ভিডিও EN
  1. Home/
  2. প্রবাস

করোনার দ্বিতীয় বর্ষে কেমন বাজেট প্রয়োজন

প্রবাস ডেস্ক | প্রকাশিত: ০৮:০০ পিএম, ০৬ মে ২০২১

মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, সাবেক সিনিয়র সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান, বর্তমানে জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত

বাজেট প্রণয়ন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। মূলত নভেম্বর-ডিসেম্বরেই পরবর্তী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের প্রস্তুতিমূলক কাজ শুরু করে অর্থ বিভাগ। পরিকল্পনা কমিশনসহ সব মন্ত্রণালয় এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। সব মন্ত্রণালয় মিলে আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রণয়ন ও নির্ধারণ, উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও সম্ভাব্য ব্যয় নির্ধারণ এবং সরকারের দীর্ঘমেয়াদি উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বাস্তবায়নের কৌশল নির্ধারণ করত অর্থ বিভাগকে প্রয়োজনীয় তথ্যাবলি সরবরাহ করে বাজেট প্রণয়নে সহায়তা করে।

মূলত এপ্রিলের মধ্যেই সার্বিক রূপরেখা প্রণয়ন সম্পন্ন হয়, যা পরবর্তী সময়ে সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে উপস্থাপনপূর্বক অনুমোদন গ্রহণ করা হয়। প্রস্তুতকৃত এ বাজেট জুনের প্রথম সপ্তাহে সংসদে উপস্থাপন করা হয়, যা পর্যালোচনা শেষে জুনের শেষ দিকে সংসদ কর্তৃক পাস হয়।

বাজেটের শুল্ক কর নির্ধারণসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশটি সম্পন্ন করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের অধীন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। শুল্ক কর নির্ধারণ বিষয়েই বৃহৎ জনগোষ্ঠী ও ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ ও আগ্রহ অধিক লক্ষ্য করা যায়। কারণ ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনা এবং বাজেট বছরে অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে।

এবারের ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট এমন এক সময়ে প্রণীত হচ্ছে, যখন সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশও করোনা মহামারির কারণে মহাবিপর্যয়ের সম্মুখীন। শুধু সরকারের ব্যয় নির্ধারণ ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নই নয়, এবারের বাজেটে করোনা মহামারির কারণে সৃষ্ট ব্যবসায়িক ক্ষতি, রফতানি সংকোচন, নতুন দারিদ্র্য, কর্মসংস্থান সংকোচন ইত্যাদির উত্তরণের জন্য বরাদ্দ ও নীতিসহায়তা থাকতে হবে।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত অর্থনৈতিক কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল সভার সূত্রে সংবাদপত্র মারফত আগামী অর্থবছরের বাজেট সম্পর্কে একটি প্রাথমিক ধারণা পাওয়া গেছে। এবারের বাজেটের আকার হতে পারে ৬ লাখ ২ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা বেশি এবং সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ৬৪ হাজার কোটি টাকা বেশি।

বাজেট ঘাটতি অনুমান করা হয়েছে ২ লাখ ১৩ হাজার ৮০২ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। এত বড় বাজেট ঘাটতি নিকট অতীতে দেখা যায়নি। বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অনুমান করা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ২ লাখ ২৫ হাজার ১২৪ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে স্থিরকৃত প্রবৃদ্ধি সংশোধন করে ৬ দশমিক ১ শতাংশ ধরা হয়েছে। চলমান করোনা মহামারির কারণে সৃষ্ট অর্থনেতিক মন্দার কারণে আগের অনুমিত ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিম্নমুখী সংশোধন করা হয়েছে।

প্রস্তাবিত বাজেট বিষয়ে এরই মধ্যে অর্থনীতিবিদ, থিংকট্যাংক ও মিডিয়ায় যেসব আলোচনা হয়েছে, সেসব আলোচনায় বাজেট অগ্রাধিকার হিসেবে করোনার ক্ষতি মোকাবিলায় স্বাস্থ্য, কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য মোকাবিলায় সামাজিক সুরক্ষায় অধিক বরাদ্দের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

গত এপ্রিল ২০২১-এ সমাপ্ত একটি জরিপে সিপিডি বলেছে, করোনায় দেশে দেড় কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) যৌথ গবেষণায় আরো ভয়াবহ ভিন্ন চিত্র উঠে এসেছে।

এ গবেষণা বলছে, কোভিডের আঘাতে দেশে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ। গ্রামাঞ্চলের তুলনায় (৪৪ শতাংশ) শহরাঞ্চলে (৫৯ শতাংশ) দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেশি বেড়েছে।

সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে নগদ সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে অতি দরিদ্র জনগণকে অনাহার থেকে রক্ষা করার পরামর্শ পাওয়া যাচ্ছে। এরই মধ্যে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের আভাস পাওয়া গেছে, যা চলতি অর্থবছরের এ খাতে বরাদ্দের তুলনায় ৭ হাজার কোটি টাকা বেশি।

