কুরবানিতে যেসব পশু জবাই করা বিশুদ্ধ ও উত্তম
কুরবানি, আত্মত্যাগের এক অনন্য ইবাদত। আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রত্যেক জাতির জন্যেই ছিল কুরবানির বিধান। আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কুরবানির বিধান দিয়েছি; যাতে আমি তাদেরকে জীবনোপকরণ স্বরূপ যে সব চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছি সেগুলোর ওপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।’ (সুরা হজ : আয়াত ৩৪)
আল্লাহ তাআলা বান্দাকে কুরবানির জন্য তার দেয়া চতুষ্পদ জন্তু তাঁরই নামে জবাইয়ের নির্দেশ দিয়েছেন। মানুষের এ কুরবানি বিশুদ্ধ ও উত্তম হওয়ার জন্য হাদিসের দিক নির্দেশনা অনুযায়ী কুরবানির পশু নির্বাচন করা জরুরি।
কুরবানির পশু যেন সেই শ্রেণি বা বয়সের হয় যে শ্রেণি ও বয়স ইসলামি শরিয়ত নির্ধারিত করেছে। ইসলামি বিধান মতে সর্বমোট ছয় ধরনের পশু দিয়ে কুরবানি করা যায়। আর তাহলো- উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা। এ পশুগুলোকে সুনির্দিষ্ট কিছু দোষ বা খুঁত থেকে মুক্ত থাকতে হবে। কুরবানির জন্য পশুগুলো অবশ্যই সুস্থ, সুন্দর ও পষ্টপুষ্ট হওয়া চাই।
অধিকাংশ আলেমদের মতে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট কুরবানি হল ‘উট’, অতঃপর ‘গরু’, তারপর ‘মেষ বা ভেড়া’, তারপর ‘ছাগল’। আবার নর মেষ (মহিষ) মাদা মেষ অপেক্ষা উত্তম।’
কুরবানির পশুর বয়স
ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিকোন থেকে কুরবানির পশুর বয়সের দিকেও বিশেষ খেয়াল রাখা জরুরি। যে ৬ ধরণের পশু দ্বারা কুরবানি করা যায়, সেগুলোর যথাযথ বয়স হতে হবে।
- উট
কুরবানির সময় উটের বয়স ৫ বছর হতে হবে। সহজে উট বা উষ্ট্রী পাওয়া গেলে তা যেন ৫ বছরের নিচে না হয়।
- গরু-মহিষ
কুরবানির সময় গরু বা মহিষের বয়স ২ বছর হতে হবে।
- ছাগল, ভেড়া, দুম্বা
কুরবানির জন্য ছাগল, ভেড়া ও দুম্বার পূর্ণ ১ বছর বয়সের হতে হবে।
উত্তম কুরবানির জন্য করণীয় : যদি কোনো ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা গত কুরবানির দিন জন্ম নেয়; সেই ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা এ বছর ঈদের দিন কুরবানি না করা বরং একদিন পর কুরবানির দ্বিতীয় দিন তা কুরবানি করা উত্তম। যাতে পশুর বয়স পূর্ণ হয়ে যায়। আর এভাবে কুরবানি করাই উত্তম। তেমনি অন্যান্য পশুর বেলায়ও একই মত।
আরও পড়ুন > যেসব পশু দিয়ে কুরবানি হবে না
তবে ব্যতিক্রম হলো-
যদি কোনো কুরবানির পশুর বয়স ৫, ২ ও ১ বছর না হয়; কিন্তু দেখতে ৫, ২ ও ১ বা তার চেয়েও বেশি বলে মনে হয়। অর্থাৎ দেখতে নাদুস-নুদুস, হৃষ্ট-পুষ্ট হয় তবে ওই পশু দিয়ে কুরবানি করা যাবে।
উত্তম কুরবানির জন্য পশুর পূর্ণ বয়স হতে হবে। হাদিসে পশুর বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে। একান্তই যদি উল্লেখিত বয়সের কোনো পশু পাওয়া না যায়; তবে সে ক্ষেত্রে করণীয়ও নির্ধারণ করা হয়েছে। হাদিসে এসেছে-
