বিশ্বের যে বৃহত্তম মসজিদে চলে খ্রিস্টানদের প্রার্থনা
আয়তনের দিক থেকে মক্কার মসজিদে হারামের পরেই যে মসজিদটির অবস্থান। সেটিতে বর্তমানে নামাজের বদলে চলে খ্রিস্টানদের প্রার্থনা। এটি হলো ঐতিহাসিক কুরতুবা মসজিদ।
স্পেনে মুসলিম শাসনামলের অনন্য কীর্তি ঐতিহাসিক কুরতুবা মসজিদ। হাজার বছরের পুরনো মসজিদটি এখনো স্থাপত্য নির্মাণশৈলী এবং কারুকার্যে অনন্য।
স্পেনের মুসলিমদের হারানো গৌরব ও তাক লাগানো সৌন্দর্যের এ মসজিদটি আগের অবকাঠামোতে থাকলেও সেখানে মুসলিমদের নামাজ পড়ার নেই কোনো সুযোগ।
স্পেনে মুসলিম শাসনের পতন হলে সেখানে নামাজ পড়াকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। ফলে বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে কুরতুবা মসজিদ খ্রিস্টানদের গির্জা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসেছে।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, একসময় শত শত বছর ধরে এ কুরতুবা মসজিদই ছিল মুসলিম শাসনের কেন্দ্রবিন্দু। মসজিদের অবকাঠামো, কারুকাজ ও সৌন্দর্য সব কিছু অক্ষুণ্ন থাকলেও নেই কেবল মুসলিমদের নামাজ ও ইবাদতের কোনো কার্যক্রম।
মুসলিম শাসনের পতনের আগে এ মসজিদে নিয়মিত ওয়াক্তিয়া নামাজসহ সপ্তাহিক জুমআর নামাজ, ইসলামি আলোচনা অনুষ্ঠান পরিচালিত হতো। বর্তমানে ঐতিহাসিক এ মসজিদে নামাজসহ ইসলামি যে কোনো কাজ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
মুসলিম বিশ্বের কাছে সুপরিচিত বিখ্যাত তাফসির গ্রন্থ কুরতুবি রয়েছে এ মসজিদের এক গভীর সম্পর্ক। এ মসজিদেই আল্লামা কুরতুবি রহমাতুল্লাহি আলাইহি মুসলিমদের তার রচিত তাফসিরে কুরতুবির পাঠ দিতেন।
ঐতিহাসিক কুরতুবি মসজিদে বসেই ইলমে তাসাউফের দরস দিতেন শায়খুল আকবর সুফি ইমাম ইবনে আরাবি। ইলমে হাদিসের দারস দিতেন হজরত বাকি ইবনে মাখলাদ। হজরত ইয়াহইয়া ইবনে ইয়াহইয়া আন্দালুসিও ইলমে দ্বীনের পাঠদান করতেন এ মসজিদে। ইলমে ফিকহের মাসআলা-মাসায়েল নিয়ে আলোচনা করতেন হজরত ইবনে হাজাম জাহেরি।
আজও সৌন্দর্য ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক কুরতুবি মসজিদ। দৃষ্টিনন্দন এ মসজিদ আজও বিশ্ব মুসলিমদের হৃদয়ে হাহাকার জাগিয়ে রাখছে।
বর্তমান স্পেনের কর্ডোবা যা প্রাচীন কুরতুবা নগরীতে গড়ে ওঠেছিল। মুসলিমরা শাসন প্রতিষ্ঠার পর এ শহরটি উন্দুলুস নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। মুসলিমদের শাসনাধীন উন্দুলুসের রাজধানী ছিল কার্ডোবা। আরবিতে এ কর্ডোভার উচ্চারণ হয় কুরতুবা।
স্পেনে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার ৭৩ বছর পর উমাইয়া খেলাফতের সুলতান আব্দুর রহমান (প্রথম) ৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে ঐতিহাসিক কুরতুবা মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেন।
মুসলিম খলিফা আব্দুর রহমান (প্রথম) নিজ তদারকিতে মসজিদের নির্মাণ কাজ এগিয়ে নিয়ে যান। সুলতান নিজেও প্রতিদিন এক ঘণ্টা করে মসজিদের নির্মাণ কাজে শ্রম দিতেন। তার ৩ বছরের শাসনামলে মসজিদটির অবকাঠামো দাঁড় করাতে সক্ষম হন।
৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে সুলতান আব্দুর রহমান (প্রথম)-এর মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে হিশাম খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং তিনিও মসজিদটি দৃষ্টিনন্দন ও সৌন্দর্য বাড়াতে অবদান রাখেন।
৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে খলিফা হিশাম মসজিদটির প্রাথমিক কাজ শেষ করতে সক্ষম হন। প্রাথমিক কাজ শেষ কুরতুবা মসজিদের আয়তন দাড়ায় দৈর্ঘে্য ৬০০ফুট এবং প্রস্থে ৩৫০ ফুট।
খলিফা হিশামের পর উমাইয়া খেলাফতের সব খলিফারাই ধারাবাহিকভাবে এ মসজিদের ধারাবাহিক কাজ ও উন্নয়ন অব্যাহত রাখেন।
নবম শতাব্দীতে খলিফা আবদুর রহমান (তৃতীয়) কুরতুবা মসজিদে পূর্ণাঙ্গ নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেন। আর তাতে মসজিদের আয়তন দাঁড়ায় ১ লাখ ১০ হাজার ৪০০ স্কয়ার ফিট। ৫০ দরজার এ বিশাল স্থাপনায় রয়েছে ১২৯৩টি পিলার বা স্তম্ভ।
কুরতুবা মসজিদ নির্মাণের পর এটি বিশ্বের অন্যতম স্থাপত্যশৈলীর মর্যাদা লাভ করে। আর এটি ছিল বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের আশ্চর্য স্থাপনা হিসেবে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু।
১২৩৬ খ্রিস্টাব্দে রাজা ফার্দিনান্দ ও রানী ইসাবেলা মুসলমানদের অভ্যন্তরীন কোন্দলের সুযোগে স্পেন দখল করে নেয়। সে সঙ্গে কুরতুবা মসজিদে মুসলমানদের নামাজ আদায়ও বন্ধ হয়ে যায়।
রাজা ফার্দিনান্দের নির্দেশে ঐতিহাসিক কুরতুবা মসজিদকে খ্রিস্টানদের গির্জায় রূপান্তরিত করা হয়। নিষিদ্ধ করা হয় র নির্দেশে কুরতুবা মসজিদকে গির্জায় রূপান্তরিত করা হয়৷ মুসলমানদের ইবাদত নামাজকে নিষিদ্ধ করা হয়।
রাজা ফার্দিনান্দের এ নির্দেশের ফলে মুসলমানদের একটানা ৭০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা ঐতিহ্য প্রতিদিন ৫ বার আজানের ধ্বনি ও নামাজ বন্ধ হয়ে যায়। আর মসজিদটির মিনারে মাইকের বদলে লাগানো হয় গির্জার ঘণ্টা। আর এখন সে মিনার থেকে আজানের পরিবর্তে প্রতিধ্বনিত হয় গির্জার ঘণ্টাধ্বনি।
বর্তমানে পর্যটকদের কাছে স্পেনের অন্যতম আকর্ষণের স্থান হলো ঐতিহাসিক কুরতুবা মসজিদ। এ মসজিদের আল্লাহ নাম ও আরবি ক্যালিগ্রাফিগুলোর স্থানগুলোতে লাগানো হয়েছে বিভিন্ন তৈল চিত্রের ক্রিশ্চিয়ান ফলক ও যীশুর ক্রশবিদ্ধ মূর্তি। বিভিন্ন স্থানে রয়েছে অসংখ্য মূর্তি।
উল্লেখ্য যে, কুরতুবা মসজিদ মুসলমানদের হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পর সেখানে কেউ আজান দেয়া কিংবা নামাজ পড়ার সুযোগ পায়নি। তবে একজন ব্যক্তি ঐতিহাসিক কুরতুবা মসজিদে নামাজ পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি হলেন বিশ্ববিখ্যাত কবি আল্লামা ইকবাল।
তিনি ১৯৩৩ সালে স্পেন সফরকালে কুরতুবা মসজিদ পরিদর্শনে গিয়ে দুই রাকাআত নামাজ আদায়ের অনুমতি চান। স্পেন প্রশাসনের বিশেষ অনুমতিতে আল্লামা ইকবাল সে মসজিদে দুই রাকাআত নামাজ আদায় করেন।
ঐতিহাসিক কুরতবা মসজিদে নামাজ পড়ে তিনি তার আবেগকে ৭টি কবিতার মাধ্যমে প্রকাশ করেন। যাতে কেউ সেখানে নামাজ, রুকু কিংবা সেজদা দিতে না পারে। সে জন্য অত্যাধুনিক সিসি ক্যামেরা নিয়ন্ত্রিত বিশেষ সিকিউরিটি ফোর্স সেখানে সার্বক্ষণিক পাহারায় নিয়োজিত।
স্পেনের ঐতিহাসিক কুরতুবা মসজিদ আবারও আবাদ হোক নামাজে। প্রতিদিন ধ্বনিত হোক আজানের সুর। এ প্রত্যাশাই করে মুসলিম উম্মাহ।
এমএমএস/পিআর