ভাটি অঞ্চলের নিত্যকার জীবন অপরাহ্ন
হুমায়ূন আহমেদের এই লেখার খবর প্রথম পাই ফয়জুল লতিফ চৌধুরীর লেখা ‘হুমায়ূন আহমেদ: কয়েকখণ্ড স্মৃতি’ লেখা থেকে। সেখানে হুমায়ূন আহমেদের জন্য লেখা নোবেল বক্তৃতার মধ্যে ‘দ্বিতীয় অপরাহ্ন’ বলে একটা উপন্যাস লেখার কথা উল্লেখ আছে। হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকলে হয়তোবা লিখতেনও। তখনই অপরাহ্ন লিখে গুগলে খুঁজে পেলাম বইটা।
এরপর অফিসের কাজ ফাঁকি দিয়ে একটানা পড়ে শেষ করলাম। অপরাহ্ন ভাটি অঞ্চলের একটি গ্রামের গল্প। অথবা পুরো ভাটি অঞ্চলের গল্পই। কারণ, ভাটি অঞ্চলের সব গ্রামেরই চরিত্র বৈশিষ্ট্য একই রকম। আর সেটা সমতলের তথা উজানের চরিত্র থেকে আলাদা এবং স্বতন্ত্র।
শুরুতেই ভাটি অঞ্চলের চরিত্র সম্পর্কে জানা যাক। লেখকের ভাষায়- ‘ময়মনসিংহ থেকে উত্তরের দিকে যে ব্রাঞ্চ লাইনটি গেছে তার শেষ স্টেশনটির নাম মোহনগঞ্জ। স্থানীয় লোকজন একে উজান দেশ বলেই জানে। যদিও নাবাল অঞ্চলের শুরু এখান থেকেই। শুকনো মৌশুমে কিচ্ছু বোঝার উপায় নেই। দিগন্ত বিস্তৃত বৃক্ষহীন বিশাল মাঠ। এঁকেবেঁকে তার ভেতর দিয়ে চলে গেছে পায়ে চলা পথ। সেই পথ ধরে উত্তরে যাওয়া মানেই ভাটি অঞ্চলে গিয়ে পড়া’।
‘চট করে কিছু বোঝার উপায় নেই-উজান দেশেও এ রকম বিশাল মাঠ আছে। কিন্তু ভাটির মাঠগুলি কেমন যেন অন্যরকম। এই মাঠের হাওয়ায় কিছু একটা আছে। এ অঞ্চলের সাথে পরিচয় নেই এমন মানুষ এক ধরনের চাঞ্চল্য অনুভব করেন। তাঁদের কাছে মনে হয় এ মাঠ শুধু মাঠ নয় এর অন্য কোন পরিচয় আছে।’
অপরাহ্ন উপন্যাসের গ্রামটির নাম বানিয়াবাড়ি। তিনটি বিশাল হাওর একে জড়িয়ে ধরে আছে। উত্তরে নাও ডুবের হাওর। দক্ষিণে এবং পশ্চিমে পাগলা হাওর। পুবে মতি বিবির হাওর। বানিয়াবাড়ি খুব ছোট গ্রাম নয়। প্রায় সত্তরটির মতো ঘর আছে। পাকা বাড়ি আছে দুটি। গ্রামের মানুষদের তেমন কোনো জমিজমা নেই। এ নিয়ে খুব একটা মাথা ব্যথাও নেই। অন্যের জমি চাষ করে তাদের দিনকাল খারাপ যায় না। হয়তো ভাটি অঞ্চলের প্রকৃতিই এদের খানিকটা নিয়তিবাদী করেছে।
অনিত্য জগৎ সংসারে ঘরবাড়ি দালানকোঠার তেমন কোনো প্রয়োজন নেই, এই ধরনের বিষয়বস্তু নিয়ে রচিত গান এরা খুব আগ্রহ নিয়ে গায়। এরা ছ’মাস থাকে জলবন্দি অবস্থায়। সেটাই সম্ভবত তাদের সুখের সময়। কাজকর্ম নেই-গান-বাজনা, বাঘবন্দি খেলা আর লম্বা ঘুম। এ সময়ে এখানকার মানুষদের শরীরে নেমে আসে অদ্ভুত এক আলস্য। মেজাজ হয়ে যায় রাজা-বাদশাদের মতো।
এই উপন্যাসে গ্রামীণ মিথগুলো তুলে ধরা হয়েছে অত্যন্ত যত্ন সহকারে। সাপ কাটার ব্যাপারটা জানাজানি হওয়া খুব খারাপ। যতই জানাজানি হবে ততই বিষ উঠবে। ওঝা এসে ঝাড়ফুঁক করবার পর লোকজন জানুক তাতে ক্ষতি নেই। সাপে কাটা বাড়িতে উনুন ধরানোর নিয়ম নেই। শনি আর মঙ্গল এই দুই দিনে সাপের বিষের তেজ থাকে বেশি।
