খুব জানতে ইচ্ছে করে
সদ্য গণমাধ্যমে দেখছি এক বাবার আর্তনাদ। তিনি দাবি করছেন তার চার ছেলে আমেরিকায়। বাবা থাকেন বৃদ্ধাশ্রমে। ঘটনাটি দেখে নানাজনে নানা মন্তব্য করছেন, যেমন কেউ বলছেন সন্তানকে দ্বীন শিখান। দ্বীনি পরিবেশে বড় করুন। এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত আমাদের ইত্যাদি এবং এই একই পোস্টে আমার এক ছোট-ভাই মন্তব্য করেছেন— সন্তানদের বেশ জ্ঞানী বানিয়ে ফেলেছেন।
তাদের কাছে এই পৃথিবী বিশাল জায়গা, সীমাহীন জায়গা। তাদের ধারণা, পিএইচডি মানেই সর্বোচ্চ জ্ঞান, আমেরিকা মানেই পুরো পৃথিবী, কিন্তু বাস্তবে তা নয়। আসলে তাদের জ্ঞান অপ্রকৃত, প্রকৃত নয়। যদি কখনো ওরা পিএইচডির সীমানা অতিক্রম করে প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করে, তাহলে পৃথিবীর সীমানা খুঁজে পাবে, শিকড়ের দিকে ফিরে তাকাবে, আপনার কাছে ফিরে আসবে, আপনাকে না পেলে আফসোস করবে, বুক চাপড়াবে, কিন্তু তখন আর সময় থাকবে না।
মূলত তার এই কথাগুলো আমার মনে ধরেছে, সেই সুবাদে আমার ভাবনা থেকে এতটুকু বলতে চাই আমাদের সবাইকে একত্রিত হয়ে এ চিন্তাগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। যাইহোক আমি নিজেই থাকি দেশের বাইরে। স্বাভাবিকভাবে দেশের কথা ভাবি এবং সেই ভাবনার জগৎ থেকে কিছু রিফ্লেকশন, শেয়ার করছি আমার শেয়ার ভ্যালুর কন্সেপ্ট থেকে।
একটি বীজ মাটিতে বপন করলে কী ঘটে, বীজটি প্রথমে মাটির গভীরে মূল শিকড়সহ অন্যান্য শিকড় প্রতিস্থাপিত করে। যখন বীজটি মূল শিকড় প্রতিস্থাপন বা রোপণ করতে সক্ষম হয় ঠিক তখনই বীজ থেকে গাছ আকারে অংশটি উপরের দিকে উঠতে থাকে। তারপর মূল শিকড় যেমন নানা জৈব উপাদান সরবরাহ করে ঠিক তেমনিভাবে গাছটি ওপর থেকে আলোকরশ্মিসহ অক্সিজেন, কার্বন-ডাই-অক্সাইড ইত্যাদি প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো সরবরাহ করে গাছটিকে পরিপূর্ণ করে গড়ে তোলে এবং শেষে সেই গাছটি ফুল এবং ফল দেয়।
প্রকৃতির এই অপূর্ব কর্মদক্ষতা আমরা যদি নিজেদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে তুলনা করি তবে মূলত একই ঘটনা দেখতে পাই। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেটা নিয়ে ভাবা বা জানার আগ্রহ আমাদের নেই। আমরা আমাদের ভেতরের অবস্থান (ইনার ইঞ্জিনিয়ার) নিয়ে তেমন ভাবি না। আমরা শুধু আমাদের বাইরের অবস্থান (আউটার ইঞ্জিনিয়ার) নিয়ে ভাবি। বর্তমান বিশ্বের যে অবস্থা তাতে করে আমার মনে হয় সময় এসেছে জীবন সম্পর্কে কিছুটা ভিন্নভাবে ভাবতে শুরু করা। প্রকৃতিকে বুঝতে এবং জানতে শেখা, রিফ্লেক্ট করা প্রকৃতির এই অভূতপূর্ব সৃষ্টিকে এবং তখনই আমরা অনুভব করতে পারব সৃষ্টির রহস্যকে।
মানুষ জাতি সৃষ্টির এক অভূতপূর্ব রহস্য। আমাদের নিজেদের মধ্যকার ইনার ইঞ্জিনিয়ারকে যেমন জানা দরকার পাশাপাশি জানা এবং বোঝা দরকার আমাদের জন্মগত হেরিটেজকে, আমরা যত হেরিটেজের ওপর গুরুত্ব দিব ততই আমরা নিজেদের হেরিটেজকে ভালোবাসবো এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা কি আমাদের হেরিটেজকে সঠিক মূল্যায়ন দিতে পারছি?
