করোনা কি মানবজাতির জন্য শাস্তি?
বিশ্বজুড়ে এক মহাআতঙ্কের নাম করোনাভাইরাস। প্রাণঘাতী মহামারি এ করোনা কেন বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে? এ পরিস্থিতিতে মুসলমানদের করণীয় কী? এটা কি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের ওপর কোনো শাস্তি? করোনার ভয়ঙ্কর এ পরিস্থিতিতে মানুষের করণীয়ই বা কী?
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা মহামারি প্লেগ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে জানতে চেয়েছিলেন। মহামারি প্লেগ কী? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহামারি প্লেগ সম্পর্কে হাদিসে বর্ণনা তুলে ধরেন-
>> হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্লেগ রোগ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। তখন আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে জানান যে, ‘এটি হচ্ছে এক ধরনের আজাব। আল্লাহ যার উপর তা পাঠাতে ইচ্ছে করেন, পাঠান। কিন্তু আল্লাহ এটিকে মুমিনদের জন্য রহমত বানিয়ে দিয়েছেন। অতএব কোনো বান্দা যদি প্লেগ রোগে ধৈর্য ধরে আর এ বিশ্বাস নিয়ে নিজ শহরে অবস্থান করতে থাকে, তবে আল্লাহ তার জন্য যা নির্দিষ্ট করে রেখেছেন তা ছাড়া আর কোনো বিপদ তার উপর আসবে না। আর তাতে ওই বান্দার জন্য থাকবে শহীদের সাওয়াবের সমান সাওয়াব।’ (বুখারি)
এ হাদিসে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহামারি প্লেগকে আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের জন্য এক ধরনের শাস্তি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অন্য হাদিসে প্লেগ বা মহামারি নেমে আসার পাঁচটি কারণ উল্লেখ করেছেন-
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বললেন, হে মুহাজিরগণ! তোমরা পাঁচটি বিষয়ে পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। তবে আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি যেন তোমরা তার সম্মুখীন না হও। (তাহলো)-
- যখন কোনো জাতির মধ্যে প্রকাশ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে, তখন সেখানে মহামারি আকারে প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব হয়। তাছাড়া এমন সব রোগের উদ্ভব হয়, যা আগের লোকদের মধ্যে কখনো দেখা যায়নি।
- যখন কোনো জাতি ওজন ও পরিমাপে কারচুপি করে তখন তাদের উপর নেমে আসে দুর্ভিক্ষ, কঠিন বিপদ-মুসিবত।
- যখন কোনো জাতি জাকাত আদায় করে না তখন আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষণ বন্ধ করে দেয়া হয়। যদি ভূ-পৃষ্ঠে চতুষ্পদ জন্তু ও নির্বাক প্রাণী না থাকতো তাহলে আর কখনো বৃষ্টিপাত হতো না।
- যখন কোনো জাতি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের অঙ্গীকার ভঙ্গ করে, তখন আল্লাহ তাদের উপর বিজাতীয় দুশমনকে ক্ষমতাসীন করেন এবং সে তাদের সহায়-সম্পদ সবকিছু কেড়ে নেয়।
- যখন তোমাদের শাসকবর্গ আল্লাহর কিতাব (কুরআন) মোতাবেক মীমাংসা করে না এবং আল্লাহর নাজিলকৃত বিধানকে গ্রহণ করে না, তখন আল্লাহ তাদের পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে দেন।' (ইবনে মাজাহ)
সুতরাং হাদিসের আলোকে মুসলমান হিসেবে প্রত্যেকেরই উচিত, তার নিজের দিকে তাকানো। মহামারি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সময় বিশ্বব্যাপী মুসলিম উম্মাহ কি ইসলামের সঠিক পথ অবলম্বন করতে পেরেছে? ব্যক্তিগত, পারিবারিক কিংবা সামাজিক অন্যায় থেকে কি তারা মুক্ত? যদি অন্যায় অপরাধ থেকে মুক্ত না হয় মহামারি করোনাভাইরাসে আক্রান্তের এ সময়ে মুসলমানদের কী করা উচিত?
