আয় তবে সহচরী
‘নুরু, পুশি, আয়েশা, শফি সবাই এসেছে
আম বাগিচার তলায় যেন তারা হেসেছে।’
প্রাথমিকের কোনো এক শ্রেণিতে গোলাম মোস্তফার বনভোজন কবিতাটা পড়েছিলাম। পড়ার সাথে সাথে কথাগুলো আমাদের মনে গেঁথে গিয়েছিল। কারণ আমাদের গ্রামে তখন পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল হুবহু একই পরিবেশ। পদ্মার একটা পলিমাখা চর ছিল আমাদের গ্রাম। নাম চরভবানীপুর।
নামের আগে চর শব্দটা গ্রামের প্রকৃতি বোঝার জন্য যথেষ্ট। গ্রামে ধূলিমাখা রাস্তাঘাট। ছনের বেড়া এবং চালের বাড়িঘর। বাড়ির পেছনে অবারিত মাঠ। সেখানে কখনও ফলে ধান, কখনও গম আবার কখনও বা বাহারি চৈতালি শস্য। ক্ষেতের আইলে আইলে বাবলাগাছ। ক্ষেতে কাজ করতে আসা মানুষেরা সেই গাছের ছায়ায় বসে দুপুরের খাবার খেয়ে একটু জিড়িয়ে নেয়।
আবার এই গাছের ছায়ায় বসেই রাখাল তার গরুগুলো দেখাশোনা করে। কখনওবা অবসরে বাঁশিতে সুর তোলে। কখনও একটু বেশি অবসর পেলে কাঁধের গামছা বিছিয়ে মেতে উঠে তাস বা লুডু খেলায়। আবার কেউ কেউ মাটিতে কাঠির দাগ দিয়ে মেতে উঠে ষোলগুটি বা বাঘবন্দি খেলায়। অনেকসময় এসব গাছের ছায়াতেই বসে মিছামিছি বনভোজনের আসরও। সেখানে ছেলেরা বাজার করে আনে বাহারি চাল, ডাল, তরকারি। আর মেয়েরা বসে যায় রান্নায়।
প্রবাসী দ্বিতীয় প্রজন্মের দলবেঁধে ইউএনও খেলা
এরপর একসময় রান্না শেষ হয়। তখন উৎসব করে চলে সেই মিছামিছি খাবার খাওয়া। এই খাবার খাওয়ার একটা ধরণ আছে। খাবারটাকে সামনে নিয়ে নিচের ঠোঁটটাকে ভাঁজ করে ভেতরে নিয়ে চপচপ করে এক ধরনের শব্দ করা হয়। খাবার শেষে অবশ্যই রান্নার প্রশংসা করতে হয় নাহলে আবার রাঁধুনি মন খারাপ করে।
গ্রাম বাংলায় একটা সময় সই বা মিতে পাতানোর বহুল চল ছিল। একই নামের মেয়েদের মধ্যে সই পাতানো হতো আর ছেলেদের মধ্যে পাতানো হতো মিতে। মিতে শব্দটাই শহর অঞ্চলে এসে মিতা এবং সেখান থেকেই মিতালি বা বন্ধুত্বের কথা এসেছে বলেই আমার ধারণা। সেই মিতালি করার শহরে অনেক ধরনের সুযোগ ছিল। তারই হাত ধরে একসময় শহরে ‘পত্র মিতালি’র যুগ ছিল। কিন্তু গ্রামে অভিভাবকরা একই নামের ছেলে বা মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব করিয়ে দিতেন।
এরপর দুটো পরিবারের মধ্যে একটা অদৃশ্য আত্মীয়তার বন্ধন তৈরি হয়ে যেত। বিশেষ বিশেষ উপলক্ষে দুই পরিবারের মধ্যে চলতো উপহার আদান প্রদান। আমি দেখেছি আমার মায়েরও একজন সই ছিল। আমি একবার সৌভাগ্যক্রমে উনার ছেলের সাথে পরিচিত হয়েছিলাম। সেও ছিল আমার বয়সী। গ্রামে থাকলে হয়তোবা এখনও সেই পরিবারটার সাথে আমাদের যোগাযোগ থাকতো।