- হজরত জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা অবশ্যই মুসিন্না (নির্দিষ্ট বয়সের পশু) কুরবানি করবে। তবে তা তোমাদের জন্য দুষ্কর (পাওয়া কষ্টকর) হলে ছয় মাসের মেষশাবক কুরবানি করতে পারবে। (মুসলিম)
- হজরত জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা দুই বছরের কম বয়সী পশু কুরবানি করো না। কিন্তু যদি (তা সংগ্রহে) তোমাদের পক্ষে কঠিন হয় তখন তোমরা এক বছর বয়সী ভেড়া যবেহ করতে পার।’ (নাসাঈ)
- হজরত ওকবা ইবনে আমের রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবিদের মধ্যে কুরবানির পশু বন্টন করলেন। আমার অংশে একটি এক বছরের বকরী পড়লো। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমার অংশে একটি এক বছরের বকরী পড়েছে। তিনি বললেন, তুমি তা কুরবানি কর।’ (নাসাঈ)
- হজরত কুলাইব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমরা একবার সফরে ছিলাম, তখন কুরবানির ঈদ উপস্থিত হল। আমাদের একেক ব্যক্তি দু’টি বা তিনটি এক বছরের ভেড়ার পরিবর্তে একটি দু’বছরের বয়সের ভেড়া খরিদ করছিল।
তখন মুযায়না গোত্রের এক ব্যাক্তি বলল আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম –এর সঙ্গে এক সফরে ছিলাম। এমন সময় (কুরবানির) দিনটি উপস্থিত হলে এক ব্যাক্তি দু’টি বা তিনটি এক বছরের ভেড়ার পরিবর্তে একটি দু’বছরের ভেড়া তালাশ করছিল।
তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, বকরীর ক্ষেত্রে দু’বছর বয়সী দ্বারা যেভাবে কুরবানি আদায় হয়, তদ্রুপ এক বছর বয়সী দ্বারাও আদায় হয়ে যাবে।’ (নাসাঈ)
আরও পড়ুন > এবার হজের খুতবা দিবেন নতুন শায়খ বিচারপতি ড. হুসাইন
মনে রাখতে হবে
যেহেতু দিন-তারিখ নির্ণয় করে বয়সের ব্যাপার নিশ্চিত হওয়া কঠিন তাই আল্লাহ তাআলার অশেষ রহমত যে কুরবানিদাতার সুবিধার্থে এ বয়স পূর্ণ হওয়ার আলামত স্বরূপ দুটি দাঁত গজিয়ে দেন। কুরবানি বৈধ হওয়ার জন্য পশুর দুটি দাঁত গজিয়েছে কিনা তা দেখে নেয়া। এ দাঁতকে পশুর বয়স নির্ধারিণী দাঁত বলা হয়। এ দাঁতগুলো পশু কুরবানি দেয়ার উপযুক্ত হওয়ার আলামত বা চিহ্ন মাত্র।
বয়স পূর্ণ হলেও দাঁত কখনো কখনো নাও গজাতে পারে কিন্তু দাঁত গজালে বয়স পূর্ণ না হয়ে পারে না। একারণে দুটি দাঁত দেখা গেলে কুরবানির পশুর বয়স যে পূর্ণ হলো তার নিশ্চিত প্রমাণ মিলে। বিধায় দাঁত গজানো একটি জরুরী বিষয় হিসেবে সাব্যস্ত হয়েছে।
তবে অনেক পশুর বয়স হওয়া সত্ত্বেও দাঁত ওঠে না; সেক্ষেত্রে দাঁত শর্ত নয় বরং দাঁত দেখা যাক আর না যাক পশুর বয়স হলেই কুরবানি দেয়া। মূলত দাঁতের কথা হাদিসে উল্লেখ নেই; বয়সের কথাই হাদিসে বলা আছে। (তাফসিরে বাইজাবি)
ইসলামি শরিয়তের নীতিমালা হচ্ছে- কুরবানির ব্যাপারে পশুর সর্বনিম্ন যে বয়স হওয়া বাধ্যতামূলক তার এক ঘণ্টা কম হলেও কুরবানি সহিহ বা বিশুদ্ধ হবে না। তাই কুরবানির পশুর বয়স যথাযথ হওয়ার ব্যাপারে সর্বাধিক সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে বিশুদ্ধ ও উত্তম কুরবানি আদায়ের জন্য পশু নির্বাচনে উল্লেখিত বিষয়গুলো যথাযথভাবে খেয়াল রাখার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/পিআর