বিজ্ঞানের আবিষ্কার ও ব্যবহার মানুষের জন্য কল্যাণকর
প্রযুক্তি বিজ্ঞানের আবিষ্কার। প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার নির্ভর করে তার পরিচালকের ওপর। পৃথিবীর যত সৃষ্টি রয়েছে তার সব কিছুকে যেমন ভালো কাজে ব্যবহার করা যায় তেমনি তা মন্দ কাজেও ব্যবহার করা যায়। ভালো ও মন্দ কাজে ব্যবহার ব্যক্তির পরিচালনার ওপরই নির্ভর করে।
জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়ে চিন্তা ও গবেষণা সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারিমে বলেন-
‘নিশ্চয় আসমান ও জমিন সৃষ্টিতে এবং রাত ও দিনের আবর্তনে নিদর্শন রয়েছে জ্ঞানসম্পন্ন লোকদের জন্যে। যাঁরা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং চিন্তা গবেষণা করে আসমান ও জমিন সৃষ্টির বিষযে, (তারা বলে) পরওয়ারদেগার! এসব তুমি অনর্থক সৃষ্টি করনি। সকল পবিত্রতা তোমারই, আমাদিগকে তুমি দোজখের শাস্তি থেকে বাঁচাও।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ১৯০-১৯১)
কুরআনুল কারিম জ্ঞান-বিজ্ঞানে আলোচনায় ভরপুর। যার আবিষ্কার মুসলিমরা না করলেও অনেকেই কুরআনের গবেষণায় নিয়োজিত। বিশ্বনবির মেরাজ ও ওহি নাজিলের বিষয়টি গবেষণা করেই বর্তমান সময়ের উচ্চ যোগাযোগ ব্যবস্থার সব প্রযুক্তি আবিষ্কৃত।
প্রযুক্তির কল্যাণেই সারা পৃথিবী একটি গ্রামে পরিণত হয়েছে। হাতের মুঠোয় পুরো বিশ্ব। প্রযুক্তির কল্যাণে নিমিষেই সারা বিশ্বের যে কোনো খবর পৌছে যায় মানুষের কাছে। হাজার হাজার মাইল দূরে অবস্থানকারী মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়।
বিজ্ঞানের সব আবিষ্কারগুলোর মধ্যে প্রযুক্তি মানুষের জন্য মহান আল্লাহ তাআলা বিশেষ নেয়ামত। জ্ঞান-বিজ্ঞানের এসব আবিষ্কার মানুষের জন্য হারাম বা অভিশাপ নয়। এগুলোর মানুষকে উন্নতির দিকে নিয়ে যায়। প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে তা সবার জন্য হয়ে ওঠবে কল্যাণকর। সে কারণে আল্লাহর কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপন করা মানুষের জন্য খুবই জরুরি। আল্লাহ তাআলা বান্দাকে কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপন করতেও শিখিয়েছেন-
‘যখন তোমাদের পালনকর্তা ঘোষণা করলেন যে, যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর, তবে তোমাদেরকে (নেয়ামত) আরও দেব এবং যদি অকৃতজ্ঞ হও তবে নিশ্চয়ই আমার শাস্তি হবে কঠোর।’ (সুরা ইবরাহিম : আয়াত ৭)
আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করার সর্বনিম্ন স্তর হলো-
বিজ্ঞানের কল্যাণে আবিষ্কৃত সব জিনিসকে আল্লাহর নেয়ামত মনে করে তা সঠিক স্থানে, সঠিকভাবে ব্যবহার করা। আল্লাহর অবাধ্যতায় এবং মানবতার ক্ষতিকর কাজে তা ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা।
বিজ্ঞানের যত আবিষ্কার তা ব্যবহার করা হারাম বলে তা থেকে পিছিয়ে থাকার কোনো সুযোগ নেই বরং এগুলো আল্লাহর নেয়ামত মনে করে এর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করাই বুদ্ধিমানের কাজ। আর তাতে প্রযুক্তিসহ বিজ্ঞানের সব আবিষ্কারের কল্যাণ থেকে মানবজাতি বঞ্চিত হবে না।
যুগে যুগে সব নবি-রাসুলরাও তাদের সময়ে সেরা সেরা প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার করেছেন। তাদের দাওয়াতি কাজ থেকে শুরু করে দুনিয়ার সব কাজেই তারা পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। সুতরাং এ কথা বলা চলে যে, প্রযুক্তি ইসলাম ও মুসলমানসহ সমগ্র মানবজাতির জন্য কল্যাণকর।
কুরআনুল কারিমের এ আয়াতের দিকে একটু গভীর মনোযোগী হলেই সব মানুষের চিন্তার জগতে আলোড়ন সৃষ্টি হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘তিনিই সেই মহান সত্ত্বা, যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে। অতপর শুক্রবিন্দু থেকে, তারপর জমাট রক্ত থেকে, তারপর তোমাদেরকে (দুনিয়াতে) বের করে আনেন শিশুরূপে। অতপর (এক সময়) তোমরা যৌবনে পৌঁছে যাও, অতপর (সময়ের ব্যবধানে) বার্ধক্যে উপনীত হও। (আবার) তোমাদের কারও কারও এর আগেই মৃত্যু ঘটে যায় এবং তোমরা (কেউ কেউ) নির্ধারিত আয়ুষ্কাল পর্যন্ত বেঁচে থাকো। যাতে তোমরা অনুধাবন করতে পার।’ (সুরা মুমিন : আয়াত ৬৭)
