বন্দির এ কেমন অঙ্গীকার ও শুকরিয়া?
নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ার পর ফেরত আসার অঙ্গীকার করে ছাড়া পেয়ে সে অঙ্গীকার পালন করা খুবই কঠিন। যে ব্যক্তি জানে যে রাত পোহালেই মৃত্যু সুনিশ্চিত, সে কী করে ছাড়া পেয়েও শুধু অঙ্গীকার পালনে ফিরে আসে। আবার নিশ্চিত মৃত্যু থেকে যার কল্যাণে কোনো ব্যক্তি মুক্তি লাভ করে, সে ব্যক্তির প্রতি এ শুকরিয়ার ধরণই বা কী রকম হতে পারে?
বাদশাহ হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের আমলে এমনই একটি ঘটনা ঘটে। যা ঈমানদার মুসলমানের শিক্ষা ও ঈমানি চেতনা লাভে স্মরণীয় ঘটনা। সংক্ষেপে তা তুলে ধরা হলো-
বাদশাহ হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের শাসনামলে বিভিন্ন বিদ্রোহ ঘটে। এ সব বিদ্রোহ দমনে হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ ছিলেন অত্যন্ত কঠোর। যদি সে বিদ্রোহীদের ওপর বিজয় লাভ করতো তবে বন্দীদের সবাইকে সে হত্যা করতো।
এমনি এক বিদ্রোহ দমন করার পর জল্লাদকে বন্দীদের হত্যার নির্দেশ দেয়। জল্লাদ বাদশাহর সামনে বিদ্রোহীদের হত্যা করতে থাকে। শুধুমাত্র একজন বিদ্রোহী বাকি থাকতেই নামাজের সময় হয়ে যায়। বাদশাহ তার সেনাপতি কুতাইবাকে উদ্দেশ্য করে ঘোষণা দেন যে, আজ আর নয়, এ বিদ্রোহীকে আগামীকাল সকালে হত্যা করা হবে। এ বন্দী তোমার (কুতাইবা) সঙ্গে থাকবে।
বিদ্রোহীর অঙ্গীকার
বিদ্রোহী আল্লাহকে জামিন রেখে তাকে একটি রাতের জন্য মুক্তি দিতে পীড়াপীড়ি করেন। বন্দী এ মর্মে কুতাইবাকে বললেন, ‘তোমার মধ্যে যদি কোনো ভালো কাজের জযবা থাকে তবে তুমি আমাকে মুক্তি দাও।
আমি আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জাতকে জামিন রেখে এ ওয়াদা করছি যে, বাদশাহর দরবারে পৌছার আগে আমি আগামীকাল সকালে ফিরে আসবো।
এক রাতের জন্য মুক্তি চাওয়ার কারণ
এক রাতের জন্য মুক্তি চাওয়ার কারণ জানিয়ে সেনাপতিকে বন্দী বলল, আমার কাছে মানুষের অনেক আমানত রয়েছে। বাদশাহ হাজ্জাজ যেহেতু আমাকে আগামীদিন হত্যা করবে, সেহেতু তুমি আমাকে আজ রাতের জন্য মুক্তি দাও। আমি রাতের এ সময়ে মানুষের গচ্ছিত আমানত ফেরত দিয়ে আসতে পারি এবং প্রত্যেক হকদারকে তাদের হক আদায় করতে পারি।
বিশেষে করে আমার যা কিছু দেনা-পাওনা আছে তা আমি আমার ওয়ারিশদেরেকে বলে আসতে পারি। আল্লাহকে সাক্ষী করে জামিন চাচ্ছি, আমি আগামীকাল সকালিই চলে আসবো।
সেনাপতি তার কথা শুনে প্রথমে আশ্চার্যান্বিত হল এবং হাসলো আর বলল, এ কেমন কথা বলছ তুমি? সেনাপতির এ প্রশ্নে বন্দী তার চেহারা দিকে তাকিয়ে আবার বলল, আমি আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বলছি, আগামীদিন ফিরে আসবো। বন্দী বার বার তাকে অনুরোধ করতে থাকল। অবশেষে তার প্রতি আমার করুনা হলো।
রাতের জন্য মুক্তি
সেনাপতি কুতাইবা বন্দীকে রাতের জন্য মুক্তি দিলো। মুক্তি দিয়েই সে চিন্তায় অস্থির হয়ে গেল এ ভেবে যে, নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও কেউ কি ফিরে আসে। যদি সে না আসে তবে সকালে বাদশাহ হাজ্জাজের কাছে সে কি জবাব দেবে। বাদশাহ-ই বা তার সঙ্গে কী আচরণ করে।
সেনাপতি কুতাইবার জন্য সে রাতটি ছিল ভয়ানক অস্বস্তির রাত। যা চিন্তা আর দোয়ায় ভরপুর ছিল।
বন্দী মুক্তি পেয়েই ঘরমুখী হয়ে গেল এবং সে রাতে প্রত্যেকের আমানত বুঝিয়ে দিয়ে তার ওয়ারিশদেরকে তার দেনা-পাওনার তথ্য দিয়ে সেনাপতির উদ্দেশ্যে সকালেই ফিরে আসে।
সকালেই বন্দীর প্রত্যাবর্তন
পর দিন সকালেই কে যেন সেনাপতির দরজায় নক করলো। সেনাপতি তখনই দরজা খুলে দেখে বন্দী দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। বন্দীকে দেখে সেনাপতি বলল, তাহলে তুমি সত্যিই ফিরে আসলে। বন্দী বলল, হ্যাঁ, আমি ফিরে আসছি এবং তোমার সামনে দাঁড়ানো। অতঃপর বন্দী বলল-
جَعَلْتُ اللهَ كَفِيْلًا وَ لَا أَرْجِعُ؟
‘আমি আল্লাহকে জামিনদার করে রেখে গেছিা, আর ফিরে আসবা না এ কেমন করে হয়?’