সাপে কাটা মানুষের গলার স্বর আস্তে আস্তে ভারী হয়ে যায়। চোখের তারা বড় হতে থাকে। এমনভাবে তাকায় যেন কাউকে চিনতে পারছে না। অথচ ঠিকই চিনতে পারে। ঘন ঘন পানি খেতে চায় কিন্তু দু-এক ঢোঁক খেয়েই বলে তিতা লাগছে। এক সময় অল্প অল্প বমি করে। সাপে কাটা ঝাড়ার জন্য ওঝা যে মন্ত্র উচ্চারণ করে তারও উদাহরণ দেয়া হয়েছে-
‘ও বালা লখিন্দররে
কোন কাল ভুজঙ্গ তারে খাইলরে’
জীবনে বেঁচে থাকার জন্য নিত্যকার বিষয়গুলোও এসেছে বিস্তারিতভাবে। পেটের ক্ষিধার মতো খারাপ জিনিস নাই। বাঘেরা পেটে যখন ক্ষিধা ওঠে তখন নিজের বাচ্চা খায়। টাকা-পয়সা হওয়া দোষের না। টাকা-পয়সা থাকলে মনে শান্তি থাকে। আল্লাহ খোদার নাম নেওয়া যায়। পেটে ক্ষুধা থাকলে মনে ঢোকে শুধু ভাতের চিন্তা। প্রতি গ্রামেই আশ্রয়হীনা কিছু মেয়ে মানুষ থাকে।
বেঁচে থাকার তাগিদেই এদের স্বভাব হয় অতি মধুর। আবার তখনকার সময়ে সমাজে মেয়েদের অবস্থানও তুলে ধরা হয়েছে। মাইয়া মাইনষের কথার দাম হইল এক পয়সা। মাইয়া মাইনষের ওপরে কোনদিন বেজার হইস না। এরা না পাইরা অনেক কিছু করে। না বুইজ্যা করে। গ্রামীণ জনজীবনের সবকিছুই চলে অদৃষ্টের নিয়মে। আল্লাহপাকের লীলা বোঝা দায়। একদিকে মায়া দেন অন্যদিকে মায়া টেনে নেন। আল্লাহপাক পরিষ্কার বলেছেন-তাঁর হুকুম ছাড়া কিছুই হবে না।
ভাটি অঞ্চলের প্রকৃতির চরিত্র বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে সমস্ত ফসল এক সঙ্গে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। পরবর্তী ফসলের জন্য এই লোকগুলোর আরও একটা বছর অপেক্ষা করতে হবে। এরা এখানেই থাকবে। অন্যকোনো কাজকর্মের ধান্দায় ঘর ছেড়ে বেরুবে না। কারণ অন্য কাজকর্ম জানা নেই। উজানের দেশ থেকে ধুরন্ধর সব লগ্নীকারীরা টাকা নিয়ে আসবে।
লগ্নী করবে পরের বছরের জন্য। এক মণ ধানের টাকায় চার মণ ধান দিতে হবে। অভাব চরমে ওঠে ভাদ্র মাসে। হাড় জিরজিরে শিশুরা অলস ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়ায়। গ্রামের মাতব্বররা বলে কেউ যেন হালের গরু বিক্রি না করে। গরু চলে গেলে হাল বন্ধ হয়ে যাবে। সব বেচে দিক কিন্তু গরু যেন থাকে। অনেকেই তাদের কথা শোনে না। বিক্রি হয়ে যাওয়া পশুরা গভীর মমতায় চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে গ্রামের দিকে। ভাদ্র মাসের ভরা নদী ছল ছলাৎ করে।
ধানের মৌসুমে যখন ধানকাটা শুরু হয় তখন এরা কাজ করে যন্ত্রের মতো আর মেঘলা আকাশের দিকে গম্ভীর চোখে তাকায়। এতগুলো মানুষ মাঠে কাজ করে কিন্তু বোঝার উপায় নেই। কারো মুখে কোনো কথা নেই। ধান কাটার ব্যাপারটায় অনেকখানি আনন্দ আছে। ধানের গোছা স্পর্শ করায় আনন্দ, তার ঘ্রাণে আনন্দ। এই সময়টার শিশুরা সারা মাঠে ছোটাছুটি করে। বাবারা কপট ভঙ্গিতে ধমক দেয়-দামালি করিস না।
