ভালো কাজও যে কারণে কবিরা গোনাহ হয়ে যায়
রিয়া বা লোক দেখানো যে কোনো আমলই কবিরা গোনাহের অন্তর্ভুক্ত। এ গোনাহ থেকে বেঁচে থাকতে কুরআন সুন্নায় সতর্ক করা হয়েছে। কেননা মানুষকে দেখানোর নিয়তে করা যে কোনো আমল বা ইবাদতই আল্লাহ তাআলা কবুল করেন না।
মুনাফেকি, কুফর, শিরক, অহংকারের মতো লোক দেখানো ইবাদতও কবিরা গোনাহের অন্তর্ভুক্ত। সে কারণে কুরআন-সুন্নায় লোক দেখানো ইবাদত থেকে বিরত থাকতে কঠোর দিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
প্রশংসা কিংবা বাহবা পাওয়ার নিয়তে কোনো ইবাদত বা আমলই গ্রহণযোগ্য নয়। নামাজ, রোজা, হজ, কুরবানি, জাকাতসহ সমাজ কল্যাণমূলক সব ভালো কাজ হতে হবে মহান আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। আল্লাহ তাআলা কুরআনে সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন-
‘(হে রাসুল! আপনি) বলুন, নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার কুরবানি, আমার জীবন ও মৃত্যু সব কিছুই সমগ্র বিশ্ব জাহানের মালিক আল্লাহ তাআলার জন্য।’ (সুরা আনআম : আয়াত ১৬২)
লোক দেখানোর নিয়তে আমল-ইবাদতকারীকে আল্লাহ তাআলা প্রতারখ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আর কুরআন-সুন্নাহর বর্ণনায় প্রতারণা করাও কবিরা গোনাহ। তাদের অপরাধ ও শাস্তি সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন-
>> ‘নিশ্চয়ই মুনাফিকরা আল্লাহর সঙ্গে প্রতারণা করতে চায়। অথচ তিনিও তাদের সঙ্গে প্রতারণা করতে সক্ষম। যখন তারা নামাজে দাঁড়ায়; তখন আলস্যভরে দাঁড়ায়। তারা লোকদের দেখায় যে, তারা নামাজ আদায় করছে, কিন্তু আল্লাহকে তারা কমই স্মরণ করে।’ (সুরা নিসা : আয়াত ১৪২)
>> ‘অতএব দুর্ভোগ সে সব নামাজিদের জন্য; যারা তাদের নামাজ সম্পর্কে বেখবর; যারা তা লোক-দেখানোর জন্য করে।’ (সুরা মাউন : আয়াত ৪-৬)
লোক দেখানো আমল করার মূল কথা হলো ইবাদতে আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করা। আর আল্লাহ তাআলা এমন ইবাদতকারীকেও পছন্দ করেন না। আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘বলুন, আমিও তোমাদের মতই একজন মানুষ, আমার প্রতি প্রত্যাদেশ হয় যে, তোমাদের ইলাহই একমাত্র ইলাহ। অতএব, যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সাক্ষাত কামনা করে, সে যেন ভালো আমল করে এবং তার পালনকর্তার ইবাদতে (ভালো আমলে) কাউকে শরিক না করে।’ (সুরা কাহফ : আয়াত ১১০)
লোক দেখানো সম্পর্কে হাদিসের বর্ণনা-
>> হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জনসম্মুখে প্রচারের ইচ্ছায় নেক আমাল করে আল্লাহ তাআলাও তার কৃতকর্মের অভিপ্রায়ের কথা লোকদেরকে জানিয়ে ও শুনিয়ে দেবেন। আর যে ব্যক্তি লৌকিকতার (লোক দেখানোর) উদ্দেশে কোনো নেক কাজ করে, আল্লাহ তাআলাও তার প্রকৃত উদ্দেশের কথা লোকেদের মাঝে ফাঁস করে দেবেন।’ (মুসলিম)
>> হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘মহিয়ান আল্লাহ বলেন, আমি শরীকদের (মুশরিকদের) শেরেক হতে মুক্ত। যে ব্যক্তি আমার জন্য কোনো (ভালো) কাজ করলো এবং তাতে আমি ব্যতীত অন্য কিছুকে (কাউকে) শরিক করলো, আমি তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। সে কাজ তার জন্য যাকে সে শরিক করেছে।’ (ইবনে মাজাহ)
অর্থাৎ আল্লাহকে ছাড়া অন্য কাউকে দেখানোর উদ্দেশ্যে যদি কোনো ভালো কাজ করা হয় তবে সে কাজ যার উদ্দেশ্যে করা হবে সে হিসেবে তা গণ্য হবে। তা আল্লাহর জন্য ইবাদত বা ভালো কাজ হিসেবে গণ্য হবে না। (নাউজুবিল্লাহ)
লোক দেখানো আমলের করুণ পরিণতি
লোক দেখানো আমল কিংবা প্রশংসা পাওয়ার জন্য যে কোনো ভালো কাজ করার পরিণতি হবে ভয়াবহ। কেয়ামতের দিন প্রশংসা পাওয়ার জন্য ভালো কাজ করার ব্যক্তিদের বিচারই প্রথম করা হবে। এ সম্পর্কে দীর্ঘ এক হাদিসে বিশ্বনবি বর্ণনা করেন-
হজরত সুলায়মান ইবনে ইয়াসার রহমাতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন, ‘লোকেরা আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে পৃথক হওয়ার পর সিরিয়ার (নাতিল নামক) এক ব্যক্তি তাঁকে বলল, হে শায়খ! আপনি রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে শুনেছেন, এমন একটি হাদিস আমার কাছে বর্ণনা করুন।
তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, লোকের মধ্যে কেয়ামতের দিন প্রথম (দিকে) যাদের বিচার করা হবে, তারা হবে তিন শ্রেণির লোক-
প্রথমত
সে ব্যক্তি যে শহীদ হয়েছে; তাকে আনা হবে, আল্লাহ্ তাআলা তাকে তাঁর নেয়ামতসমুহ স্মরণ করাবেন; সে তা স্বীকার করবে। তাকে বলবেন, এসব নেয়ামত ভোগ করে তুমি কী আমল করেছ?