পরদিন হাজ্জাজের দরবারে উপস্থিত
সেনাপতি কুতাইবা বন্দীকে নিয়ে হাজ্জাজের দরবারে পৌছলো। বন্দীকে দারওয়ানের কাছে রেখে সেনাপতি বাদশাহর কাছে গেল। হাজ্জাজ সেনাপতিকে দেখামাত্র জিজ্ঞাসা করলো- কুতাইবা, আমার বন্দী কোথায়?
সেনাপতি কুতাইবা বলল, বাদশাহর কল্যাণ হোক। সে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। সেনাপতি তাকে দরজা থেকে বাদশাহর কাছে নিয়ে আসলো এবং রাতের মুক্তির ঘটনা এবং সকালে ফিরে আসার বর্ণনা দিল।
বাদশাহ হাজ্জাজ বন্দীর আপাদমস্তক দেখতে লাগলো। হঠাৎ সে বলে ওঠলো-
وَهَبْتُ لَكَ
‘(সেনাপতি) আমি এ বন্দী তোমাকে বখশীশ করলাম।’ তুমি তাকে যা খুশী তা করতে পার।
সেনাপতি বন্দীকে নিয়ে হাজ্জাজের দরবার থেকে বেরিয়ে এসে বন্দীকে বলল, তোমার যেখানে খুশী সেখানে চলে যাও। আমার পক্ষ থেকে তুমি এখন আযাদ বা স্বাধীন।
বন্দীর প্রথম শুকরিয়াজ্ঞাপন
বন্দী লোকটি আকাশের দিকে চোখ তুলে বলল-
اَللهُمَّ لَكَ الْحَمْدُ
‘হে আল্লাহ! সব প্রশংসা তোমারই জন্য।’
এরপর সে কোনো কথা না বলে এমনকি সেনাপতিকেও ধন্যবাদ না জানিয়ে চলে গেল। তার চলে যাওয়া সেনাপতিকে আশ্চার্যান্বিত করল। কেননা সেনাপতি তাকে হাজ্জাজের হত্যা থেকে বাঁচাতে সর্বাত্মক চেষ্টা করল এবং সফল হলো অথচ বন্দী সেনাপতিকে কতৃজ্ঞতা জানালো না।
সেনাপতিকে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন
পরদিন বন্দী পুনরায় সেনাপতির কাছে ফিরে আসল এবং বলল-
يَا هَذَا! جَزَاكَ اللهُ عَنِّى أَفْضَلَ الْجَزَاءِ – وَاللهِ! مَا ذَهَبَ عَنِّى
أَمْسِ مَا صَنَعْتُ – وَلَكِنْ كَزِهْتُ أَنْ أُشْرِكَ فِى حَمْدِ اللهِ أَحَدًا
‘ভাই! আল্লাহ তোমাকে আমার পক্ষ থেকে উত্তম প্রতিদান দান করুন। আল্লাহর কসম! আমি গতকাল যাওয়ার সময় আল্লাহ তাআলার প্রশংসা আদায় করছিলাম এবং শুধু তারই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছিলাম। কিন্তু তোমার জন্য দোয়া করিনি। আমার তা মনে আছে।
এটাকে তুমি খারাপ মনে করো না। আমি তা এ জন্যই করেছি যে, আমি এমনটি পছন্দ করিনা যে- আল্লাহর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে অন্য কাউকে শরিক করি।’
এ হলো এক জন মুসলিম বন্দীর অঙ্গীকার পালন এবং শুকরিয়া আদায়ের ধরণ। যা মুসলিম উম্মাহর প্রত্যেকেরই আমানতদারিতা রক্ষা, ওয়াদা পালন এবং শুকরিয়া আদায়ের ধরণ এ রকম হওয়া জরুরি। তবেই আসবে দুনিয়া ও পরকালের সফলতা।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে ওয়াদাপালন এবং শুকরিয়া আদায়ে একনিষ্ঠ হওয়ার তাওফিক দান করুন। ইসলামের সোনালী অতিত থেকে শিক্ষা নেয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/জেআইএম