প্রত্যেক মুসলমানের সুদৃঢ় বিশ্বাস থাকা উচিত যে, পরিপূর্ণ আস্থা এবং অটল বিশ্বাসের সঙ্গে মহান আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়া। তার কাছে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাওয়া। অতঃপর মানবতার সেবায় আত্মনিয়োগ করা। সবার মাঝে সচেতনতা তৈরিতে ভূমিকা পালন করা। হাদিসে ঘোষিত বিষয়গুলো থেকে মানুষের বিরত থাকা জরুরি।
করোনাভাইরাস থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে এবং পরিবার ও সমাজের অন্যদের করোনাসহ সব মহামারি থেকে মুক্ত রাখতে আল্লাহর কাছে দোয়ার পরিবেশ তৈরি করতে বারবার তার কাছে একনিষ্ঠভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করাও আবশ্যক।
একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে…
উন্নত প্রযুক্তির অভিভাবক দেশগুলো করোনাভাইরাসে কতটা অসহায় এ কয়দিনে সে চিত্র ফুটে উঠেছে। উন্নত প্রযুক্তির এ অসহায়ত্বে রয়েছে মুমিন মুসলমানদের জন্য অনেক বড় শিক্ষা। আজ উন্নত প্রযুক্তির শক্তিশালী দেশগুলো করোনাভাইরাসে বেশি আক্রান্ত।
করোনার এ প্রাদুর্ভাবে এ বিষয়টি সুস্পষ্ট ও প্রমাণিত যে, উন্নত প্রযুক্তি ও সম্পদের জোরে করোনা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। প্রত্যেক জাতিগোষ্ঠীই করোনাভাইরাস থেকে মুক্ত থাকতে হলে সৃষ্টিকর্তার দিকেই তাকে ফিরে যেতে হবে। একমাত্র মহান আল্লাহ তাআলাই পারেন মানুষকে করোনা থেকে মুক্তি দিতে।
মুমিন মুসলমানের উচিত
প্রতিদিনের নিয়মিত রুটিনমাফিক ধর্মীয় কাজের প্রতি যথাযথ দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা। নিয়মিত কুরআন তেলাওয়াত করা। সময় মতো ওজু করে আল্লাহর প্রার্থনায় (নামাজে) নিয়োজিত হওয়া।
প্রতিটি কাজে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অবলম্বন করা। হাদিসে বর্ণিত দিকনির্দেশনাগুলোর ওপর যথাযথ আমল করা।
নিয়মিত যে দোয়া ও আমল করবে মুমিন
মুমিন মুসলমানের জন্য নিয়মিত বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষিত ‘মুআব্বিজ’ ও দোয়ার আমল করা একান্ত আবশ্যক। মুয়াব্বিজের আমল সম্পর্কে হাদিসে এসেছে-
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে রোগে ইন্তেকাল করেন সে িরোগের সময়ে তিনি নিজ দেহে ‘মুআব্বিযাত’ (সুরা নাস, ফালাক ও ইখলাস) পড়ে ফুঁক দিতেন। অতপর যখন রোগের তীব্রতা বেড়ে গেল, তখন আমি সেগুলো পড়ে ফুঁক দিতাম। আর আমি তাঁর নিজের হাত তাঁর দেহের উপর বুলিয়ে দিতাম। কেননা, তাঁর হাতে বারাকাত ছিল। রাবী বলেন, ‘আমি যুহরিকে জিজ্ঞাসা করলাম, তিনি কীভাবে ফুঁক দিতেন? তিনি বললেন, (বিশ্বনবি)তাঁর দুই হাতের উপর ফুঁক দিতেন, অতপর ওই দুই হাত দিয়ে আপন মুখমণ্ডল বুলিয়ে নিতেন।’ (বুখারি)
মহামারি করোনায় হাদিসে উল্লেখিত এ আমলটি নিয়মিত করা যেতে পারে। আর তাতে আল্লাহ তাআলা মানুষকে মহামারি করোনা থেকেও মুক্তি দান করতে পারেন। কেননা তিনিই তো রোগ-বালাই থেকে সেরা আরোগ্যদানকারী।
এছাড়াও করোনাভাইরাস থেকে বেঁচে থাকতে হাদিসে ঘোষিত এ দোয়াগুলোর আমলও করা যেতে পারে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সন্ধ্যায় তিনবার বলবে-