সে ব্যক্তি বলবে, আমি তোমার সন্তুষ্টির জন্য লড়াই করে শহিদ হয়েছি।
তিনি (আল্লাহ্) বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছো। বরং তুমি যুদ্ধ করেছিলে এই জন্য, যেন বলা হয় অমুক ব্যক্তি বীর-বাহাদুর; (দুনিয়াতে তোমাকে) তা বলা হয়েছে।
তার সম্পর্কে আদেশ করা হবে, ফলে তাকে তার মুখের উপর (অধঃমুখে) টেনে-হেঁচড়িয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
দ্বিতীয়ত
আর এক ব্যক্তি ইল্ম শিক্ষা করেছে এবং লোকদেরকে শিক্ষা দান করেছে এবং কুরআন পাঠ করেছে। তাকে আনা হবে, তাকে তাঁর নেয়ামতসমুহ স্মরণ করাবেন, সে তা স্বীকার করবে।
তাকে বলা হবে, এর জন্য তুমি কী আমল করেছ?
সে বলবে, আমি ইল্ম শিক্ষা করেছি, অন্যকেও শিক্ষা দিয়েছি, আর তোমার সন্তুষ্টির জন্য কুরআন পাঠ করেছি।
তিনি (আল্লাহ তাআলা) বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছো। বরং তুমি ইল্ম শিক্ষা করেছিলে এজন্য যেন তোমাকে আলিম বলা হয়। আর কুরআন পাঠ করেছিলে, যেন তোমাকে ক্বারি বলা হয়; (দুনিয়াতে তোমাকে) তা (আলেম ও ক্বারি) বলা হয়েছে।
তার সম্পর্কে আদেশ করা হবে, ফলে তাকে তার মুখের উপর (অধঃমুখে) টেনে-হেঁচড়িয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
তৃতীয়ত
আর এক ব্যক্তি আল্লাহ্ যাকে প্রশস্ততা (সম্পদ) দান করেছিলেন এবং সর্বপ্রকার মাল দান করেছিলেন, তাকে আনা হবে। তাকে তাঁর নেয়ামত সম্পর্কে অবহিত করা হবে, সে তা স্বীকার করবে।
তাকে বলা হবে, এর জন্য তুমি কী আমল করেছ?
সে বলবে, আমি তোমার পছন্দনীয় কোনো রাস্তাই ছাড়িনি, তোমার সন্তুষ্টির জন্য যাতে ব্যয় করিনি।
তিনি (আল্লাহ তাআলা) বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছো। বরং তুমি এজন্যই ব্যয় করেছ, যাতে (তোমাকে) দাতা বলা হয়। (দুনিয়াতে তোমাকে) তা বলা হয়েছে।
তার সম্পর্কে আদেশ করা হবে, ফলে তাকে তার মুখের উপর (অধঃমুখে) টেনে-হেঁচড়িয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।’ (নাসাঈ)
পরকালে লোক দেখানো আমলকারীর পরিণত সম্পর্কে বিশ্বনবি একটি নমুনা পেশ করেছেন। সুতরাং লোক দেখানো ইবাদত বা আমলকারীর জন্য রয়েছে কঠিন পরিণতি। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
যেহেতু আল্লাহ তাআলা বান্দার জন্য তাওবার দরজা খোলা রেখেছেন। বান্দা চাইলে আল্লাহর কাছে তাওবা করে ফিরে আসতে পারে। যেসব বান্দা লোক দেখানো ইবাদতে জড়িত, তারা চাইলেই তাওবা করে ফিরে আসার সুযোগ রয়েছে।
লোক দেখানো যে কোনো আমলকারীই বড় গোনাহগার। রিয়া বা লোক দেখানো আমলের কবিরা গোনাহ থেকে বিরত থাকতে তাওবা-ইসতেগফারের বিকল্প নেই। লোক দেখানো ইবাদত থেকে নিজেদের বিরত রাখতে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনাই একমাত্র পথ।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে লোক দেখানো যে কোনো ইবাদত ও আমল থেকে হেফাজত করুন। কুরআন-সুন্নাহর ওপর যথযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। কুরআন-সুন্নাহর নসিহত মেনে চলার তাওফিক দান করুন। লোক দেখানো আমল করা থেকে বিরত থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/পিআর