অভাব ও দারিদ্র্য দূরীকরণে ইসলামের নির্দেশনা
আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য দূরীকরণ দিবস আজ। প্রতি বছরই ১৭ অক্টোবরকে দারিদ্র দূরীকারণে জনসচেতনা সৃষ্টির লক্ষ্যে এ দিবসটি যথাযোগ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে পালন করা হয়।
মানুষের মাঝে অভাব দূরকরণের জন্য সচেতনা বৃদ্ধির লক্ষে ১৯৯২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রস্তাবের পর ১৯৯৩ সাল থেকে প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী ১৭ অক্টোবরকে আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য দূরীকরণ দিবস হিসেবে পালন করে আসছে।
প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দারিদ্র্য দূরীকরণে মানুষকে কর্মের প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছেনে। যা কবি শেখ হাবিবুর রহমানের ‘নবীর শিক্ষা’ কবিতায় ফুটে ওঠেছে। কবি তাঁর ছন্দে বলেন-
তিন দিন হতে খাইতে না পাই, নাই কিছু মোর ঘরে,
দারা পরিবার বাড়িতে আমার উপোস করিয়া মরে।
নাহি পাই কাজ, তাই ত্যাজি লাজ বেড়াই ভিক্ষা করি,
হে দয়াল নবী, দাও কিছু মোরে নহিলে পরাণে মরি।'
আরবের নবী, করুণার ছবি ভিখারির পানে চাহি,
কোমল কণ্ঠে কহিল, ‘তোমার ঘরে কি কিছুই নাহি?'
বলিল সে, 'আছে শুধু মোর কম্বল একখানি।'
কহিল রসুল, 'এক্ষণি গিয়া দাও তাহা মোরে আনি।'
সম্বল তার কম্বলখানি বেচিয়া তাহার করে,
অর্ধেক দাম দিলেন রসুল খাদ্য কেনার তরে,
বাকি টাকা দিয়া কিনিয়া কুঠার, হাতল লাগায়ে নিজে,
কহিলেন, 'যাও কাঠ কেটে খাও, দেখ খোদা করে কি-যে।'
সেদিন হইতে শ্রম সাধনায় ঢালিল ভিখারি প্রাণ,
বনের কাষ্ঠ বাজারে বেচিয়া দিন করে গুজরান।
অভাব তাহার রহিল না আর, হইল সে সুখী ভবে,
নবীর শিক্ষা ক'রো না ভিক্ষা, মেহনত কর সবে।
প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানুষকে ক্ষুধার যন্ত্রণা ও অভাব থেকে বেঁচে থাকতে কার্মমূখী হওয়ার উপদেশ ও উৎসাহ প্রদান করেছেন।
আল্লাহ তাআলা মানুষকে জীবিকা দান করেন। তিনি মানুষকে জীবিকা অন্বেষনের দিক-নির্দেশনা প্রদান করেছেন। জীবিকা উপার্জনের জন্য মানুষকে দান করেছেন জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিবেক-বিবেচনা ও নির্দেশ।
আবার অনেককেই দান করেছেন অঢেল সম্পদ আবার অনেককে করেছেন নিঃস্ব। আর সম্পদশালীর সম্পদে রয়েছে অসহায় ও নিঃস্ব ব্যক্তির জীবিকা। এটা মহান আল্লাহর এক মহাপরিকল্পনা ও পরীক্ষা।
তবে সম্পদহীন ব্যক্তি তাকওয়ার অর্থে দারিদ্র্য নয়। কারণ যে ব্যক্তি পৃথিবীতে নীতিহারা, নৈতিক চরিত্রহীন; সে-ই হচ্ছে সবচেয়ে বড় দারিদ্র্য।
আবার দ্বীন, ঈমান ও আদর্শ থেকে বিচ্যুতির ফলে আল্লাহ তাআলা মানুষকে অভাব ও দারিদ্র্যতায় নিপতিত করে পরীক্ষা করেন।
তবে সাধারণ অর্থে আমরা মানুষের দৈনন্দিন জীবনে বেঁচে থাকার জন্য মৌলিক মানবাধিকার খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের অভাব; বিশেষ করে প্রতিদিনের খাদ্যের অভাবকেই দারিদ্র্য হিসেবে জানি।
