথা ইবাদত দুই ভাগে বিভক্ত। একটি মহান আল্লাহর সঙ্গে সম্পৃক্ত। সেগুলো মানুষ নামাজ, রোজা, জাকাত ও হজ ইত্যাদি আদায়ের মাধ্যমে পালন করে।
আর দ্বিতীয়ত কিছু ভালো কাজ বা ইবাদত আছে বান্দার সঙ্গে সম্পৃক্ত। আর তা মানুষ তাদের পারস্পরিক সুন্দর ব্যবহার ও একে অন্যের বিপেদে এগিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে করে থাকে।
দ্বিতীয় স্তরের ভালো কাজের মধ্যে সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ হচ্ছে ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে খাবার দেওয়া। ক্ষুধার্তকে আহার করিয়ে আনন্দ লাভ করা মহান আল্লাহর কাছে অত্যন্ত পছন্দনীয় আমল।
>> গরিবের সহযোগিতায় আল্লাহর অনুগ্রহ লাভ
আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ লাভের অন্যতম মাধ্যম হলো ক্ষুধার্ত ব্যক্তিদের খাদ্য দান করা। আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজিদে ইরশাদ করেন-
‘তারা বলে- ‘আমরা তোমাদেরকে খাবার খাওয়াচ্ছি কেবল আল্লাহর চেহারা (সন্তুষ্টি) লাভের জন্য, আমরা তোমাদের থেকে কোনো প্রতিদান চাই না, চাই না কোনো কৃতজ্ঞতা (জ্ঞাপন ও ধন্যবাদ)।’ (সুরা দাহর : আয়াত ৯)
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ক্ষুধার্ত মানুষকে খাবার খাওয়ানো ব্যক্তি প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহের কথা একাধিক হাদিসে উল্লেখ করেন বলেন-
- হজরত আব্দুল্লাহ ইবনু আমর রাদিয়াল্লাহ আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ্ তাআলা দয়ালুদের উপর দয়া ও অনুগ্রহ করেন। যারা জমিনে বসবাস করছে তাদের প্রতি তোমরা দয়া কর, তাহলে যিনি আকাশে আছেন তিনি তোমাদের প্রতি দয়া করবেন। দয়া রাহমান হতে উদগত। যে লোক দয়ার সম্পর্ক বজায় রাখে আল্লাহ্ তা‘আলাও তার সাথে নিজ সম্পর্ক বজায় রাখেন। যে লোক দয়ার সম্পর্ক ছিন্ন করে, আল্লাহ্ তা‘আলাও তার সাথে দয়ার সম্পর্ক ছিন্ন করেন।’ (তিরমিজি, আবু দাউদ)
- হজরত জারির ইবনে আব্দুল্লাহ বর্ণনা করেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ্ তার প্রতি রহম করেন না, যে মানুষের প্রতি রহম করে না।’ (বুখারি, মুসলিম)
- হজরত আব্দুল্লাহ্ ইবনু ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মুসলমান মুসলমানের ভাই। সে তার ওপর জুলুম করবে না এবং তাকে জালিমের হাতে সোপর্দ করবে না। যে কেউ তার ভাইয়ের অভাব পূরণ করবে, আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের দিন তার বিপদসমূহ দূর করবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের দোষ ঢেকে রাখবে, আল্লাহ কেয়ামতের দিন তার দোষ ঢেকে রাখবেন।’ (বুখারি, মুসলিম)
>> দান-সহযোগিতা নেয়ামতের শুকরিয়া আদায়
মানুষের মধ্যে যারা ক্ষুধার্ত তাদেরকে খাবার দেয়া হলো আল্লাহ তাআলার নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করার অন্যতম মাধ্যম। আল্লাহর শুকরিয়া আদায়কারী ব্যক্তির সম্মান-মর্যাদা ও ধন-সম্পদ বৃদ্ধি পায়। আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করো, তাহলে আমি অবশ্যই তোমাদের বেশি বেশি করে দেব।’ (সুরা ইবরাহিম : আয়াত ৭)
সুরা বালাদেও আল্লাহ তাআলা এ কথা উল্লেখ করেছেন-
‘আমরা কি দিইনি তাকে দুটি চোখ? এবং জিহ্বা ও দুটি ঠোঁট? আর আমরা তাকে দেখিয়েছি দুটি পথ। কিন্তু সে তো ধর্মের ঘাঁটিতে প্রবেশ করেনি। তুমি কি জানো ঘাঁটি কী? তা হলো দাসমুক্তি। অথবা ক্ষুধার দিনে ইয়াতিম নিকটাত্মীয়কে অথবা ভূলুণ্ঠিত অভাবগ্রস্তকে খাবার দেয়া।’ (সুরা বালাদ : আয়াত ৮-১৬)
>> গরিবদের দানে বিশ্বনবির বিশেষ নির্দেশনা
- ‘তোমরা ভিক্ষুককে (ক্ষুধার্তকে) কিছু না কিছু দাও, আগুনে পোড়া একটা খুর হলেও।’ (মুসনাদে আহমাদ নাসাঈ)
- ‘নিশ্চয়ই সে ব্যক্তি পূর্ণ মুমিন নয়, যে নিজে পেট পুরে আহার করে। কিন্তু তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে।’ (বায়হাকি)
- ‘ক্ষুধার্তকে খাদ্য দান করো। তাহলে শান্তির সঙ্গে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (তিরমিজি)
- ‘যে ব্যক্তি কোনো গরিবের চলার পথ সহজ করে দেয়, দুনিয়া-আখিরাতে মহান আল্লাহ তার চলার পথ সহজ করে দেবেন।’ (আবু দাউদ, তিরমিজি)
- মিসকিনদের জন্য চেষ্টা-সাধনাকারীদের সম্বন্ধে এ কথাও বলেছেন যে, ওই ব্যক্তি একাধারে নামাজ ও রোজা পালনকারীর মতো।’ (বুখারি, মুসলিম)
পরিশেষে…
ক্ষুধার্ত গরিব অসহায়দের দান সহযোগিতাকারী ব্যক্তিদের জন্য কুরআনের এ ঘোষণাই যথেষ্ট। আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘নিশ্চয়ই মুমিনরা আল্লাহর প্রতি তাদের ভালোবাসার খাতিরে ক্ষুধার্ত এতিম, মিসকিন ও কয়েদিদের খাদ্য দান করে। যার কারণে মহান আল্লাহ তাদের কেয়ামতের সেই ভয়াবহ দিনের অনিষ্টতা থেকে রক্ষা করবেন। শুধু তাই নয়; বরং তাদের দান করবেন আনন্দ ও সজীবতা। তাদের ধৈর্যশীলতার জন্য দেবেন জান্নাতের রেশমি পোশাক। জান্নাতে তারা উচ্চ আসনে হেলান দিয়ে বসবে।’ (সুরা দাহার : আয়াত : ৮-২২)
সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত গরিব অসহায় ও ক্ষুধার্তদের দান-সহযোগিতা খাদ্য-সামগ্রী দান করা। তাদের বিপদে ও কষ্টে দয়ার হাত প্রসারিত করা। তবেই সম্ভব দুনিয়া ও পরকালের অফুরন্ত কল্যাণ লাভ।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে ক্ষুধার্ত ও গরিবদের দান-সহযোগিতা করার মাধ্যমে দুনিয়া ও পরকালের অফুরন্ত নেয়ামত লাভ করার তাওফিক দান করুন। কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা মোতাবেক আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/জেআইএম