যেমন আমি জন্মসূত্রে বাংলাদেশি, আমার তার প্রতি সবসময় একটি বিশেষ দুর্বলতা কাজ করে, যার ফলে আমি দেশপ্রেমিক যদিও আমি দেশের বাইরে বসবাস করে চলছি বহু বছর ধরে। আমার ভাবনার জগৎ থেকে এতটুকু বুঝতে পেরেছি আর সেটা হলো দেশপ্রেমিক হতে হলে আমাদের নিজেদের মধ্যকার ইনার ইঞ্জিনিয়ারকে জানা দরকার। দেশকে ভালোবাসতে হলে, দেশের মানুষকে ভালোবাসতে হবে, দেশের জিনিস ব্যবহার করতে হবে। যেমন পরিবারকে আঁকড়ে রাখতে হলে তাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। এখন শুধু আমি করব অন্য কেউ করবে না তাহলে তো হবে না।
এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে কিছু লিখি। আমি স্ক্যান্ডিনেভিয়ার সবচেয়ে বড় শপিং সেন্টার - ওয়েস্টফিল্ড মল অফ স্ক্যান্ডিনেভিয়াতে গিয়েছিলাম। এটা এখন স্টকহোমের নতুন আরেকটি ট্যুরিস্ট স্পট। কারণ এখানে আপনি পাবেন ২০০টিরও বেশি দোকান এবং রেস্তোরাঁ যা সুযোগ করে দেয় সুপরিবেশসহ নানা প্রকার সুযোগ-সুবিধা। রয়েছে আন্তর্জাতিক সব ব্র্যান্ড এবং বিশ্বের প্রত্যেক অংশ থেকে রুচিশীল খাবারের সুব্যবস্থা।
একই ছাদের নিচে কমার্শিয়াল আইম্যাক্স চলচ্চিত্র দেখার অভিজ্ঞতা। স্টকহোমের সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে এই জনপ্রিয় কেন্দ্রে আসতে সময় লাগে মাত্র সাত মিনিট। মানে যেকোনো সময় এই মল ছেড়ে হুট করে আবার স্টকহোম সিটিতে গিয়ে রাজবাড়িসহ পুরোনো শহর এবং অন্যান্য বিনোদনের মধ্য দিয়ে স্টকহোমকে এনজয় করতে পারবেন। আমি ওয়েস্টফিল্ড মল অফ স্ক্যান্ডিনেভিয়াতে একটু কেনাকাটা করতে গিয়ে দেখি কাপড়ের ট্যাগে লেখা ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’।
চোখের সামনে সব কমিউনিটির মানুষ কিনে নিচ্ছেন আমার দেশে তৈরি পোশাক। সুইডেনসহ পৃথিবীর সবদেশ থেকে ডলার যাচ্ছে বাংলাদেশে। আমরা যদি বাংলাদেশে দেশীয় পণ্য ব্যবহার করি, তবে তো দেশের মুদ্রা দেশেই থাকার কথা! আমদানির চেয়ে যদি রপ্তানি বেড়ে যেতে থাকে তবে দেশ এগিয়ে যাবে!
সেক্ষেত্রে যেসব পণ্য বয়কট করা উচিত তা করা দোষের কিছু না। আর নিজের এবং দেশের স্বার্থে যা আমদানি করার, তাতো করতেই হবে যদি দরকার পড়ে। সুইডেনে এরা সবসময় এদের নিজেদের জিনিস ব্যবহার করে, চিকিৎসার জন্য হুট করে অন্যদেশে যায় না। তবে হ্যাঁ, বিদেশি জিনিসের ব্যবহার এরাও করে তবে দেশীয় জিনিসের মূল্যায়ন করে প্রথমে।
এক ভদ্রলোক কানাডা থেকে দেশে গিয়েছিলেন তো তিনি তার সফরকালের একটি বর্ণনা দিয়েছেন; ‘মুরগি ও মাছ কিনতে গিয়েছিলাম সাহেবপাড়া (সিদ্ধিরগঞ্জ) কাঁচাবাজারে। দোকানি কয়েক ধরনের মুরগি দেখিয়ে বললেন, ‘এখন সব ক্রেতা পাকিস্তানি মুরগিটা বেশি টানেন।’ বললাম, ‘এই মুরগি যে পাকিস্তানি, সেটি কী করে বুঝব? তা ছাড়া পাকিস্তানি মুরগি যে বেশি সুস্বাদু, তারই বা প্রমাণ কী? এসব কল্পকাহিনী বলে ক্রেতার মন পেতে চেষ্টা কোরো না’, বলেই চলে গেলাম পাশের দোকানে।
