ভিডিও EN
  1. Home/
  2. প্রবাস

জহুরি মহল্লা

শায়লা জাবীন | প্রকাশিত: ০৪:১৬ পিএম, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

মোহাম্মদপুর বাবর রোডে যে জহুরি মহল্লা তার পেছনে কিছু লাইন দেওয়া ঘর টিনশেড একতলা আছে, গ্রাম থেকে ঢাকায় আসা স্বল্প আয়ের মানুষজনেরা সেখানে ভাড়া থাকে। তেমনি একটা খুপরি মতো ঘরে থাকে রেজিনা আর রহমত প্রায় দেড় বছর হলো, তাদের টোনাটুনির সংসার।

রহমতের গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জ, বছর দুয়েক আগে শীতের সময় সে দেশের বাড়িতে গ্রামের রেজিনাকে বিয়ে করে, বিয়ের পর ছয় মাস রেজিনা রহমতদের বাড়িতেই ছিল ওর বাপ মার সঙ্গে, অল্প বয়সী বউটা মন খারাপ করে থাকে দেখে সেই এই টিনশেড ঘরটা ভাড়া করে রেজিনাকে এসেছে। রহমতের মা জুলেখা বেগম প্রথম দিকে গাই গুই করেছিল, মনে তার শখ ছিল পোলার বউ রান্না ঘরের দায়িত্ব নিবে, হাঁস মুরগি পাইলা দেবে, সন্ধ্যাবেলা পায়ে গরম তেল মালিশ করে দেবে, কিন্তু বউ পাগলা রহমতের জন্য তা আর হলো না, ছেলে বিয়ে করিয়ে লস, ভাবটা এমন যে, ছেলের বউ না, চাকরানি নিয়ে আসছে বাড়িতে।

রহমত অবশ্য এগুলা আমলে নেয় নাই, তার বউ তো তার কাছেই থাকবে। কিন্তু আসল বিষয় হলো রহমত রিকশা চালায়, তার আয় খুব বেশি না। আনার আগে তার বাসা ভাড়া করতে হয়েছে, আগে সে মেস বাড়িতে থাকতো। এখন বাসা ভাড়া, খাওয়ার ছাড়াও প্রতি মাসে তাকে তার বাবা মাকে টাকা পাঠাতে হয়। এসব দেখে রেজিনা আসার দুমাস পরে মোহাম্মদপুরে ফ্ল্যাটগুলোতে ছুটা বুয়ার কাজ নিয়েছে পাশের ঘরের শেফালির মাধ্যমে। রহমত প্রথমটা রাজি হয়নি কিন্তু রেজিনার একগুয়ের কাছে হার মানতে হয়েছে। এখন টানাটানি ছাড়াই দিব্যি চলছে তাদের সংসার তবে সেখানে রেজিনার মানসিক, শারীরিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ রয়েছে।

আজকে হঠাৎ বৃষ্টি, রিকশার ক্ষ্যাপ কম, রহমত আকাশের দিকে তাকাইয়া বিরস মুখে রিকশার পাদানিতে বসে ভাবতে বসলো, আর কদিন পরেই তাদের দ্বিতীয় বিবাহ বার্ষিকী। প্রথমবার ছোট ভাইয়ের পা ভেঙে যাওয়ায়, বেশি টাকা পাঠাতে হয়েছিল এজন্য রেজিনাকে কিছু কিনে দিতে পারেনি, ও সেটা নিয়ে রোজিনা কিছু বলেওনি কিন্তু এইবার তার ইচ্ছা সেই রেজিনাকে তার প্রিয় কিছু কিনে দেবে এজন্য টাকা জমানো শুরু করেছিল কিন্তু গত পরশু তার বাবা ফোন করে উত্তরের ঘরে টিনের চারা বদলাতে হবে বলে জানিয়েছে, টিনের চালায় নাকি ফুটা, বৃষ্টির সময় ঘরের মধ্যে চুইয়ে চুইয়ে পানি পড়ে। রহমত চিন্তায় পড়ে গেলো, কোনটা ছেড়ে কি করবে? জমানো টাকা দিয়ে পাঠালে রেজিনার জন্য কীভাবে কি কিনবে? এজন্য ভাবছিল এইকদিন একটু বেশি রিকশা চালিয়ে বেশি টাকা জমাবে, কিন্তু আজকে তো কাস্টমারই নাই। ধুর...

