সত্যিকারের সৌন্দর্যের অধিকারী হজরত জুলায়বিব
হজরত জুলায়বিব রাদিয়াল্লাহু আনহু। প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একজন একনিষ্ঠ সাহাবি ছিলেন। জুলায়বিব শব্দের অর্থ হলো ‘ক্ষুদ্র পূর্ণতাপ্রাপ্ত’। এ ‘জুলায়বিব’ নাম দিয়ে মূলতঃ খর্বাকৃতি বুঝানো হতো। তিনি ছিলেন উচ্চাতায় অনেক ছোট। হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর সম্পর্কে বলেন, তিনি দেখতে কুশ্রীও ছিলেন।
প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বিবাহ করার কথা বললে তিনি নিজের কুশ্রী চেহারার দিকে ইঙ্গিত করতেন। তিনি বলতেন, ‘বিবাহের ক্ষেত্রে তো আমি অচল বা চাহিদাহীন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলতেন, হতে পারে, তবে তুমি আল্লাহর কাছে অচল নও।’ প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকে এর চেয়ে বড় ঘোষণা বা সাটিফিকেট আর কি হতে পারে?
হজরত জুলায়বিব রাদিয়াল্লাহু আনহু সম্পর্কে হজরত আবু বারযা আল-আসলামী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘তাঁর বিষয়টা এমন ছিল যে, তিনি মহিলাদের কাছ দিয়ে গেলে সেখান থেকে মহিলারা চলে যেত। (দেখতে ছোট ও কুশ্রী হওয়ার কারণে) তারা তাকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করত।
হজরত আবু বারযা আল-আসলামি বলেন, আমি আমার স্ত্রীকে বললাম, তোমরা জুলায়বিবকে তোমাদের কাছে প্রবেশ করতে দিও না। কেননা সে যদি তোমাদের নিকটে আসে, তাহ’লে অবশ্যই আমি (কিছু) করব, আমি অবশ্যই (কিছু) করব। তাকে নিজেদের ঘরে প্রবেশ করতে নিষেধ করেছিলেন। এমনকি কোনো মেয়ে হজরত জুলায়বিবকে বিবাহ করার কথা চিন্তাও করত না।
অথচ প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে খর্বাকৃতির সাহাবি হজরত জুলায়বিবের অবস্থান ছিল অনেক উপরে। তিনি এ সাহাবির প্রয়োজন সম্পর্কে খুবই সচেতন ছিলেন।
মুসনাদে আহমাদের বর্ণনায় হজরত আবু বারযা আল-আসলামী বলেন, ‘আনছার সাহাবিদের কারো মেয়ে থাকলে তারা ততক্ষণ পর্যন্ত বিবাহ দিতেন না; যতক্ষণ না এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতেন যে, আল্লাহর রাসুলের তাকে বিবাহ করার প্রয়োজন নেই।’
প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হজরত জুলায়বিবের বিবাহের বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করলেন। একদিন এক আনসারি সাহাবিকে বললেন, ‘আমি তোমার মেয়েকে বিবাহ দিতে চাই।’
আনসার সাহাবি প্রিয়নবির কথা শুনে অনেক খুশী হয়ে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! এটাতো অনেক বিস্ময়কর, সম্মান, আনন্দ ও চক্ষু শীতলকারী খবর।
প্রিয়নবি বললেন, ‘আমি নিজের জন্য প্রস্তাব দেইনি।’ এতে লোকটা (কিছুটা হতাশ হয়ে) জানতে চাইলেন, হে আল্লাহর রাসুল! তবে কার জন্য?
প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানালেন, সে হলো (হজরত) জুলায়বিব (রাদিয়াল্লাহু আনহু)’।
প্রিয়নবির প্রস্তাব শুনে আনসারি সাহাবি মনে একটা ধাক্কা খেলেন এবং নিচু স্বরে বললেন, ‘আমি এ ব্যাপারে আমার স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করব।’ লোকটি স্ত্রীর কাছে গিয়ে প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রস্তাবের কথা জানালেন। স্ত্রী এ কথা শুনেই স্বামীর মতো স্তব্ধ হয়ে গেলেন এবং বললেন, আল্লাহর শপথ! আমরা তাকে (নিজ মেয়েকে) তার (জুলায়বিবের) সঙ্গে বিবাহ দেব না।’ আনসারি সাহাবি তাদের পরামর্শের কথা প্রিয়নবিকে জানাতে উদ্যত হলেন।
এদিকে আনসারি সাহাবির মেয়ে আড়াল থেকে বাবা-মার কথাবার্তা শুনলেন। সে উদ্যত পিতার কাছে জানতে চাইলেন আমার বিয়ের ব্যাপারে কে প্রস্তাব দিয়েছে?