بِسْمِ اللَّهِ الَّذِي لاَ يَضُرُّ مَعَ اسْمِهِ شَيْءٌ فِي الأَرْضِ وَلاَ فِي السَّمَاءِ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ
উচ্চারণ : ‘বিসমিল্লাহিল্লাজি লা ইয়াদুররু মাআসমিহি শাইউন ফিল আরদ্বি ওয়ালা ফিসসামায়ি, ওয়া হুয়াসসাম উল আলিম।’
সকাল হওয়া পর্যন্ত ওই ব্যক্তির উপর আকস্মিক কোনো বিপদ আসবে না। আর যে ব্যক্তি সকালে তিনবার এ দোয়া পড়বে সন্ধ্যা পর্যন্ত তার ওপর কোনো বিপদ আসবে না।’ (তিরমিজি, আবু দাউদ)
অর্থ : ‘আল্লাহর নামে, যার নামের বরকতে আসমান ও জমিনের কোনো বস্তুই ক্ষতি করতে পারে না, তিনি সর্বশ্রোতা ও মহাজ্ঞানী।’
>> اَللَّهُمَّ اِنِّىْ اَعُوْذُ بِكَ مِنَ الْبَرَصِ وَ الْجُنُوْنِ وَ الْجُذَامِ وَمِنْ سَىِّءِ الْاَسْقَامِ
উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল বারাচি ওয়াল জুনুনি ওয়াল ঝুজামি ওয়া মিন সায়্যিয়িল আসক্বাম।’ (আবু দাউদ, তিরমিজি)
>> اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ مُنْكَرَاتِ الأَخْلاَقِ وَالأَعْمَالِ وَالأَهْوَاءِ وَ الْاَدْوَاءِ
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিন মুনকারাতিল আখলাক্বি ওয়াল আ’মালি ওয়াল আহওয়ায়ি, ওয়াল আদওয়ায়ি।’ (তিরমিজি)
করোনা থেকে মুক্ত থাকতে কাবা শরিফের প্রধান ইমাম শায়খ সুদাইসি বলেন-
‘তুমি থাকতে কার কাছে অভিযোগ করব আল্লাহ! তুমি ছাড়া কার কাছে হাত পাতবো হে আল্লাহ! তুমিই তো একমাত্র মাবুদ। তোমাকে ছেড়ে আমরা কার ইবাদত করব? তোমার ওপরই আমাদের সব আশা-ভরসা। হে আল্লাহ! আমাদের সেসব লোকদের অন্তর্ভুক্ত কর, যারা নেয়ামত পেলে শোকর আদায় করে। বিপদে সবর করে। গোনাহ হলে তওবা করে।
প্রাণঘাতী মহামারি করোনাভাইরাসের এ বিপদ মুহূর্তে তিনি বেশি বেশি এ দোয়া পড়তে গুরুত্বারোপ করেন। আর তাহলো-
لَا حَوْلَ وَ لَا قُوَّةَ اِلَّا بِالله الْعَلِىِّ الْعَظِيْم
উচ্চারণ : ‘লা হাউলা ওয়ালা কুয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিয়্যিল আজিম।’
অর্থ : ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো শক্তি নেই, কোনো ভরসা নেই, যিনি মহান ও সর্বশক্তিমান।’
মহামারি করোনাভাইরাসের এই প্রাদুর্ভাবের সময় সব মানুষের উচিত, আল্লাহর কাছে বেশি ক্ষমা প্রার্থনা করা। ধৈর্যের সঙ্গে যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করা। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাসহ হাদিসের ওপর যথাযথ আমল করা। করোনা মোকাবিলায় রাষ্ট্রীয় ও চিকিৎসকদের স্বাস্থ্যবিষয়ক সিদ্ধান্ত যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে মেনে চলা।
একান্তই যদি কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণগুলো নিজেদের মধ্যে দেখতে পায় তবে তার উচিত নিজ থেকে চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কোয়ারেন্টাইনে অবস্থানের প্রস্তুতি নিয়ে নেয়া।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহসহ বিশ্বের সব মানুষকে করোনাভাইরাস থেকে মুক্ত থাকতে কুরআন, সুন্নাহ, রাষ্ট্রীয় ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের পদক্ষেপগুলো যথাযথ মেনে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/জেআইএম