রেজিনা তিন বাড়িতে ছুটা বুয়ার কাজ করে, দুটো বাড়িতে তিন তিন ছয় আর একটা বাড়িতে চারটা কাজ মোট মোট ১০টা ভারি কাজ করে বাড়িতে এসে আর শরীর চলে না তার, আসার পথে টুকটাক বাজারও করে ফেরে মাঝে মধ্যে, এরপর রান্না, রহমতের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে যাওয়া, ফের দুজনে বসে খেয়ে পরের দিনের খাওয়া গুছিয়ে শোওয়া মাত্র ঘুম, এত ক্লান্ত থাকে যে মাঝে মাঝে আদর সোহাগ ভুলে যায়।

সামনের ঘরের সুফিয়া খালা বলছিল, এত অল্প বয়সে এত ভারী কাজ একটানা না করতে, পোলাপান হতে কষ্ট হবে, কিন্তু কোনো উপায়ও তো নাই, রহমত বেচারার জন্য তার মায়া লাগে, অনেক খাটাখাটনি করে কিন্তু তার বাসায় চাহিদা লেগেই আছে, তাই প্রতি মাসেই বাড়তি টাকা দিতে হয়। রেজিনা মোট শেষ করে বাড়ির পথে ফিরছিল, রাস্তায় হঠাৎ মনে পড়লো তাদের ম্যারেজ ডে আসছে, কত বছর তো সে রহমতকে কিছু দিতে পারেনি, এই বছর পরিকল্পনা আছে, কিছু দেওয়ার। এক খালাম্মার বড় মাইয়া আসছে বিদেশ থেকে, সে নাকি যাওয়ার সময় দিয়া যাইবো, দেখা যাক কত দেয়, আজকে একটা চকলেটের প্যাকেট আর বিদেশি লিপস্টিক দিছে।

চকলেটের প্যাকেট না খুইলা রেজিনা সাথে নিয়ে আসছে রাত্রে ভাত খাওয়ানোর পর রহমতের লগে খাইবো। লিপস্টিক পেয়েও বেজায় খুশি রেজিনা, কত দিনে তার শখ আছিল একটা লিপস্টিক কেনার... এসব ভাবতে ভাবতেই রোজিনা বাসায় চলে আসছে, চাবি দিয়ে ঘর খুলে ঢুকলো, ট্রাঙ্কের চিপায় একটা ছোট্ট কৌটা খুলে কিছু নোট বের করে গুনে দেখে সাত হাজার টাকা মাত্র, এই দিয়ে কি একটা টেলিভিশন হবে? রেজিনার অনেক দিনের শখ রহমতের জন্য একটা টেলিভিশন কেনা।

রহমত টিভি দেখতে খুবই পছন্দ করে... মাঝে মধ্যেই রাস্তায় দাঁড়ায় দোকানের টিভির দিকে তাকায় থাকে, রেজিনা জানে কিন্তু এখনো তো অনেক টাকা লাগবে। রেজিনা ভাবতে রান্না শুরু করলো, আজকে একবারের থেকে কিছুটা তরকারিও দিছে, আগের দিনের বাসী যদিও কিন্তু ফ্রিজের মধ্যে ছিল। টেংরা মাছের ঝোল, ওই বাড়িতে বলে কেউ টেংরা মাছ খায় না, রেজিনা বুঝে উঠতে পারে না বড়লোকদের কাণ্ডকীর্তি। টেংরা কত মজার একটা মাছ। এমন সময় মোবাইল বেজে উঠলো, রহমত করছে,
:তু্ই বাড়িত আয়া পরছস?
:হ, কুনসম... রানতাছি, আপনে কহন আইবেন?
:তাততাড়ি আইয়া পড়মু, বৃষ্টির জন্য কাস্টমার নাইকা, কি রানতাছস?
: ডাইল আর ভাত বসাইছি, তরকারি কুটি ডিম দিয়া সালুন করমু, বেগুন পুইড়া ভর্তা করমু, এক খালাম্মা টেংরা মাছের ঝোল দিসে।

:সালুন লাগতো না, বেশি কইরা কাঁচামরিচ দিয়া ঝাল কইরা ডিম ভাজি কর, আমি ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আইতাছি।

আইচ্চা, সাবধানে আইসেন, ভিজেন না জ্বর সর্দি হইবো আবার।

হ, কাইটা দিলাম লাইন। লাইন কেটে রহমত ভাবতে বসলো,
রোজিনার কাপড় রাখার কোনো কিছু নাই, সব কাপড় সুটকেসের মধ্যে থাকে। একটা আলমারি বানাতে চাইছিল, কুলায় উঠতে পারবো কিনা বুঝতে পারতাছে না। একটা খুব বড় কইরা দীর্ঘশ্বাস ফালাইয়া বাড়ির দিকে রওনা দিলো, যদি একটা কাস্টমার মিলতো!

