মালয়েশিয়ায় স্টুডেন্ট ভিসায় বাড়ছে মানবপাচার : সক্রিয় দালাল চক্র
রমরমা চলছে স্টুডেন্ট ভিসায় মালয়েশিয়ায় মানবপাচার। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্টুডেন্ট ভিসায় এই পাচারের অবস্থা ২৪ মাসের মধ্যেই নৌকায় মানবপাচারের মতো পরিস্থিতিতে গিয়ে দাঁড়াবে। পার্ট টাইম চাকরির প্রলোভনে মালয়েশিয়া আসা বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের দিন কাটছে অর্ধাহারে অনাহারে। অনেকেরই ঠিকানা হয়েছে মালয়েশিয়ার ডিটেনশন ক্যাম্পে।
মালয়েশিয়ার অলিতে-গলিতে ব্যাঙের ছাতার মতোই গড়ে উঠেছে অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও ইনস্টিটিউশন। যেগুলো থেকে বাংলাদেশি দালালরা স্টুডেন্ট ভিসা বের করে। দেশ থেকে শিক্ষার্থীর নামে শ্রমিক পাঠায়। মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশি দালালদের এই সিন্ডিকেট এসব শ্রমিকের শিক্ষাগত যোগ্যতার ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে। আবার অনেক সময় সত্যিকারের শিক্ষার্থীরাও এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে কূল হারায়।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, দেশের বেকার যুবকদের প্রলোভন দেখিয়ে শিক্ষার্থী ক্যাটাগরিতে মালয়েশিয়ায় নিয়ে যায় দালালরা। পার্ট টাইম চাকরি, ৪০/৫০ হাজার টাকা ইনকাম ইত্যাদি..ইত্যাদি। গত এক সপ্তাহে মালয়েশিয়ায় এ ধরনের বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, নৌকায় বসে থাকা অভুক্ত মানুষদের মতোই হয়ে উঠেছে এসব কলেজের ভিসা প্রসেসিং সেন্টারগুলো।
গত ২৭ এপ্রিল কুয়ালালামপুরের বাতুলিমায় ভিক্টোরিয়া ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি কলেজে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে ফুটপাথ থেকে শুরু করে কলেজের ভিসা সেন্টারে শতাধিক শিক্ষার্থী। এদের ৯০ শতাংশই বাংলাদেশি। কোটার তুলনায় অতিরিক্ত বিদেশি শিক্ষার্থীকে ভিসা দেয়ায় গত বছরের মে মাসে ব্ল্যাকলিস্টেড করা হয় কলেজটিকে। মূলত স্টুডেন্ট ভিসায় শ্রমিক আনে কলেজটি।
একটি সূত্রে জানা যায়, প্রতিদিন গড়ে ৩০ থেকে ৩৫ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী আসে কলেজটিতে। আর পাচারের ব্যবসা রমরমা হওয়ায় এখন কলেজে আর নামকাওয়াস্তে ক্লাসও হয় না। এ কলেজে সব মিলিয়ে প্রায় ৫ হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ও শ্রমিক স্টুডেন্ট ভিসায় রয়েছে বলে ধারণা দিয়েছে শিক্ষার্থীরা।
এ দিকে কোটার অতিরিক্ত বিদেশি শিক্ষার্থী মালয়েশিয়ায় নেয়ার অপরাধে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে কয়েকটি কলেজ-ইউনিভার্সিটিকে। তন্মধ্যে লিংকন ইউনিভার্সিটি হচ্ছে অন্যতম। ২০১৫ সালে এই প্রতিষ্ঠানটিকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। কিন্তু আবারো নতুন করে ঢাকা থেকে শিক্ষার্থী নেয়ার কোটা চালুর জোর প্রচেষ্টা শুরু করেছে ভিসা ব্যবসার এই কথিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
