রবিউল আউয়ালের যে আমলে সৌভাগ্য লাভ করবে মুমিন
রবিউল আউয়াল। হিজরি (আরবি) বছরের তৃতীয় মাস। এ মাসটি যেসব কারণে বিখ্যাত তা হলো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বেলাদাত (জন্ম), নবুয়ত, হিজরত এবং ওফাত। এ সবই সংঘটিত হয়েছিল রবিউল আউয়াল মাসে।
বছরজুড়ে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ ও অনুকরণ ভুলে গিয়ে শুধু রবিউল আউয়ালে তার জন্ম উৎসবে মেতে থাকলেই পরিপূর্ণ ঈমানদার হওয়া যাবে না। বরং হাদিসে এসেছে-
‘সে ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত পরিপূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না ওই ব্যক্তি প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তার পিতা-মাতা, সন্তান থেকে বেশি ভালোবাসবে। অর্থাৎ পিতামাতা-সন্তান থেকেও প্রিয় নবিকে বেশি ভালোবাসতে হবে।’
এ ভালোবাসার মানে এ নয় কিংবা মুখে মুখে এ কথা বলা নয় যে, ‘হে রাসুল! সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আমি আপনাকে ভালোবাসি।’ বরং এর মর্মার্থ হলো এটি যে-
‘রাসুল তোমাদের জন্য যা নিয়ে এসেছে তা ধারণ কর। আর যা থেকে বিরত থাকতে বলেছেন তা থেকে বিরত থাক।’
কেননা যে ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দেখানো পথে কিংবা তাকে অনুসরণ করল, সে আল্লাহর আনুগত্য করল। সে কারণেই দুনিয়ার প্রতিটি কথা ও কাজে শুধু বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেই আদর্শ মানতে হবে। তাঁর দেখানো পথেই নিজেদের পরিচালিত করতে হবে।
মুমিন মুসলমানের অন্যতম আমলও এটি যে, তাঁর দেখানো পথ ও মতে থেকে জীবন পরিচালনা করবে। তবেই পাবে মহান আল্লাহর ভালোবাসা। আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘হে রাসুল! আপনি বলে দিন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসতে চাও তবে তোমরা আমার অনুসরণ কর। তা হলেই আল্লাহ তাআলা তোমাদের ভালোবাসবেন। আল্লাহ তাআলা তোমাদের গোনাহ ক্ষমা করে দেবেন। আর এমন জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যার তলদেশ দিয়ে নহর প্রবাহিত।’
আল্লাহ তাআলা নিজেও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর রহমত বর্ষণ করেন ফেরেশতারাও রহমতের দোয়া করেন এবং মানুষকে তার প্রতি দরুদ ও সালাম প্রেরণে নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ নবির ওপর রহমত নাজিল করেন এবং ফেরেশতারাও তাঁর জন্য রহমত কামনা করেন। হে মুমিনগণ! তোমরাও তাঁর প্রতি দরুদ পড় এবং অধিক পরিমাণে সালাম পাঠাও।’
সুতরাং মুমিন মুসলমানের ঈমানের দাবি হলো, তারা সারা বছর প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি দরুদ ও সালাম পাঠাবে। বিশেষ করে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্মৃতিবিজড়িত বেলাদাত, নবুয়ত, হিজরত ও ওফাতের মাসে তার প্রতি বেশি বেশি দরুদ ও সালাম পাঠাবে।
কেননা প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি দরুদ ও সালামে রয়েছে অনেক ফজিলত ও সাওয়াব। মুমিন মুসলমানের জন্য যার কিছু তুলে ধরা হলো-
> রহমত ও ক্ষমার ঘোষণা
