ভিডিও EN
  1. Home/
  2. প্রবাস

রজনী

প্রেমের স্বরূপ

মো. ইয়াকুব আলী | প্রকাশিত: ১২:৫৯ পিএম, ১১ জুলাই ২০২৪

সেদিন এক বন্ধুকে বলছিলাম আমাদের নিজস্ব গল্পগুলো হারিয়ে যাচ্ছে কারণ এখন সেগুলো আর লেখার কেউ নেই। আমাদের নিত্যকার জীবনের সাধারণ গল্পগুলো এখন আর বইয়ের পাতায় স্থান পায় না। এখন সেখানে উন্নয়ন আর প্রযুক্তির গল্প। মুঠোফোনের ধাক্কায় বই তো প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। এখন আর কেউ বই কেনে না। নতুন বইয়ের ভাঁজ খুলে সেখানে মুখ ডুবিয়ে কেউ আর প্রাণভরে শ্বাস নেয় না।

মুঠোফোনের পর্দার মরীচিকাতে সবাই আটকে আছে। কারো আগ্রহ নেই আশপাশের ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে। সবাই শুধু ছুটছে আর ছুটছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদেরও এগিয়ে যেতে হবে। নিম্ন আয়ের দেশ থেকে হতে হবে মধ্যম আয়ের দেশ তারপর উন্নয়নশীল দেশ এবং উন্নত দেশ। আমাদের জীবনযাপন হতে হবে উন্নত দেশের আদর্শে। আমরা শুধু তাদের চাকচিক্যটাই দেখি কিন্তু ভেতরের ফাঁপা অংশটা দেখি না।

রজনী উপন্যাসের বিষয়বস্তুও খুবই সাধারণ। একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের দৈনন্দিন জীবনের গল্প। আর সেই গল্পের মধ্যেই জড়িয়ে আছে প্রেম। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণ বীরু। তার জবানিতেই আমরা এই উপন্যাসের গল্পটা পড়ি। বীরুর মায়ের প্রতি তার বাবার প্রেম যার জন্য তাকে একটা সময় সব ছাড়তে হয়েছিল। আবার এশার প্রতি বীরুর প্ৰেম যেখানে সব সামাজিক প্রতিবন্ধকতাকে তারা অবজ্ঞা করতে চাইছে। তার বাবা মায়ের প্রেম কাহিনি অত্যন্ত চমকপ্রদ। তার বাবাকে একজন প্রতিভাবান ব্যক্তি বলা চলে। তার ডিগ্রিগুলো এ রকম বিএ (অনার্স), এমএ (ডাবল), এলএলবি।

নানান ধরনের ডিগ্রি অর্জন ছাড়াও অন্যান্য প্রতিভার স্ফূরণও তার মধ্যে দেখা গেছে যেমন কবিতা, নাটক এবং যন্ত্রসঙ্গীত। পড়াশোনা শেষ করার পর চাকরি-বাকরির মতো তুচ্ছ ব্যাপারে তার কোনো আগ্রহ দেখা যায়নি। তিনি শিল্প-সাহিত্যের চর্চায় উৎসাহী হয়ে ওঠেন। অতি অল্প সময়ে প্রায় হাজারখানেক কবিতা, দেড়টা নাটক এবং একটা পুরো উপন্যাস লিখে ফেলেন।

তিনি ত্রিশ বছর বয়সে তের বছরের এক বালিকার প্রেমে পড়ে যান। তার দেড় হাজার কবিতার প্রায় সবকটি এই বালিকাকে নিয়ে লেখা। এই বালিকার সঙ্গে তার বিয়ের কোনো প্রশ্নই ওঠে না, কারণ বালিকাটি সরকারি হাসপাতালের এক হতদরিদ্র কম্পাউন্ডারের মেয়ে। তিনি এসব তুচ্ছ জ্ঞান করলেন এবং এক সন্ধ্যায় তার বাবাকে গিয়ে বললেন, এই মেয়েটিকে বিয়ে না করতে পারলে তার জীবন নষ্ট হয়ে যাবে। তার সেই তের বছরের বালিকা বধূই বীরুর মা। তিনি পাঁচ বছরের মধ্যে একটা ভেলকি দেখিয়ে দিলেন। তিনটি পুত্র কন্যার (অনু, বীরু আর পারুল) জন্ম দিলেন এবং পুরোপুরি নিঃস্ব হয়ে ঢাকায় চলে এলেন।

বর্তমানে তিনি একটি ভাড়াবাড়িতে থাকেন। ডেলটা ইসুরেন্স কোম্পানির হেড ক্যাশিয়ার হিসেবে সাড়ে তিন হাজার টাকা বেতন পান। বাড়িভাড়া হিসেবে পান সতের শ টাকা। মেডিকেল অ্যালাউন্স এক শ। তার সাহিত্য প্রতিভা একেবারে জলে যায়নি। মাঝেমাঝেই খুব তেজী ভাষায় পত্র-পত্রিকায় চিঠিপত্র লেখেন।

