ভিডিও EN
  1. Home/
  2. প্রবাস

টেনিসের এক যুগের সমাপ্তি, আরেক যুগের প্রতীক্ষা

রহমান মৃধা | প্রকাশিত: ০৮:৩৩ এএম, ৩০ নভেম্বর ২০২৪

টেনিস ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায় যেন শেষ হয়ে এলো। প্রথমে বিদায় নিয়েছিলেন রজার ফেদেরার, তার কিছুদিন পর ডেভিস কাপ থেকে গ্র্যান্ড নাদালও তার বিদায় জানালেন। আর সামনে হয়ত কোনো একদিন নোভাক জোকোভিচও তার অবসরের ঘোষণা দেবেন। কিন্তু এই তিন মহাতারকা টেনিস জগতের জন্য যা রেখে গেছেন, তা কেবল পরিসংখ্যান নয়—এটি আবেগ, ভালোবাসা আর প্রতিযোগিতার এক অমর কাব্য।

রজার ফেদেরারের বিদায়: এক স্মরণীয় অধ্যায়ের সমাপ্তি;

টেনিসের ইতিহাসে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরের সেই দিনটি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। লন্ডনের ল্যাভার কাপের মঞ্চে যখন রজার ফেদেরার তার বিদায়ের ঘোষণা দিলেন, তখন কেবল একটি ক্যারিয়ারের সমাপ্তি হয়নি—সমাপ্তি হয়েছিল এক স্বর্ণযুগের। তার অবসর মুহূর্তটি ছিল আবেগঘন, বেদনাবিধুর। প্রতিদ্বন্দ্বী রাফায়েল নাদালের চোখে অশ্রু আর নোভাক জোকোভিচের গভীর শ্রদ্ধা যেন প্রমাণ করছিল, ফেদেরার কেবল একজন খেলোয়াড় নন; তিনি টেনিসের কবি। তার প্রতিটি শট ছিল শিল্পের মতন, যা দর্শকদের মুগ্ধ করত। এই বিদায় তার অসাধারণ ক্যারিয়ারের শেষ দৃশ্য হলেও, টেনিসপ্রেমীদের হৃদয়ে রজার চিরকাল জীবন্ত থাকবেন।

এক মহাকাব্যের সূচনা;

শৈশবে আমার একটি স্বপ্ন ছিল—সুইডেনে পড়াশোনা করার। সেই দেশ, যা নোবেল পুরস্কার প্রদানের জন্য বিশ্বখ্যাত এবং শিল্প ও প্রযুক্তিতে যার অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। ১৯৮৫ সালে, আমি সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিই। বাংলাদেশ থেকে অতিথি ছাত্র হিসেবে সুইডেনে আসি। পড়াশোনা শেষে একটি আন্তর্জাতিক ওষুধ কোম্পানিতে কাজ শুরু করি। সেখানেই ১৯৯৩ সালে আমার জীবনসঙ্গী মারিয়া বার্সেলোর সঙ্গে পরিচয় হয়। ১৯৯৫ সালের ৮ এপ্রিল আমাদের প্রথম সন্তান, জোনাথান মৃধা, পৃথিবীতে আসে। আমাদের জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছিল ২০০০ সালে হঠাৎ আমাদের ছেলে যখন টেনিস খেলতে শুরু করল তখন টেনিসের জগতে আমিও ঢুকে গেলাম।

সুইডেনের ক্রীড়াক্ষেত্র সম্পর্কে আমার আগ্রহ আগে থেকেই ছিল। বিজর্ন বর্গ এবং স্টেফান এডবার্গের মতো কিংবদন্তি টেনিস খেলোয়াড়ের নাম সুইডেনকে বিশ্বমঞ্চে পরিচিতি দিয়েছে। তবে আমার বিস্ময় তখনই বাড়ল, যখন একদিন পত্রিকায় আমার ছেলের একটি বড় প্রতিবেদন দেখলাম। শিরোনাম ছিল: ‘আমি উইম্বলডনে খেলব।’

জনাথান ছয় বছর ছয় মাস বয়সে টেনিস খেলা শুরু করে এবং মাত্র দশ বছর বয়সেই সে একজন প্রতিভাবান খেলোয়াড় হয়ে ওঠে। জাতীয় পর্যায়ে সে একাধিক সুইডিশ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছে এবং সবখানে তার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছে।
তার জুনিয়র ক্যারিয়ারে, জনাথান সুইডেনের প্রতিনিধিত্ব করে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে দলগত ও ব্যক্তিগতভাবে খেলেছে। পরে, সিনিয়র খেলোয়াড় হিসেবে সে ডেভিস কাপ এবং ATP ট্যুরে অংশগ্রহণ করেছে।

এটাও একটা কারণ টেনিসের সঙ্গে যুক্ত হওয়া এবং সেই থেকে জানতে শুরু করলাম নতুন পুরোনো সকলের নাম, এ সময়টিতে টেনিস জগৎ তখন শাসন করছিলেন রজার ফেদেরার। পিট সাম্প্রাসের পর টেনিসের সিংহাসনে একক আধিপত্য ছিল তার। প্রতিটি ম্যাচে তার শৈল্পিক দক্ষতা আর মাধুর্য আমাদের বিমোহিত করত। তবে ক্লে কোর্টে সেই আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাতেন এক তরুণ স্প্যানিয়ার্ড—রাফায়েল নাদাল।

ফেদেরার-নাদালের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল মহাকাব্যের মতো। নাদাল ছিলেন বিদ্যুতের মতো শক্তিশালী, যিনি ক্লে কোর্টে অপ্রতিরোধ্য। তাদের দ্বৈরথ শুধু কোর্টেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এটি আমাদের বিশ্ব চায়ের আড্ডায় তর্কের ঝড় তুলত—কে সেরা? ফেদেরার নাকি নাদাল?