কলেজ সূত্রে জানা গেছে, মালয়েশিয়ার শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বিদেশি শিক্ষার্থী নিতে পুনরায় কেডিএন অনুমোদন পাওয়ার জন্য বেশ তোড়জোড় শুরু করেছে লিংকন ইউনিভার্সিটি। বর্তমানে ক্লাসে উপস্থিত না থাকলেও সপ্তাহে ১ বা ২ দিন গিয়ে স্বাক্ষর করে আসতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। কার্যত ক্লাস করার মতো কক্ষই নেই তাদের।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৫ সালের প্রথম তিন মাসে প্রায় দুই হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর ফাইল আটকা পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে। এমন পরিস্থিতিতে ২০১৬ সালের শুরু থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়টি কালো তালিকা থেকে মুক্ত হচ্ছে বলে বিভিন্ন দেশে প্রচারণা চালিয়ে আসছে চিহ্নিত কিছু এজেন্ট।
যদিও ইউনিভার্সিটি সূত্র জানিয়েছে, এ বছরও কালো তালিকাভুক্ত থাকছে প্রতিষ্ঠানটি। তাই এই প্রতিষ্ঠানের নামে কেউ ভিসার লোভ দেখালে সেটি প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ বছর না হলে ২০১৭ সালের শুরু থেকে আবারো বাংলাদেশি শিক্ষার্থী আনার বৈধতা প্রাপ্তির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে লিংকন ইউনিভার্সিটি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মূলত শিক্ষার্থীর নামে শ্রমিক আনার কাজে ব্যবহৃত হয় বিশ্ববিদ্যালয়টি। বাংলাদেশ থেকে গত কয়েক বছর ধরে মালয়েশিয়ায় শিক্ষার্থীর নামে শ্রমিক পাঠানোর এজেন্টদের প্রথম পছন্দের তালিকায় ছিল লিংকন ইউনিভার্সিটি। ভুয়া সার্টিফিকেট, কাগজপত্র জমা দিয়েও ভর্তি করানো হয় এখানে। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মালয়েশিয়ায় এলেও অনেক শিক্ষার্থী কখনোই এর ক্যাম্পাসে পা রাখেন না। চলতি বছরের এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহেও এই কলেজের ভিসা নিয়ে কাজ করতে যাওয়া প্রায় ২০ জন শিক্ষার্থী মালয়েশিয়ার বিভিন্ন স্থানে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন।
প্রতারণার শিকার বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ দমনে ইতিমধ্যে কলেজটিতে দেয়া হয়েছে বাংলাদেশি এক ছাত্রসংগঠনের কমিটি। ওই কমিটির নেতা হয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের দমিয়ে রাখছে সুবিধালোভীরা।
সরেজমিনে দেখা যায়, কেলানা জায়া এলআরটির পাশে সেলাঙ্গরে পেটালিং জায়ায় মায়াং প্লাজায় একটি ফ্লোরে গড়ে উঠেছে লিংকন ইউনিভার্সিটি। সেখানেই কয়েকটি লোক দেখানো ক্লাসরুম আর অফিস নিয়ে চলছে জমজমাট শিক্ষার্থী ব্যবসা। কলেজটিতে ক্লাস রুম না থাকলেও রয়েছে বড় পরিসরে ভিসা সেন্টার। ক্লাসরুমে শুধু স্বাক্ষর করেই চলে যান শিক্ষার্থীরা। বেরিয়ে পড়েন কাজে। শুধু শ্রমিক নন, এজেন্টদের প্রতারণার শিকার হয়ে অনেক শিক্ষার্থীও এই নামকাওয়াস্তে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে রয়েছেন ঝুঁকিতে।
বাংলাদেশের একজন শিক্ষার্থী এই প্রতিবেদকের কাছে বলেন, শিক্ষার্থী না এলেও এখনো বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের নিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছে কলেজটি। কারণ প্রতি সেমিস্টারে আমাদের পুনঃভিসা নবায়নের জন্যে ৬ থেকে ৭ হাজার রিঙ্গিত করে খরচ দিতে হচ্ছে। লিংকন ইউনিভার্সিটির জুনায়েদ আহমেদের বাড়ি নরসিংদী। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, পড়াশোনার পাশাপাশি পার্ট টাইম চাকরি করে সংসারে সাহায্য করার আশায় মালয়েশিয়া আসি। তবে এখানে এসে কাজ জোটে নির্মাণ প্রকল্পে। ভারী ভারী সব কংক্রিটের খণ্ড আর রড-সিমেন্ট বইতে হচ্ছে এখন।