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছেন, ‘যে আমার ওপর একবার দরুদ পড়বে, বিনিময়ে আল্লাহ তাআলা তার ওপর ১০টি রহমত নাজিল করবেন। (মুসলিম, তিরমিজি)
হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার ওপর একবার দরুদ পড়বে আল্লাহ তার ওপর ১০টি রহমত বর্ষণ করবেন। তার ১০টি গোনাহ ক্ষমা করে দেবেন। তার জন্য রহমতের ১০ দরজা খুলে দেয়া হবে। (মুসনাদে আহমদ, নাসাঈ)
> ফেরেশতাদের মাগফেরাত কামনার ঘোষণা
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর দরুদ পাঠকারীদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা নিযুক্ত রয়েছে ফেরেশতা। যারা দরুদ পাঠকারী বান্দার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে। হাদিসে এসেছে-
হজরত আমের ইবনে রবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমি আল্লাহর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে (খুতবা দেয়ার সময়) বলতে শুনেছি, ‘আমার ওপর দরুদ পাঠকারী যতক্ষণ দরুদ পড়তে থাকবে, ফেরেশতারা তার জন্য ততক্ষণ দোয়া করতে থাকে। সুতরাং বান্দার ইচ্ছা যে, সে দরুদ বেশি পড়বে না কম পড়বে।’ (মুসনাদে আহমদ, ইবনে মাজাহ)
> শাফাআতের ঘোষণা
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি দরুদ পাঠ করলে ওই ব্যক্তির জন্য তার সুপারিশ অবধারিত হয়ে যায়। হাদিসে এসেছে-
হজরত রুওয়াইফি ইবনে ছাবিত আনসারি রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি এ দরুদ পাঠ করবে তার জন্য আমার সুপারিশ অবধারিত হয়ে যাবে।’ (তাবারানি, ইবনে বাযযার)
> রাসুলের প্রতিবেশী হওয়ার ঘোষণা
কিয়ামতের দিন প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সবচেয়ে নিকটবর্তী হবে সেই ব্যক্তি যে দরুদ পড়ে। হাদিসে এসেছে-
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন ওই ব্যক্তি আমার সবচেয়ে কাছাকাছি হবে, যে আমার ওপর সবচেয়ে বেশি দরুদ পড়েছে।’ (তিরমিজি)
> মনোবাসনা পূরণের ঘোষণা
দুনিয়া ও পরকালে মুমিন মুসলমানের মনের একান্ত চাওয়াগুলোরও বাস্তবায়ন হবে। হাদিসে এসেছে-
হজরত উবাই ইবনে কাব রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার আল্লাহর জিকিরের খুব তাগিদ দিলেন। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমি আপনার প্রতি বেশি বেশি দরূদ পাঠ করে থাকি। আমি আমার দোয়ার কতভাগ আপনার জন্য নির্ধারণ করব? তিনি বললেন, তোমার যে পরিমাণ ইচ্ছা।
আমি বললাম, চারভাগের এক ভাগ? তিনি বললেন, তোমার যতটুকু ইচ্ছা। তবে বেশি করলে আরও ভালো।
আমি বললাম, তাহলে অর্ধেক? তিনি বললেন, তোমার যতটুকু ইচ্ছা। তবে বেশি করলে আরও ভালো।
আমি বললাম, তাহলে তিন ভাগের দুই ভাগ? তিনি বললেন, তোমার যতটুকু ইচ্ছা হয়। তবে বেশি করলে আরও ভালো।
আমি বললাম, তাহলে কি আমার দোয়ার পুরোটাই হবে আপনার প্রতি দরূদ? তিনি বললেন, তবে তো তোমার উদ্দেশ্য হাসিল হবে। তোমার গোনাহ মাফ করে দেয়া হবে।’ (তিরমিজি, তাবারানি)
> গরিবের জন্য সাদকার সওয়াবের ঘোষণা
গরিব ও অসহায় মানুষের জন্য সাদকার সাওয়াব অনেক গুরুত্বপূর্ণ। দরুদ পড়ার মাধ্যমে অসহায় গরিব মানুষের জন্য রয়েছে সাদকার সাওয়াব। হাদিসে এসেছে-
হজরত আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে মুসলমানের দান করার সামর্থ্য নেই সে যেন তার দোয়ায় বলে-