এই মধুর দ্বৈরথে যোগ দিলেন আরেক কিংবদন্তি, নোভাক জোকোভিচ। সার্বিয়ার এই তারকা তার অসাধারণ দক্ষতা ও লড়াই করার মানসিকতা দিয়ে এই তিনজনের লড়াইকে নতুন মাত্রা দিলেন। এই তিন মহাতারকার লড়াই আমাদের জন্য হয়ে উঠেছিল টেনিসের স্বপ্নময় যুগ।

নক্ষত্রদের বিদায়;

রজার ফেদেরারের বিদায়ের পর, কিছুদিন আগে ডেভিস কাপ থেকে বিদায় নিলেন রাফায়েল নাদাল। তার বিদায় শুধু একটি ক্যারিয়ারের ইতি নয়; এটি ছিল এক আবেগঘন মুহূর্ত, যখন টেনিসপ্রেমীরা একটি স্বপ্নের যুগের শেষ দেখল। নাদালের অবদান শুধুই তার ২২টি গ্র্যান্ড স্লাম জয়ের জন্য নয়, বরং তার লড়াকু মানসিকতা, অদম্য গতি, আর প্রতিটি মুহূর্তে আত্মনিবেদন তাকে অনন্য করেছে।

কোর্টে তার প্রতিটি পা ফেলা ছিল শক্তি আর সংযমের এক অনন্য মিশ্রণ। তার চিরচেনা ট্রফিতে কামড় দিয়ে উদযাপন করা আইকনিক মুহূর্ত টেনিসপ্রেমীদের মনে চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে। নাদাল আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে শারীরিক ও মানসিক বাধা অতিক্রম করে নিজেকে শীর্ষে নিয়ে যাওয়া যায়। টেনিস তাকে মিস করবে, কিন্তু তার রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার চিরকাল জ্বলজ্বল করবে।

ভবিষ্যতের কাণ্ডারি: নোভাক জোকোভিচ;

আজকের টেনিসের মঞ্চে এখন কাণ্ডারি হিসেবে রয়ে গেছেন নোভাক জোকোভিচ। ২৪টি গ্র্যান্ড স্লাম জয় করে তিনি এরই মধ্যে নিজেকে টেনিস ইতিহাসের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কিন্তু তিনি শুধু রেকর্ড গড়ার খেলোয়াড় নন। তার নেতৃত্ব, শৃঙ্খলা, আর নতুন প্রজন্মকে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা তাকে আরও অনন্য করে তুলেছে।
জোকোভিচের প্রতিটি ম্যাচ আমাদের দেখায় কীভাবে দৃঢ়তা এবং আত্মবিশ্বাস দিয়ে শীর্ষে পৌঁছানো যায়। তার নেতৃত্বে আমরা এমন একটি টেনিস ভবিষ্যৎ আশা করতে পারি যেখানে প্রতিভা এবং মানবিকতার এক অসাধারণ সংমিশ্রণ থাকবে।

সো মাস্ট গো অন;

ফেদেরার আর নাদালের বিদায়ের পরও টেনিসের যাত্রা থেমে থাকবে না। সময় এগিয়ে চলবে, নতুন তারকারা আসবে, নতুন গল্প লেখা হবে। কিন্তু এই তিন মহাতারকার যুগ চিরকাল আমাদের হৃদয়ে থাকবে। জীবনের মতোই টেনিসও আমাদের শিখিয়েছে—“Everything is impossible until someone makes it happen.” তাই আমরা আশা করব, ভবিষ্যতেও এমন খেলোয়াড় আসবে যারা এই গল্পকে আরও সমৃদ্ধ করবে।

আমরা ভাগ্যবান যে, আমরা একসঙ্গে এই তিন কিংবদন্তির লড়াই দেখতে পেরেছি। তাদের প্রতিটি মুহূর্ত আমাদের জীবনের স্মৃতিতে চিরসবুজ হয়ে থাকবে। সো মাস্ট গো অন, কারণ প্রতিটি সূর্যাস্তের পরেই একটি নতুন ভোর আসে। টেনিস, তুমি ছিলে আমাদের প্রথম প্রেম, আর চিরকালই থাকবে। কারণ মেয়ে আমাদের টেনিসের জগতে ছিল তার পুরো দুনয়র সময়টিতে, মাতিয়ে তুলেছিল গোটা বিশ্ব তারপরও হঠাৎ থেমে গেল তার মটিভেশন কিন্তু ছেলে জনাথান এখনও হাল ছাড়েনি, যদিও ইনজুরি বারবার তার সাফল্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তবুও সে কখনো হাল ছাড়েনি। এখনো সে লড়ে চলছে, কারণ সে বিশ্বাস করে—যতক্ষণ লড়াই চালিয়ে যাওয়া যায়, ততক্ষণ কিছুই অসম্ভব নয়। এবং আমি তার সেই বিশ্বাসে পুরোপুরি আস্থাশীল।

অবশেষে বলতে চাই, স্বপ্ন পূরণ সম্ভব যদি সত্যিই ইচ্ছা থাকে। আপনি অভিবাসী হোন বা সুইডিশ, সেটি কোনো বাধা নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—নিজের ইচ্ছাশক্তি, কঠোর পরিশ্রম এবং নিজের প্রতি বিশ্বাস। কারণ স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়া সম্ভব, যদি আমরা সাহস নিয়ে এগিয়ে যাই।

রহমান মৃধা
সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
[email protected]

এমআরএম/এমএস