এ আয়াত নিয়ে চিন্তা করলেই মানুষ বুঝতে পারবে মহান আল্লাহ কত বড় বিজ্ঞানী। তার জ্ঞানের পরিধি কথা সীমাহীন। যিনি এক ফোঁটা পানি থেকে বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। তিনি মানুষকে ধারাবাহিকভাবে শিশু, কিশোর, যৌবন ও বার্ধক্য দান করেন এবং সবশেষ মৃত্যু দান করেন।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে কুরআনুল কারিমের অসংখ্য আয়াত রয়েছে। আর তা প্রমাণ করে যে ইসলাম কখনো জ্ঞান-বিজ্ঞান বিষয়ে মানুষকে নিরুৎসাহিত করে না। বরং এর সঠিক ও সুন্দর ব্যবহারে উৎসাহিত করে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও বিভিন্ন বিষয়ে উন্নত জ্ঞান-বিজ্ঞানের ব্যবহার করছেন। ইসলামের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ গাজওয়ায়ে আহজাব তথা খন্দকের যুদ্ধে তিনি পারসিক কৌশল ব্যবহার করেছেন। যা আরবদের কাছে ছিল অপ্রচলিত প্রযুক্তি। আরবরা এ কৌশল কখনো চিন্তাই করেনি।
এ ছাড়া যুগে যুগে মুসলিম মনিষীরাও বিজ্ঞানের নানান আবিষ্কার মানুষকে উপহার দিয়েছেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলো ছড়িয়েছেন বিশ্বব্যাপী। মুসলিম রাজা-বাদশাহদের পরিচালিত স্পেন ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহারের শীর্ষে।
মুসলিম মনিষীদের আবিষ্কার থেকে বাদ যায়নি- রসায়ন, চিকিৎসা, ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান, ইতিহাস-ঐতিহ্য-বিচার ব্যবস্থা ও সমাজ বিজ্ঞান। মুসলিমদের কিছু আবিষ্কার-
>> রসায়নের আবিষ্কারক : জাবের বিন হাইয়ান।
>> চিকিৎসা বিজ্ঞানে : আল-রাজি, জাহরাভি ও ইবনে সিনা।
>> ফলিত পদার্থ বিজ্ঞানে : আল-ফারগানি।
>> সমাজ বিজ্ঞানে : ইবনে খালদুন।
>> ইতিহাস-ঐতিহ্য ও বিচার ব্যবস্থাপনায় : ইবনে বতুতা। এবং
>> গণিত, ভূগোল ও জ্যোতির্ময় বিজ্ঞানে : আল-খোয়ারিজমি।
মনে রাখা জরুরি
জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে কোনো আবিষ্কার তথা প্রযুক্তি কোনোটিই খারাপ নয়। তবে এটি নিশ্চিত করতে হবে যে চাইলে যে কেউ এসব আবিষ্কার বা প্রযুক্তি সঠিক কাজে লাগাতে সক্ষম। আবার চাইলে মন্দ কাজেও ব্যবহার করতে সক্ষম।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নয়নে চিন্তা ও গবেষণা সবার জন্যই অত্যাধিক গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন-
তারা নিজেরা কি ভেবে দেখে না যে, আল্লাহ নভোমন্ডল, ভূমন্ডল ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সবকিছু সৃষ্টি করেছেন যথাযথরূপে এবং নির্দিষ্ট সময়ের জন্য, কিন্তু অনেক মানুষ তাদের পালনকর্তার সাক্ষাতে অবিশ্বাসী।’ (সুরা রূম : আয়াত ৮)
কেননা আল্লাহ তাআলা বিশ্ব জগত এমনি এমনি সৃষ্টি করেননি। সৃষ্টি গুরুত্ব উপলব্ধি করতেই আল্লাহ তাআলা তার সৃষ্টি জগত ঘুরে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘বলুন, তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ কর এবং দেখ, কিভাবে তিনি সৃষ্টিকর্ম শুরু করেছেন। অতঃপর আল্লাহ পুর্নবার সৃষ্টি করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু করতে সক্ষম।’ (সুরা আনকাবুত : আয়াত ২০)
সুতরাং জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানুষের জন্য কল্যাণকর। এর চিন্তা-ভাবনা-গবেষণাও কল্যাণকর। এর সঠিক ব্যবহারও কল্যাণকর। প্রযুক্তিকে মানুষ যখনই কল্যাণমূলক কাজ তথা সঠিক কাজে ব্যবহার করবে তখনই এটি মানুষের জন কল্যাণকর হবে। ধর্মের দোহাই দিয়ে প্রযুক্তি থেকে পিছিয়ে থাকার কোনো সুযোগ নেই।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব প্রযুক্তি ইসলামের কল্যাণমূলক কাজে ব্যবহার করার পাশাপাশি এগুলোকে খারাপ কাজে ব্যবহার থেকে বিরত থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/পিআর