اَللهُمَّ صَلِّى عَلَى مُحَمَّدٍ عَبْدِكَ وَ رَسُوْلِكَ وَ صَلِّى عَلَى الْمُؤمِنِيْنَ وَ الْمُؤمِنَات وَ المُسْلِمِيْنَ وَ الْمُسْلِمَات
উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিন আবদিকা ওয়া রাসুলিকা ওয়া সাল্লি আলাল মুমিনিনা ওয়াল মুমিনাত ওয়াল মুসলিমিনা ওয়াল মুসলিমাত।’
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিন আবদিকা ওয়া রাসুলিকা ওয়া সাল্লি আলাল মুমিনিনা ওয়াল মুমিনাত ওয়াল মুসলিমিনা ওয়াল মুসলিমাত।’ এটা (দরুদ) ওই ব্যক্তির জন্য জাকাত তথা সদকা হিসেবে গণ্য হবে।’ (ইবনে হিব্বান)
> মুমিনের দরুদ ও সালাম শুনেন প্রিয় নবি
মুমিন মুসলমানের পড়া দরুদ ও সালাম প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে পৌছানো হয়। দরূদ পৌছানোর দায়িত্ব আল্লাহ তাআলা ফেরেশতা নিযুক্ত করে রেখেছেন। এ ফেরেশতা মদিনায় প্রিয় নবির রওজায় দরুদ পাঠকারীর পরিচয়ও পেশ করেন। হাদিসে এসেছে-
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলার জমিনে বিচরণকারী (এমন) কিছু ফেরেশতা আছেন, তাঁরা আমার কাছে উম্মতের পক্ষ থেকে পাঠানো সালাম পৌঁছে দেয়।’ (মুসনাদে আহমদ, নাসাঈ)
> দরুদবিহীন দোয়ার কুফল
দরুদবিহীন কোনো দোয়াই আল্লাহর কাছে পৌঁছে না বরং তা আসমান এবং জমিনের মাঝে ঝুলে থাকে, যা আল্লাহর কাছে পৌঁছে না। হাদিসে এসেছে-
হজরত উমর ইবনে খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘যে পর্যন্ত না তুমি তোমার নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর দরুদ না পড়বে ততক্ষণ এ দোয়া আসমানে যাবে না বরং তা আসমান ও জমিনের মাঝে ঝুলে থাকবে।’ (তিরমিজি)
মনে রাখতে হবে
প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিশ্বমানবতার জন্য রহমত ও অনুপম আদর্শ। তাঁর অনুসরণ ও অনুকরণ করতে কুরআনে পাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাঁর প্রতি দরুদ পাঠেই যদি এত বেশি ফজিলত লাভ করা যায়। তবে তার হুকুম আহকাম কিংবা দিকনির্দেশনা পালন করলে মুমিনের মর্যাদা কতবেশি হবে তা অনুমেয়।
সুতরাং রবিউল আউয়াল হোক মুসলিম উম্মাহর জন্য আদর্শ গ্রহণের মাস। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ গ্রহণে কুরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী জীবন পরিচালনাই হোক মুমিন মুসলমানের দীপ্ত প্রত্যয়। আদর্শ গ্রহণের যে ঘোষণা দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা-
‘অবশ্যই তোমাদের জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের (চরিত্রের) মধ্যে রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ। যারা আল্লাহ ও পরকালকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে। (সুরা আহযাব : আয়াত ২১)’
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে প্রিয় নবির সর্বোত্তম আদর্শ গ্রহণে তাকে ও পরকালকে ভয় করার এবং তাকে বেশি বেশি স্মরণ করার মাধ্যমে দ্বীন ও ইসলামকে ব্যক্তি পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রে বাস্তবায়ন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/পিআর