এই দুই পরিবারের মধ্যে প্রায়শই আয়োজন করা হতো বনভোজন বা চড়ুইভাতির। তখন খুবই সাধারণভাবে কিছু খাবার ছোটরা মিলে রান্না করতো। মাঝে মধ্যে বড়রা এসে একটু সাহায্য করতেন শুধু। সেখানে ভাতের সাথে তরকারি হিসেবে বেশিরভাগ সময়ই রান্না করা হতো ডিমের তরকারি। কারণ গ্রামে প্রায় প্রত্যেকটা বাড়িতেই হাঁসমুরগী পোষা হয়। তারা নিয়মিত বিরতিতে ডিমও দেয়।
প্রবাসী দ্বিতীয় প্রজন্মের মোবাইলে ধাঁধা খেলা
তাই চড়ুইভাতির এই আবদার মেটানো ছিল মায়েদের জন্য খুবই সহজসাধ্য। এরপর আমরা সবাই একসময় বড় হয়ে যায় কিন্তু চড়ুইভাতি বা বনভোজনের ছবি স্মৃতি হয়ে থেকে যায় আমার মস্তিষ্কে। গতবছর দেশে বেড়াতে যেয়ে মিছামিছি চড়ুইভাতির আগের সেই চিত্র দেখেছি আমাদের গ্রামের বাড়িতে। আবার একইচিত্র দেখেছি স্বয়ং ঢাকা শহরেও। দেখে কেমন যেন স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছিলাম।
প্রবাসের যান্ত্রিক জীবনে পুরো সপ্তাহটা যায় কাজের ব্যস্ততায়। চলমান কাজের এই ক্লান্তিকে পাশ কাটাতে প্রবাসীরা সপ্তাহান্তে নিজেদের মধ্যে আয়োজন করে পুনর্মিলনীর। প্রবাসীরা নিজেদের ছোট ছোট অংশের মধ্যে তখন খুঁজে নেন একটু অবসর। প্রবাসে দেশের এলাকাভিত্তিক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক, প্রাক্তন কাজের স্থানভিত্তিক অনেক দল এবং সংগঠন বিদ্যমান। এছাড়াও আছে বিভিন্ন ধরণের সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সংগঠন।
সবাই মিলে কোন পার্কে বা সৈকতে আবার কখনওবা কোন কমিউনিটি হলে জড়ো হয়ে আনন্দ করেন ছোটবড় সকলে মিলে। আমাদের মধ্যেও একই বিষয়ের একটা ছোট দল আছে। আমাদের মধ্যে তাই প্রায়ঃশই চলে ছোটখাটো অনানুষ্ঠানিক আয়োজন।
এই আয়োজনে আমাদের পাশাপাশি আমাদের স্ত্রী, পুত্র, কন্যারাও যোগ দেন। এমনকি অনেকসময় যোগ দেন দেশ থেকে আসা আমাদের অভিভাবকগণও। আমরা বন্ধুরা দেখা যাচ্ছে নিজেদের মধ্যে আড্ডা দিচ্ছি।
পাশাপাশি আমাদের স্ত্রীরা নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করেন। অন্যদিকে ছোটরা নিজেদের বয়স অনুযায়ী নিজেরাই বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে খেলাধুলা করতে থাকে। আমরা সেখানে ক্রিকেট, ফুটবলের পাশাপাশি তাস, লুডুও খেলে থাকি। আমাদের দেখাদেখি পরবর্তী প্রজন্মের সদস্যরাও নিজেদের মধ্যে এই খেলাগুলো খেলার চেষ্টা করে। প্রযুক্তির উৎকর্ষতার এই যুগে সবকিছুই এখন মোবাইল বা আইপ্যাডে পাওয়া যায়। এমনকি তাস, লুডুও ডিভাইস দিয়ে খেলা যায়।
