সুইডেনের অজানা তথ্য
ওয়েস্টার্ন ইউরোপে যারা রোরমকারে (প্লাম্বার), ব্রান্ডম্যান (দমকলকর্মী), সিনিক্কারে (কাঠমিস্ত্রি), ইলেকট্রিকার (বৈদ্যুতিক) কিংবা স্ক্রার্দারে (দর্জি) তারা নবম শ্রেণি পাশ করার পর দুই তিন বছরের পেশাগত প্রশিক্ষণ শেষে কর্মে নিযুক্ত হয়।
আমরা সবসময় উচ্চশিক্ষা আর শিক্ষিতদের জীবন কাহিনি নিয়েই ব্যস্ত থাকি। এর ফলে জানা হয় না কম শিক্ষিতদের লাইফ স্টাইল সম্পর্কে। আজ কিছু অজানা তথ্য তুলে ধরব সুইডেনের বিশেষ কিছু কর্মীদের জীবন ব্যবস্থা। আমি গত মাসে স্টকহোম শহর ছেড়ে একটু গ্রামের দিকে মুভ করেছি। নতুন বাসা সত্ত্বেও ছোটখাটো অনেক কাজ করা লেগেছে সবকিছু অ্যাডজাস্ট করতে।
গত কয়েকদিন আগে একজন প্লাম্বার এসেছিল আমার বাড়িতে। তার কাজ ছিল টয়লেটের বেসিন সেট করার পাশাপাশি বাথরুমের অন্যান্য সব কাজ করা। সবমিলে আট ঘণ্টা সময় নিয়ে সে সব কাজ শেষ করেছে। ছেলেটির নাম দানিয়েল, বয়স ত্রিশ বছর। তার সারা শরীরে ট্যাটু, চেহারায় সুপুরুষ। এসেছে কাজে, সঙ্গে নিয়ে এসেছে ছোট একটি কুকুর। আমাকে বললো, তার কুকুর তার সঙ্গে থাকে, সে খুব লক্ষ্মী, আমার যদি অ্যলার্জি সমস্যা না থাকে তবে সে তার সঙ্গেই থাকবে।
আমি বললাম, ঠিক আছে, আমার কোনো সমস্যা নেই। ডানিয়েল কাজ করছে, আমি দেখছি, মাঝে মধ্যে তার কিছু দরকার হলে সাহায্য করছি। বললাম, কফি খাবে? সে উত্তরে বললো, ক্যাফে ল্যাতে হবে? আমি বললাম অবশ্যই। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে আমাদের মধ্যকার জড়তা কেটে গেল এবং আমরা নানা বিষয়ের উপর কথা বলতে শুরু করলাম। কাজের ফাঁকে হঠাৎ হাতের ঘড়িটি খুলে পাশে রেখেছে ‘রোলেক্স’।
জিজ্ঞেস করলাম, তোমার ঘড়িটির দাম কত? বললো দেড় লাখ ক্রোনার। আমার এখানে সে এসেছে নিজের বিএমডব্লিউ গাড়ি নিয়ে। পোশাক আশাক থেকে শুরু করে তার পুরো লাইফস্টাইল দেখে মনে মনে আমার বড় ভাই প্রফেসর ড. মান্নান মৃধার একটি স্মৃতিচারণের কথা মনে পড়ে গেল। আমি ভাবছি। ঠিক তেমন সময় ডানিয়েলের ফোন এসেছে। ডানিয়েল খুব সংক্ষেপে কথা শেষ করলো। আমাকে জানালো মলিন নামে একটি মেয়ে ফোন করেছে।
জিজ্ঞেস করলাম, মলিন কে? উত্তরে বললো, মলিন তার বান্ধবী। আরো বললো, মলিন আমার প্রেমিকা এবং সামারে আমরা বিয়ে করবো। জিজ্ঞেস করলাম, তা মলিন কী করে? ডানিয়েল বললো, সে নিউরোলজিস্ট।