বীরুদের পরিবারের পারিবারিক চিকিসক ধীরেন কাকু। দীর্ঘদিন একই পাড়ায় আছেন। উনিশ শ পয়ষট্টি সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর দলবল নিয়ে কলকাতায় পালিয়ে গিয়েছিলেন। সুবিধা করতে না পেরে আবার ফিরে এসেছেন। এখানেও সুবিধা করতে পারেননি। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকদের সমস্ত দুর্বলতা ধীরেন কাকুর আছে। তিনি আশপাশের সবাইকে খুশি রাখতে চান। উনিশ শ একাত্তরের নতুন মুসলমান ধীরেন কাকুর নাম হলো মোহাম্মদ সুলায়মান। দেশ স্বাধীন হবার পর ধীরেন কাকু আবার হিন্দু হয়ে গেলেন। তার বড় মেয়ে অতসীদি। ঈশ্বর তার চোখে জন্ম-কাজল পরিয়ে দিয়েছেন। তার ছোট আরও তিন বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। শুধু তারই বিয়ে হয়নি। বীরুর মতে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মেয়ে। বীরু এবং তার বন্ধু টুকু দুজন ছোটবেলায় ঠিক করেছিল বড় হয়ে তাকে বিয়ে করবে।

বীরুর প্রেমিকা এশা অবশ্য তাদের মধ্যে যে আসলে কি সম্পর্ক বিদ্যমান সেটা বলা মুশকিল। এশার সঙ্গে বীরুর পরিচয় বন্ধু মাসুমের মাধ্যমে। এশা এমন মেয়ে, যাকে কোথাও পাওয়া যায় না। রাত দশটায় ওদের বাড়িতে গিয়েও তাকে পাওয়া যায় না। কোথায় গিয়েছে সেটাও কেউ বলতে পারে না। যে-কেউ তার হাত ধরতে পারে। এশা হচ্ছে সেই রকম মেয়ে, যাকে যেদিন দেখা যায় সেদিনই মনে হয় সে সাজের নতুন কোনো কায়দা করেছে—যার জন্যে তাকে অন্য যেকোনো দিনের চেয়ে সুন্দর লাগছে।

হালকা নীল রঙের একটা শাড়ি পরলে তাকে লাগে ইন্দ্রাণীর মতো। সেই নীলের ছায়া আবার চোখে পড়ে। এশাকে অগ্রাহ্য করার মতো সাহস বা ইচ্ছা কোনোটাই তার নেই। এশা আবার কবিতাও লেখে যদিও মান বিচারে সেগুলো উৎরাই না। বীরু এশার হাসি শুনেই প্রেমে পড়ে যায়।

এই উপন্যাস প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৯ সালে। বইটা পড়লে বাংলাদেশের সেই সময়ের একটা ধারণা পাওয়া যায়। তখন ঢাকায় টেম্পু চলাচল শুরু হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চরম অরাজকতা বিরাজ করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর চমৎকার সব ব্যবহার হচ্ছে।

কোনো কোনো রুম ভাড়া দেওয়া হয়েছে বাইরের ব্যাচেলর চাকরিজীবীদের কাছে। তারা দিব্যি মাসের পর মাস থাকছে। ভাড়া, ছাত্রদের কোনো একটা বিশেষ দলের কাছে চলে যাচ্ছে। সুন্দর সিসেটম! ছাত্ররা ইচ্ছে করলেই কেউকে ধরে নিয়ে এসে মারধর করছে, আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায় করছে। প্রভোস্ট স্যারেরা এসব দেখেও না দেখার ভান করছেন। পরীক্ষার তারিখ পড়ছে আবার পিছিয়েও যাচ্ছে। ছাত্ররা টাকা নিয়ে বিভিন্ন ধরণের অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে। রাস্তাঘাটে যখন তখন গন্ডগোল বাধিয়ে দিচ্ছে। ছাত্ররা পাশ করে বের হতে চাইছে না কারণ তাহলে বেকারত্ব পেয়ে বসবে। এর চেয়ে ছাত্র জীবন দীর্ঘায়িত করায় তাদের কাছে মঙ্গলজনক মনে হচ্ছে।

মাত্র আশি পৃষ্ঠার এই উপন্যাসে জীবনকে দেখা হয়েছে অনেক বড় পটভূমিতে। বাংলাদেশের সমাজ, প্রকৃতি, নগর জীবন, রাস্তাঘাট, কোলাহল, বিশ্ববিদ্যালয় আঙিনা সবই উঠে এসেছে। পাশাপাশি সাহিত্য চর্চার বিষয়টাও এসেছে। আসলে সেই সময়টাতো ছিল খুবই টালমাটাল। স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতনের আন্দোলন শুরু হয়েছে। সবাই তার সময়ের দমবন্ধ সময়ের কাছ থেকে মুক্তি চাইছে।

অন্যদিকে গল্পের নায়ক বীরুও তার নায়িকা এশাকে নিয়ে নতুন স্বপ্ন দেখছে। অপেক্ষার দীর্ঘ রজনী পেরিয়ে তাদের জীবনে ভোরের সূর্যদোয় হবে। এশার কবিতার বই রজনী প্রকাশিত হবে। এখানে এশার কবিতার বই আর বীরুর অপেক্ষার রজনী মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। বইয়ের শেষ দুটো লাইন দিয়ে লেখাটা শেষ করি। মানুষ হয়ে জন্মানোর সবচেয়ে বড় কষ্ট হচ্ছে মাঝে-মাঝে তার সবকিছু পেছনে ফেলে চলে যেতে ইচ্ছা করে কিন্তু সে যেতে পারে না। তাকে অপেক্ষা করতে হয়। কিসের অপেক্ষা তাও সে ভালোমতো জানে না।

এমআরএম/জিকেএস