শিশুরাও টের পায় এটা একটা কপট রাগ। তারা আরো হৈ চৈ করে। মাঠ রক্ষার জন্য একজন ‘ফিরাইল’ থাকে। তার হাতে পাকা বাঁশের দু’হাত লম্বা লাঠিটি ক্রমাগত ঘোরে। বিড়বিড় করে তিনি ক্রমাগত কি সব পড়েন। লাঠির সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজেও ঘোরেন। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আকাশ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করবেন। সে রকম ক্ষমতাবান ফিরাইল হলে তিনি দুর্যোগ টেনে নেবেন তার নিজের শরীরে। মাঝে মাঝে তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে হুংকার দেন। সঙ্গে সঙ্গে আকাশ হুংকার দিয়ে তার জবাব দেয়। যেন আকাশ এবং মানুষের যুদ্ধ।
ফসল তোলার আগেই গাইন বেটিদের দল ডালা সাজিয়ে চলে আসে। পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে বলে-কিনেনগো ভইন। বালা সদাই। দামের চিন্তা নাই। ধান উঠুক। গ্রামের বোকাসোকা মেয়েগুলো স্বামীকে লুকিয়ে জিনিসপত্র কিনে ঘর বোঝাই করে। তরল আলতা, ফিতা, রাংতা, কাচের চুড়ি, পাউডার, কাজল, লক্ষ্মীবিলাস তেল, স্বামী সোহাগী সাবান।
এই উপন্যাসে মানবিক সম্পর্কের বিষয়গুলো খুবই মমতা সহকারে তুলে ধরা হয়েছে। ভাই সাত মাইল পথ হেটে তার বোনের বাড়ি এসে উপস্থিত হয়। সে কখনোই খালি হাতে আসে না। অতি সামান্য জিনিস-এক হালি ডিম, আধ সের দুধ, একটা ছোট কাঁঠাল, কাঁচা সুপারি সাথে করে নিয়ে আসে। ট্যাকা বড় জিনিস না। মায়া মহব্বত বড় জিনিস।
এবার লেখকের ভূমিকার দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক। ‘অপরাহ্ন’ ঈদ সংখ্যা বিচিত্রায় (১৯৮৭) প্রথম প্রকাশিত হয়। বিচিত্র কারণে প্রচুর প্রশংসা এই লেখাটির জন্য জুটে গেছে। প্রচুর মমতা এবং প্রচুর ভালোবাসায় যেসব লেখা লিখেছি বেশির ভাগ সময়ই দেখেছি কেউ সে সব নিয়ে কথা বলেন না। আবার নিতান্ত হেলাফেলা লেখাগুলির কথা আগ্রহ নিয়ে বলেন। কে জানে রহস্যটা কি। কিন্তু লেখকের এই কথা সত্য নয়।
লেখক প্রচন্ডরকম মমতা নিয়ে এই উপন্যাসের প্রত্যেকটা চরিত্র নির্মাণ করেছেন। ফয়জুল লতিফ চৌধুরীর লেখার কাছে ফিরে আসি যার লেখা পড়ে আমি এই বইটার সন্ধান পেয়েছিলাম- ‘অন্য সব লেখকের মতোই আমি নিরলসভাবে অধ্যয়ন করেছি। এই অধ্যয়ন কেবল গ্রন্থপাঠ নয়—আমি মানুষকে অধ্যয়ন করেছি। চারপাশের মানুষেরা কীভাবে জীবনযাপন করে, তাদের উপলব্ধি ও অভিব্যক্তি কীরূপ—তা পর্যবেক্ষণ করেছি পরম মমতা ও একাগ্রতার সঙ্গে’।
গ্রামের গরিব মানুষদের উপলব্ধির কথাও এসেছে এই উপন্যাসে। গরিব হওন বড় শরমের ব্যাপার। ঈদের নামাজ গরিবের জইন্যে না। জন্মভূমির প্রতি মানুষের মায়ার প্রসঙ্গও এসেছে। মরবার আগে আগে নাকি জন্মস্থানের মাটি ডাকতে থাকে। সেই ডাক অগ্রাহ্য করা মুশকিল। জন্ম মাটির উপর শুয়ে থাকলে মৃত্যুর সময় আজাব কম হয়। বিদেশে মৃত্যু খুব কষ্ট।
লেখকের আরও কিছু মন্তব্য দিয়ে লেখাটা শেষ করি। পৃথিবীর সব মায়াই তো কাটাতে হয়। এই হচ্ছে নিয়ম। মানুষকে কোথাও না কোথাও থামতে হয়। এই পাঠ আলোচনাটা মোটেই গোছানো হয়নি। সেই দায় একান্তই আমার। কারণ উপন্যাসটা পড়ে এতটাই আচ্ছন্ন হয়ে আছি যে নিজের চিন্তাজগৎ ঠিকভাবে কাজ করছে না।
এমআরএম/জিকেএস