ডানিয়েলের সঙ্গে কথা বলে অনেক কিছু জানলাম, তার নিজের কাজে যেমন দক্ষতা পাশাপাশি পৃথিবীর কোথায় কী ঘটছে তা তার অজানা নয়। আট ঘণ্টা কাজের বিল হাতে ধরিয়ে দিল, সব মিলে বিল হয়েছে চৌদ্দ হাজার ক্রোনার, তার মধ্যে ডানিয়েলের মজুরি নয় হাজার পাঁচশো ক্রোনার। বুঝতে সমস্যা থাকার কথা নয় কেন তার হাতে রোলেক্স বা সে কেন বিএমডব্লিউ গাড়ি ব্যবহার করে।
পাঠক, বলছিলাম মান্নান মৃধার স্মৃতিচারণের কথা। বছর খানেক আগে আমার বড় ভাই প্রফেসর ড. মান্নান মৃধা গল্প করেছিলেন। তার কাজের এক কলিগকে নিয়ে। কলিগের নাম গুন্নার। গুন্নার কেটিএইস (KTH, Royal Institute of Technology)-তে ক্লিনার হিসেবে কাজ করেন, যে প্রতিষ্ঠানে ড. মান্নান মৃধা শিক্ষক। গুন্নার প্রতিদিন ড. মান্নান মৃধার রুমে এসে ডাস্টবিন এবং রুম পরিষ্কার করেন।
কাজের ফাঁকে তাদের মাঝে হাই বাই হয়। গুন্নার কাজ শুরু করেন সকাল নয়টায় এবং কাজ শেষ করেন দুপুর তিনটায়। কাজ শেষে কেটিএইস থেকে গোসল সেরে তিনি তার ফ্রি সময়ে চলে য়ান, যা হতে পারে বন্ধু-বান্ধবীর সঙ্গে সিনেমা বা ডিস্কোতে। প্রফেসর মৃধা একটু মজা করে গল্পের যে অংশটি বলেছিলেন সেটা হলো গুন্নার তার “2019 Porsche 912” পার্ক করেন ঠিক প্রফেসর সাহেবের রুমের সামনে।
পোর্সে স্পোর্টস কার অন্যান্য গাড়ির তুলনায় একটু গর্জন তর্জন করে যখন গাড়ি স্টার্ট দেয়া হয়, যা অনেকের নজর কেড়ে নিতে বাধ্য করে। গুন্নারের লাইফ স্টাইল প্রফেসর সাহেবের মনে লাগার দুটো কারণ। এক, তার গাড়ির শব্দ এবং দুই, সকাল নয়টায় কাজ শুরু করেন দুপুর তিনটায় শেষ। অন্যদিকে প্রফেসর ড. মান্নান মৃধা প্রতিদিন বাসা থেকে বের হন সকাল সাতটায়, ট্রেনে বসে বসে প্রিপারেশন বা অন্যান্য কাজ সেরে অফিসে ঢোকেন আটটায়, তারপর ল্যাব, ক্লাস, মিটিং, সব মিলে দিন শেষে সেই ট্রেনে করে বাসায় আসতে আসতে রাত আটটা বাজে।
পরে বাসায় এসে রান্নাবান্না, খাওয়া-দাওয়া, ডিসিং ওয়াসিং সেরে সকালের ক্লাসের জন্য প্রিপারেশন। সবশেষে লেট নাইটে বিছানা। তারপর নতুন দিন, নতুন চ্যালেঞ্জ। ছাত্র জীবন কেটেছে প্রতিযোগিতায় কারণ তিনি ছিলেন দেশের সেরাদের তালিকায় সেরা।
এখন প্রশিক্ষণে একইভাবে কাজ আর কাজ! গুন্নার বেছে নিয়েছেন এক জীবন, অন্যদিকে প্রফেসর ড. মান্নান মৃধা বেছে নিয়েছেন আরেক জীবন। গুন্নার সুখী তার জীবনে, প্রফেসর মৃধা সুখী তার জীবনে। অতএব, Life is a choice, it’s up to you how do you prefer to live in!
লেখক : রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন। [email protected]
এমআরএম/জিকেএস