এছাড়াও আছে অনেক নতুন নতুন খেলা। একবার দেখলাম ছোটরা সবাই গোল হয়ে বসে ইউএনও খেলছে। কার্ডগুলো দেখতে তাসের মতো হলেও নিয়ম-কানুন আলাদা। আবার একদিন দেখলাম একজন মোবাইল টা দুই হাত দিয়ে উঁচু করে মাথার ওপর ধরে আছে। সেখানে একটা নাম উঠে আছে। বাকিরা সেই নামের সাথে মিলিয়ে একটা একটা করে তথ্য বলছে। আর সেই তথ্যগুলো থেকে যে মোবাইলে ধরে আছে সে নামটা অনুমান করে বলার চেষ্টা করছে।
চরভবানীপুরে একটি শিশুর চড়ুইভাতি খেলা
এছাড়াও ওরা মাঝে মধ্যে আমাদের মতো বসে যায় সত্যিকারের তাস বা লুডু নিয়েও। এছাড়াও মাঝে মধ্যেই আমাদের সাথে দুই দলে ভাগ হয়ে মেতে উঠে ক্রিকেট বা ফুটবল নিয়ে। সেখানে ছেলেমেয়ের কোন বিভেদ থাকে না। এ যেন ঠিক আমাদের শৈশবের পুনঃনির্মাণ।
আমাদের স্ত্রীরাও মাঝে মধ্যেই রান্নায় সহযোগিতা করার পাশাপাশি বসে পড়েন লুডু নিয়ে। তখন তাদের দেখলে মনে হয় যেন সবাই প্রাথমিকের ধাপ পেরোনো সব কিশোরী। খেলার মধ্যে চুরি, চুরি ধরা এসব নিয়েও চলে খুঁনসুটি। আমরাও মাঝেমধ্যে তাদের এইসব খেলাধুলা দেখে ফোঁড়ন কাটি। উনারাও মাঝে মধ্যে আমাদের আড্ডায় সামিল হয়ে টিকা টিপ্পনি দিতে ভুল করেন না।
মাঝে মধ্যে চলে যুগল খেলা। যেখানে স্বামীকে তার স্ত্রীর পছন্দের বিষয় জিজ্ঞেস করা হয়। আবার কখনওবা স্ত্রীকে স্বামীর কোন কাজের সম্মন্ধে জিজ্ঞেস করা হয়। মজার ব্যাপার এই ধাঁধাতে প্রায় সময়ই সবাই সঠিক উত্তর দেয়। আসলে এক যুগেরও বেশি সময় একই ছাদের তলে থাকলে অবধারিতভাবেই অন্য মানুষটার স্বভাবচরিত্র মোটামুটি জানা হয়ে যায়।
প্রবাসী মায়েদের সাপ-লুডু খেলা
আমাদের মিতালি বা বন্ধুত্ব আমাদের ছাড়িয়ে আমাদের স্ত্রী সন্তানদের মধ্যে এমনকি অনেকসময় আমাদের অভিভাবকদের মধ্যেও ছড়িয়ে গেছে। তার মানে হিসাব করলে আমাদের পুনর্মিলনীগুলো তিন প্রজন্মের মিলনমেলায় পরিণত হয়। আমাদের চড়ুইভাতি বা বনভোজনে রান্না করা খাবারও যেন তাই একটু বেশি সুস্বাদুই হয়।
আর এইসব কর্মযজ্ঞে ছোটবড় সবাই মিলেই হাত লাগায় ফলে সেটা হয়ে উঠে আরও বেশি উপভোগ্য। তখন আমাদের মনের মধ্যে যেন বেজে উঠে কবিগুরুর সেই গান
‘আয় তবে সহচরী, হাতে হাতে ধরি ধরি
নাচিবি ঘিরি ঘিরি, গাহিবি গান।’
এমআরএম/জিকেএস