পরিকল্পনা কমিশনের তথ্য মতে, বর্তমান বাংলাদেশের ৪ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। আর চরম দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করছে প্রায় ২ কোটি মানুষ।
দারিদ্র্যতার প্রশ্নে বিশ্বব্যাংক বলছে ভিন্ন কথা। তাদের মতে, ‘দৈনিক কোনো মানুষ যদি গড়ে ১ থেকে দেড় ডলার পর্যন্ত আয় করে তবে তাকে দারিদ্র্যের তালিকায় রাখা হয়।’
অভাব ও দারিদ্র্যতা দূরীকরণে যে যাই বলুক না কেন, ইসলাম দিয়েছে দারিদ্র্য দূরীকরণের সুস্পষ্ট সমাধান ও দিক-নির্দেশনা। যা মানুষকে অভাব ও দারিদ্র্যতার মুলচ্ছেদ করে দুর্নীতি ও অশান্তিমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের পথ দেখিয়েছেন।
দারিদ্র্য দূরীকরণে কুরআনের নির্দেশনা
অভাব ও দারিদ্র্য দূরীকরণে আল্লাহ তাআলা মানুষকে যে সব নির্দেশ ও নসিহত পেশ করেছেন তাহলো-
>> ‘তিনি পৃথিবীতে তোমাদেরকে প্রতিনিধি করেছেন, কারো চেয়ে কারো মর্যাদা উন্নত করেছেন (বিভিন্ন বিষয়)। উদ্দেশ্য হলো যা (সম্পদ) দিয়েছেন সে বিষয়ে পরীক্ষা করা।’ (সূরা আনআম : আয়াত ১৬৪)
>> ‘আমরা দুনিয়াতে তাদের মধ্যে জীবিকা সামগ্রী বণ্টন করি যাতে তারা একে অপরকে সেবকরূপে গ্রহণ করে।’ (সূরা যুখরুখ : আয়াত ৩২)
>> ‘(হে নবী) বলুন, আমার রব যাকে ইচ্ছা রিজিকের প্রশস্ততা দেন যাকে ইচ্ছা সংকীর্ণতা দেন। কিন্তু অধিকাংশ লোকই এ ব্যাপারে অজ্ঞ।’ (সূরা সাবা : আয়াত ৩৬)
>> ‘মানুষকে দুর্বলমনা করে সৃষ্টি করা হয়েছে। বিপদ স্পর্শ করলে সে ঘাবড়ে যায়। আর স্বাচ্ছন্দ্য আসলে কার্পণ্য শুরু করে।’ (সূরা মাআরিজ : আয়াত ১৯-২১)
দারিদ্র্য দূরীকরণে হাদিসের নির্দেশনা
জান্নাতিদের অধিকাংশই গরীব ও দুর্বল। আর জাহান্নামীদের অধিকাংশই ধনী, প্রতাপশালী ও নারী। তাই বলে জান্নাতি হওয়ার জন্য যেমন দরিদ্র্য থাকার নির্দেশ দেয়া হয়নি তেমনি জাহান্নামী হওয়ার জন্য ধনী, ক্ষমতাশালী কিংবা নারীদের নারিত্বকে দায়ী করা হয়নি। দারিদ্র্য দূরীকরণে হাদিসের শিক্ষা হলো-
>> ‘দারিদ্র্য অনেক সমস্যার অন্যতম এবং জীবিকার প্রাচুর্যও অনেক নিয়ামতের অন্যতম। ব্যক্তি, সময় ও স্থানভেদে দরিদ্র ও প্রাচুর্য আনা আল্লাহর কৌশলেরই বৈচিত্র্য ও স্থায়ী নীতি।’
>> ‘প্রত্যেকে আল্লাহ নির্ধারিত অবস্থানে থেকে আনুগত্যের পরীক্ষা দিচ্ছে। অভাব বা সচ্ছলতা নয় বরং ব্যক্তির মানসিকতাই অবাধ্যের কারণ। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অভাব ও প্রাচুর্যের ব্যাপারে আল্লাহর কাছে পানাহ চাইতেন।’ (দাউদ শরীফ)
পরিশেষে...
সমাজের দারিদ্র্যতা দূরীকরণে আল্লাহ তাআলা ধনীর সম্পদের সুষম বণ্টন তথা জাকাত ভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার নির্দেশ প্রদান করেছেন। জাকাত ব্যবস্থার যথাযথ বাস্তবায়নে সমাজ থেকে অভাব ও দারিদ্র্য দূর হবে।
পাশাপাশি মানুষকে অলসতা ও বেকারত্বের অভিশাপ থেকে বের হয়ে কর্মমুখী হতে হবে। হালাল জীবিকা নির্বাহে আল্লাহ তাআলার সাহায্য একান্ত জরুরি।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে অভাব ও দারিদ্র্যতার কষাঘাত থেকে হেফাজত করুন। কুরআন সুন্নাহ মোতাবেক কর্মমূখী জীবন পরিচালনা করে অভাবমুক্ত জীবন গঠন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/পিআর