রহমত হাতমুখ ধুইয়া খাইতে বসছে মেঝেতে মাদুর বিছানো। রেজিনা প্লেটে ভাত আর ডিমভাজা তুলে দিলো,

: হইছে তুইও খাইতে বস তুলে দেওন লাগবো না।

:বসতাছি, আপনে খান...

: না অক্ষণ বস, আর তোরে না কইছি আমারে আপনে আপনে করবি না, নিজের মানুষরে কেউ আপনি কয়?

: আচ্ছা কমুনে কিন্তু আমার তো শরম করে

: বিয়ার দুই বছর পরও শরম করে!

: নেন, টেংরা মাছের সালুন দিয়া খান, বইলা টেংরা মাছ তুইলা দিল রহমতের পাতে। বৃষ্টি আরো জোরেশোরে নামলো।

আজকে অনেক দিন পর রাতে রহমত রেজিনাকে ভাসিয়ে আদর সোহাগ করলো, রেজিনা লজ্জায় কোন কথা বলতে পারছে না, একটা সুতা গায়ে নাই কারোর গায়ে, ভারী নিঃশ্বাস শুধু, একটা সময় পর রহমত তাকে জড়ায়ে ধরে নাক ডেকে ঘুম, একটানা বৃষ্টির মধ্যে বিদ্যুৎ চমকানোর আলোতে রহমতের মুখ দেখে রেজিনার এত্ত মায়া লাগলো।
এই মানুষটারে সে অনেক ভালোবাসে কিন্তু বলতে পারে নাই কখনই।

ভোর বেলায় রহমতের মোবাইল বাজতেছে, তার ছোটবোন জোবেদা ফোন দিছে, জামা কাপড় ঠিক কইরা রহমতকে ডাকলো, রহমত ধড়ফড় করে উইঠা ফোন ধরতেই ওই পাশ থেকে জোবেদার তার কান্নার শব্দ আসলো

: কি রে কান্দিস কেন? কি হইছে? আব্বা আম্মা ভালো তো?

রহিম সিএনজি এক্সিডেন্ট করছে ভাইজান হসপিটালে অবস্থা ভালো না, অনেক টাকা লাগবো, রক্ত লাগবো, আব্বা আম্মা কাইল থাইকা কানতাছে, এখন ২০ হাজার করতে পারবা? ডাক্তার বলতেছে অপারেশন করা লাগবো, অনেক টাকা

: কস কি? এখন কেমন আছে রহিম? জ্ঞান আছে? বিশ হাজার তো অনেক টাকা, দেখি কি করা যায়...

: জোবেডা কানতেসে, টাকা ছাড়াতো চিকিৎসা হবে না ভাইজান, কিছু একটা কর, রহিম মইরা যাইতেছে...

: আচ্ছা চিন্তা করিস না, একটা ব্যবস্থা হইবে..
এখন মোবাইল রাখ, আব্বা আম্মার দিকে খেয়াল রাখিস।

রোজিনার মুখ শুকিয়ে গেলো, বিপদ আর বিপদ...

: কিছু মনে করিস না বউ, দশ হাজার টাকা জমায় ছিলাম, ভাবছিলাম আরো কিছু জমলে সামনের মেরেজ দে তে তোরে একটা আলমারি কিনা দিমু, কিন্তু এখন তো রহিম অ্যাক্সিডেন্ট করছে টাকা দেওন লাগবো, জোগাড় করমু তাও জানি না, এবারও মনে হয় তোরে কিছু দিতে পারলাম নারে, উল্টা আসার পর থেকে তুই নিজেই খাইটা মরস।

: ছি ছি আপনি এইডা কি কন, বাইচা থাকলে আলমারি পরে কিনন যাইবো, আগে তো রহিম বাঁচুক, মানুষের জান আগে।আমার কাছে সাত হাজার টাকা আছে, জমাইছিলাম আমিও আপনের লাগি কিছু কেনার লাইগা, এইটাও নেন তার সাথে আরো তিন হাজার যোগাড় কইরা পাঠায় দেন বিকাশে।

: বউ তু্ই খুব ভালা রে, আমার জীবনে কি ফোন নিয়েছে জানি না তোর মতো একটা লক্ষ্মী বউ পাইছি, তোরে আমি অনেক ভালোবাসি।