তার মা তাকে জানালেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজরত জুলায়বিবের সঙ্গে তাকে বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছেন।
মেয়েটি তার মায়ের কাছ থেকে জানলেন, প্রস্তাবটি প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দিয়েছেন আর তিনি সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন।
মেয়েটি তার মাকে বলল, ‘তোমরা কি আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করছ? বরং তোমরা আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে যাও। নিশ্চিয় তিনি আমার জন্য কল্যাণ ব্যতিত ধ্বংস ডেকে আনবেন না।
অন্য বর্ণনায় এসেছে, মায়ের কথা শুনে মেয়েটি বলল, আমি প্রিয়নবির এ প্রস্তাবের ব্যাপারে রাযী হ’লাম এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সম্মতির প্রতি আত্মসমর্পণ করলাম।
অতঃপর সে তার মা-বাবাকে সুরা আহজাবের ৩৬নং আয়াতটি তেলাওয়াত করে শুনালেন-
‘আর কোনো মুমিন পুরুষ বা নারীর জন্য উচিত নয় যে, যখন আল্লাহ ও তাঁর রাসুল কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তখন সে ব্যাপারে তাদের কোনো মতামত থাকে। আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে (নির্দেশকে) অমান্য করে, সে সুস্পষ্ট গোমরাহীতে নিমজ্জিত।’
অতঃপর তার পিতা মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে গিয়ে তার মেয়ের দৃঢ়তার কথা জানালেন এবং বললেন, আমার মেয়ের জন্য আপনি যা ভালো মনে করেন; তা-ই করুন।
প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়া সাল্লাম মেয়েটির মতামত শুনে তাঁর জন্য দোয়া করলেন-
اللَّهُمَّ صُبَّ عَلَيْهَا الْخَيْرَ صبًّا وَلاَ تَجْعَلْ عَيْشَهَا كَدًّا كَدًّا
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা ছুব্বা আলাইহাল খাইরা ছুব্বা; ওয়া লা তাঝআল আইশাহা কাদ্দা কাদ্দা।’
অর্থ : ‘হে আল্লাহ! তুমি তার প্রতি কল্যাণ নাজিল কর আর তার সংসার জীবন কষ্টদায়ক কর না।’
অতঃপর প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আনসারি সাহাবির মেয়েকে হজরত জুলায়বিব রাদিয়াল্লাহু আনহুর সঙ্গে বিবাহ দিয়ে দেন।
বিবাহের কিছুদিন পর প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোনো এক যুদ্ধে বের হন। আল্লাহ তাআলা যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয় দান করেন। প্রিয়নবি সাহাবিদের বললেন, ‘তোমরা কি কাউকে হারিয়েছ? সাহাবিগণ বললেন, ‘না’, আমরা কাউকে হারাইনি।
প্রিয়নবি বললেন, ‘কিন্তু আমি তো (হজরত) জুলায়বিবকে দেখতে পাচ্ছি না। তোমরা তাঁকে নিহতদের মাঝে খোঁজ কর।
সাহাবায়ে কেরাম খুঁজতে খুঁজতে তাঁকে সাতটি মৃতদেহের পাশে তার মৃতদেহটি পেলেন। অর্থাৎ তিনি তাদের সাতজনকে হত্যা করে নিজে শাহাদত বরণ করেছেন।
সাহাবায়ে কেরাম প্রিয়নবির কাছে এসে সব ঘটনা খুলে বললেন। সংবাদ শুনে প্রিয়নবি সেখানে গেলেন এবং বললেন এ ছোট্ট জুলায়বিব সাত জনকে হত্যা করেছে। অতপর সে শাহাদাত বরণ করেছে। জেনে রেখো! (আল্লাহর আনুগত্যের ক্ষেত্রে) ‘সে আমারই মত আর আমিও তার মত’ এ কথাটি তিনি ৩বার বলেছেন। (মুসলিম)
অতঃপর প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজরত জুলায়বিবকে নিজ কাঁধে বহন করে যথাস্থানে নিয়ে আসলেন। নিজেই তাঁর কবর খনন করে তাকে নিজ হাতে দাফন করেন।
হজরত ছাবেত রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘তখন আনছারদের বিধবাদের মধ্যে ঐ মেয়েটির (হজরত জুলায়বিবের স্ত্রীর) চেয়ে অধিক সম্পদশীলা ও দানশীলা আর কেউ ছিল না।’ (মুসনাদে আহমদ, মুসলিম, ইবনে হিব্বান)
এ ঘটনার শিক্ষা
মানুষ আল্লাহ ও তার রাসুলের কাছে বাহ্যিক অবায়ব ও সৌন্দর্য দিয়ে সম্মানের পাত্র হতে পারেন না। বরং আল্লাহ ও প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রিয়পাত্র হতে হলে প্রয়োজন- সততা, নিষ্ঠা, ঈমান-আমল ও যথাযথ আনুগত্য। সমাজে খর্বাকৃতির কুশ্রী সাহাবি হজরত জুলায়বিবই তার প্রমাণ।
তিনি সমাজে ছিলেন অবহেলিত, নিগৃহীত ও নিম্ন শ্রেণীর মানুষ। কিন্তু তাঁর সততা, নিষ্ঠা, ঈমান-আমল ও আনুগত্যের কারণে আল্লাহ ও তার রাসুলের কাছে অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন। ইসলামের দৃষ্টিতে তিনি ছিলেন অনেক মর্যাদার অধিকারী।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক জীবন-যাপন করে সততা, নিষ্ঠা ও আনুগত্য পূর্ণ জীবন গড়ে তোলার তাওফিক দান করুন। হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/পিআর