সেই দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার মুরগিও কি পাকিস্তানি?’ লোকটি নিম্নস্বরে বলল, ‘স্যার, একটা সত্য কথা বলি। আমাগো কারও মুরগিই পাকিস্তানি না। ভারতীয় পণ্য বয়কটের কারণে পাকিস্তানি নামটা বললে ক্রেতার আগ্রহ বেড়ে যায়। এ ছাড়া কিছু না।’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাংলাদেশি বললে সমস্যা কী? স্বদেশি পণ্যে বিদেশি ট্যাগ লাগিয়ে বিক্রি করা তো অপরাধ।’
লোকটি উত্তর দিলেন, ‘স্যার, মনে কিছু নেবেন না। এজন্য কাস্টমাররাই দায়ী। বাংলাদেশ কইলে কেউ কিনবার চায় না। আমাগো বেচা অইল কতা। অবশ্য পাকিস্তানি জাতের বলে এক ধরনের মুরগি বহু আগে থেকেই পরিচিত।’
এতক্ষণে বুঝতে পারলাম, ভারতীয় পণ্য বয়কটের বহু আগে থেকেই বাঙালিরা মনে মনে বাংলাদেশি পণ্য বয়কট করে রেখেছেন। তবে আমি যতটুকু জানি তাতে করে বলব জিনিসের ক্ষেত্রে কথাটা ঠিক আছে যে, মানুষ আগে বিদেশি পণ্য/ দামি পণ্য খুঁজে, কিন্তু মুরগির ক্ষেত্রে দেশি মুরগি সর্বদাই সেরা, স্বাদেও সেরা, স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও তেমন ঝুঁকি নেই, এবং দামও অনেক বেশি। পাকিস্তানি মুরগি আছে, ওটা শুধু সস্তায় দেশি মুরগীর সস্তা স্বাদ নেয়ার জন্যে কিন্তু দেশি মুরগি সব সময়ই সেরা এটা দেশের মানুষ জানে।
তবে বিদেশি পণ্য কিনতে হবে এই রোগ তো অতীতেও ছিল। আমি ছোটবেলায় দেশে থাকতে দেখেছি সবাই কেন যেন বিদেশি জিনিস কিনতে বেশি পছন্দ করত। কেউই দেশি কিছু কিনতে চাইত না যা নিশ্চয়ই এখনও প্রচলিত রয়েছে। দেশে থাকাকালে শপিং করতে গেলে দোকানিরা বলতেন, ‘প্যান্ট পিসটা জাপানি, শার্ট পিসটা থাইল্যান্ডের।’
বন্ধুরা বলত, হ্যাঁ এটি পিউর জাপানি! একবার ভেবেও দেখিনি, জাপানিদের ঘণ্টায় আয় কত। রপ্তানি বাণিজ্যে জাপানিরা পোশাকশিল্পে খ্যাত বাংলাদেশে কোনো শার্ট, প্যান্ট বা শাড়ি বিক্রি করে কি না। টয়োটা, হোন্ডা, নিশান ইত্যাদি গাড়ি শিল্প বা উঁচু মানের ইলেকট্রনিক আইটেম রপ্তানির দেশ জাপানের শ্রমিক খরচ আকাশচুম্বী, বিষয়টি কখনো মাথায় আসেনি।
মিথ্যা কথা বলে বাঙালি দোকানিরা আমার দেশেরই পোশাক বিক্রি করতেন আমার কাছে। আমরা কিন্তু সেই বোকাই রয়ে গেছি! দোকানিরা বাংলাদেশের নাম বললে প্যান্ট ও শার্ট পিস ছুড়ে দিয়ে বলতাম, ‘থাই বা জাপানিটা থাকলে দেখান।’ কী জঘন্য! অথচ স্বাধীনতা দিবস, ভাষা দিবস ও বিজয় দিবসে আমরা দেশমাতৃকাকে ভালোবাসার কী অভিনয়টাই না করি! দুর্নীতি কি সাধে ঘর বেধেছে দেশে? দেশকে আদৌ যে কেউ ভালোবাসে সেটাই এখন প্রশ্ন!
সেই জন্য হাজার মনের কাছে প্রশ্ন করুন দেখবেন কোনো উত্তর নেই। কোটি কোটি জনতার মাঝে যখন শূন্যতা উপভোগ করবেন তখন ভাববেন সময়টি খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। যদিও মনেপ্রাণে বলি চালাও সে পথে যে পথে তোমার প্রিয়জন গেছে চলি। আমার প্রশ্ন এখন, আছে কি সেই প্রিয়জন বাংলাদেশে যার পথ স্মরণ করা সম্ভব? নাকি আমরা পুলিশের আইজি বেনজিরের পথ স্মরণ করতে সবাই উঠে পড়ে লেগেছি!
প্রকৃতির একটি বীজ থেকে কীভাবে একটি গাছ হয়, অতঃপর ফুল ও ফল হয় এবং কী পরিমাণ ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে সেটা সম্ভব হয় তা-কি ভেবে দেখি? আমরা মানুষ জাতিও তো কত কিছুর পর মানুষ হতে চেষ্টা করি কিন্তু প্রকৃত মানুষ হতে পারি কি!
রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। [email protected]