: আমি জানি, চলেন উঠি, কামে যাওন লাগবো...
রেজিনা উঠে গেলো কৌটা থেকে সাত হাজার টাকা বের করে রহমতের হাতে দিলো, এরপর গোসলে গেলো, বাইর হইয়া খাওয়া গুছিয়ে কাজের দিকে রওনা হইলো, ততক্ষণের রহমত ও উঠে টাকা গুছায়ে রিকশা নিয়ে বাহির হইছে।

এভাবেই ৫-৬ দিন পার হয়ে গেলো, রহিমের অপারেশন হইছে, এখনো হসপিটালে তবে অবস্থা ভালো। রহমত রেজিনার বিবাহ বার্ষিকী আজ, কিন্তু কারো মনে হাসি নাই, দুজনেই চুপচাপ যার যার কাজে বাইর হইয়া গেলো। রহমত কইল আজকে আইসা রানদিস না কিছু আমি বাহির থন খাওয়া কিনা আনমু। রেজিনা মাথা নেড়ে সায় দিলো শুধু।

আজকে এক খালাম্মার মেয়ে চলে যাইবো বিদেশ, সে একটা বিশাল বড় টিভি কিনে আনছে বাপ মার জন্য, খালাম্মা চিল্লাইতেছে কি দরকার আছিল আমরা কি অত টিভি দেখি? তার মেয়ে বললো আম্মা আমাদেরকে কোন
শখ আহ্লাদ নাই? তুমি আর আব্বু আমাদের জন্য কত কিছু করছ, একটু ইচ্ছা করো না তোমাদের জন্য কিছু করি এখন তো আমি চাকরি করি। এটা নিয়ে আর একটা কথাও না আমরা এখন ব্যাগ গোছাচ্ছি, ঘণ্টা দুয়েক পর বের হব।
আর রেজিনা শোন, তোমার বাসায় কি টিভি আছে?

: রেজিনা ঢোক গিলে বলল, না আপা...
এই নাও দুই হাজার টাকা তোমার বকশিশ, আর আজকে যাওয়ার সময় এই পুরনো টিভিটা তুমি রিমোটসহ নিয়ে যেও, রিকশায় যেতে পারলে ভালো না পারলে বলো ড্রাইভার দিয়ে আসবে।

রেজিনা খুশিতে চোখে পানি চলে আসলো সে হাউমাউ করে কান্না শুরু করলো....

কি হলো তুমি কাঁদছো কেন?

খুশিতে আপা খুশিতে, একটা টিভির অনেক দিনের শখ আছিল, কিন্তু আমরা গরিব মানুষ, নুন আনতে পান্তা ফুরায় কিছুতেই কুলায় উঠতে পারতেছিলাম না, আল্লাহ আপনার ভালো করুক, মনের ইচ্ছা পূর্ণ করুক। আমগো লাগি দোয়ায় রাইখেন। কাজ শেষে রেজিনাকে ঐ বাড়ির ড্রাইভার টিভিসহ বাড়িতে পৌঁছায় দিলো।

বাড়িতে ঢুকতে দেখে দরজা খোলা, রহমত আগেই আইসা পরছে, ঘরে একটা স্টিল এর আলমারি ঝক ঝক করতাছে।
আলমারি দেখে রেজিনা খুবই অবাক হলো, টিভি দেখে রহমত। ড্রাইভার চলে যাওয়ার পর রেজিনা হড়বড় করে বললো টিভির কাহিনি, হাতের ব্যাগ থেকে রিমোট বের করে রহমতকে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করল আপনে টাকা পাইলেন কই আলমারি কেনার।

: কর্য কইরা কিনছি, মাসে এক হাজার কইরা শোধ দেব। চিন্তা করিস না, এমনেই আমাদের ছোট ছোট সাধগুলা পূর্ণ করা লাগবো। নয়তো একদিন দেখবি, আমগো টাকা হইছে কিন্তু বুইড়া হইয়া গেছি, মনের মধ্যে সাধ নাই।

তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে আয় চাইনিজ খাওয়া কিন্না আনছি, খাইয়া দেখ কেমুন।

অনেকদিন পর জহরী মহল্লার ছাপড়া ঘরে দুজন মানব মানবীর মধ্যে সত্যিকারের হাসি ফুটে উঠলো। খুবই আনন্দিত মনে, হাসিমুখে তারা চাইনিজ খাচ্ছে, কি অসম্ভব সুন্দর দৃশ্য।

এই গল্পটা এইবারে ২০২৪ বইমেলায় ‘ণ-ত্ব বিধান ষ-ত্ব মায়া’ বইটিতে আছে

এমআরএম/জিকেএস