শ্রমিকদের সঙ্গে কাজ করে এখন মাসে ৮০০ থেকে ৯০০ রিঙ্গিত আয় করতে পারেন তিনি। এরমধ্যেই মাসে ৪০০ রিঙ্গিত করে জমা করতে হতো। কারণ বছর শেষে সাড়ে ৪ হাজার রিঙ্গিত দিয়ে ভিসা নবায়ন করতে কলেজকে টাকা দিতে হয়। মাসে ৫০০ থেকে ৬০০ রিঙ্গিতে বাসা ভাড়া, খাবারের খরচ আর হাত খরচ দিয়ে আর বাড়িতে টাকা পাঠানোর স্বপ্ন বাস্তবে রূপ লাভ করেনি। নিজের উপার্জিত অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়কে দিতে মন চায়নি। তাই একসময় ইচ্ছে করেই আর ভিসা নবায়ন না করে জুনায়েদ অবৈধ হয়ে পড়েন।
মালয়েশিয়ায় এখন জুনায়েদের মতো অবৈধ শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক বিশাল। শুধু দেশের ভাবমূর্তিই বিলীন নয়, প্রবাসে এসব শিক্ষার্থীদের একসময় জেলে বন্দি হতে হচ্ছে। শুধু লিংকনই নয়, মেলভার্ন কলেজ, লাইফ কলেজ, অ্যাডাম কলেজ, টিএমসি কলেজ, এফটিএমএস কলেজ, কলেজ গেমিলাং, অপটিমাস কলেজসহ বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এ ধরনের মানবপাচারে জড়িত রয়েছে বলে চিহ্নিত করেছে মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এসব কলেজের অধীনে স্টুডেন্ট ভিসায় কাজ করতে এসে বর্তমানে জেলে রয়েছেন অনেক বাংলাদেশি। কারণ মালয়েশিয়া সরকারের আইন অনুযায়ী স্নাতক বা ডিপ্লোমা কোর্সের শিক্ষার্থীদের কাজের অনুমতি নেই। স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের সপ্তাহে ২০ ঘণ্টা কাজের অনুমতি দেয়া হয় শর্ত সাপেক্ষে।
মঙ্গলবার (৩ মে) মালয়েশিয়ায় বসবাসরত কয়েকজন প্রবসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিদিনই মালয়েশিয়ায় বিভিন্ন স্থানে কাজ করতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ছেন শিক্ষার্থী ও স্টুডেন্ট ভিসায় আসা শ্রমিকরা।
এ বিষয়ে প্রকৌশলী আমিনুল ইসলাম খোকন এ প্রতিবেদককে বলেন, বাংলাদেশ থেকে স্টুডেন্ট ভিসায় শ্রমিক এবং পার্ট টাইম চাকরির লোভে শিক্ষার্থীরা আসছেন এবং ধোকা খাচ্ছেন। বছর দু`য়েকের মধ্যেই এই স্টুডেন্ট ভিসায় আসা লোকদের অবস্থা নৌকায় পাচারকারীদের মতোই হয়েছে। টাকার অভাবে অনেকে ভিসা রিনিউ করতে পারছেন না। এখনই সময় স্টুডেন্ট ভিসায় শ্রমিক আসা বন্ধ করতে হবে। নতুবা পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ।
খোকন আরো বলেন, শুধু পার্ট টাইম বা ফুল টাইম চাকরির প্রলভন নয়, নৌকায় আসা মানুষদের মতোই স্টুডেন্ট ভিসায় আসা লোকদেরও কিডন্যাপ করা হচ্ছে। এয়ারপোর্ট থেকে নামার পরেই তাদের পাসপোর্ট কেড়ে নেয়া হয়। গাড়িতে উঠিয়ে গহীন অরণ্যের গোডাউনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেখান থেকে মুক্তিপণ নিয়ে ছাড়া হচ্ছে তাদের।
শিক্ষার্থীদের অবস্থান সম্পর্কে প্রবাসীরা বলছেন, এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে। শুধু বৈধ শিক্ষার্থীরাই যেন পড়াশোনা করতে আসে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
বিএ