এ খাতের ক্ষেত্র সম্প্রসারিত করে বর্তমান উপকারভোগী পেনশনভোগী, মুক্তিযোদ্ধা, বয়স্ক নাগরিক ও স্বামী পরিত্যক্তা নারী ছাড়াও নতুনভাবে অতি দরিদ্র হওয়া মানুষকেও চিহ্নিত করে নগদ সহায়তার অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। সেক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ আরো বাড়ানো যেতে পারে।

গত মার্চ ২০২০ থেকে অদ্যাবধি এক বছরেরও অধিক সময় করোনা মহামারির কারণে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ধীরগতি ও আংশিক স্থবিরতার ফলে বর্তমান অর্থবছরের (২০২০-২১) বাজেট বাস্তবায়ন আশানুরূপ হয়নি, সে কারণে দেশ বড় বাজেটের ফল ভোগ করতে পারছে না।

তবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অব্যয়িত অর্থ হতে সংস্থান করে সংশোধিত বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা ও নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে বর্তমান অর্থবছরের অবশিষ্ট দুই মাস ক্র্যাশ প্রোগ্রামের মাধ্যমে এককালীন বা দুই-তিন কিস্তি নগদ সহায়তা বিতরণ করে কর্মহীন, দরিদ্র মানুষকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষার পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে, যা আগামী বছরেও অব্যাহত থাকবে।

এসব লোক স্থায়ীভাবে নগদ সহায়তার অন্তর্ভুক্ত হবে না। বরং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ও কর্মসংস্থান হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত রাখলেই চলবে। দীর্ঘমেয়াদি অগ্রগতি ও প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যের পাশাপাশি বর্তমান সাময়িক সংকট মোকাবিলা ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বাঁচিয়ে রাখাও সরকারের কর্তব্য।

কর্মসংস্থান সংকোচনের কারণে আগামী বাজেটে স্বাস্থ্য, কৃষি, সমাজকল্যাণ, খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে বিনিয়োগের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। শুধু বরাদ্দ বৃদ্ধিই নয়, এসএমই খাতে ব্যাংক থেকে ঋণপ্রাপ্তির প্রতিবন্ধকতা দূর করাও জরুরি।

প্রয়োজনে ২০২০ সালের ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ সম্প্রসারণ ও সংশোধনপূর্বক ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র শিল্প ও স্টার্টআপ ক্ষুদ্র উদ্যোগে বিনা জামানতে এককালীন বরাদ্দের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। নারী ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণ ও এককালীন সহায়তা প্রাপ্তির বিষয়েও বিশেষ নজর দিতে হবে। এসএমই ফাউন্ডেশনের ঋণ প্রদান সক্ষমতা ও কার্যক্রম বৃদ্ধির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, এসএমই ফাউন্ডেশনের প্রদত্ত ঋণ ক্ষুদ্র শিল্পের পুনর্বাসন ও বিকাশে খুবই সহায়ক।

বাজেটের আকার বৃদ্ধির পাশাপাশি বাস্তবায়নের সক্ষমতার ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। সেজন্য বাস্তবায়নাধীন মেগা প্রকল্পসহ অন্যান্য প্রকল্পে পর্যাপ্ত বরাদ্দ থাকতে হবে। কর্মসংস্থান ধরে রাখার জন্য সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই এডিপির বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয়গুলোকে অধিকতর মনোযোগী হতে হবে।

স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বাস্তবায়নে সক্ষমতা আরো বাড়ানো এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। করোনা মোকাবিলায় হাসপাতালগুলোর যেসব অবকাঠামোগত দুর্বলতা যেমন প্রয়োজনীয় ভেন্টিলেটর, আইসিইউ, অক্সিজেন সরবরাহ সুবিধা, এক্স-রে ও সিটি স্ক্যান মেশিন ইত্যাদির অপর্যাপ্ততা লক্ষ করা গেছে, আগামী অর্থবছরে পর্যাপ্ত বরাদ্দের মাধ্যমে এবং সুষ্ঠু ক্রয় প্রক্রিয়া অবলম্বন করে হাসপাতালগুলোকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে হবে।

তাছাড়া জেলা থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত স্থাপিত হাসপাতাল, ক্লিনিক ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী, যন্ত্রপাতি ও ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।

করোনা মহামারিতেও কৃষি ও গ্রামীণ অবকাঠামো খাতে বর্তমান বছরের বাজেট বাস্তবায়ন তুলনামূলক ভালো হয়েছে। অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে কৃষি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কৃষি খাতে চলমান ভর্তুকি ও নানা সুযোগ-সুবিধা অব্যাহত রেখে, প্রয়োজনে নতুন সুবিধা সৃষ্টি করে তথা প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতি পোষানোর জন্য নগদ সহায়তা চালু করে কৃষি খাতের অগ্রগতি ধরে রাখতে হবে।

এবার রাজস্ব সংগ্রহ ও রাজস্বনীতির বিষয়ে দৃষ্টি দেয়া যাক। বাজেটের আকার বড় হলে রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রাও বাড়াতে হয়। অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহে প্রায় ৮৫ শতাংশ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের মাধ্যমে এনবিআরের সংগ্রহ করে।

এনবিআর রাজস্ব সংগ্রহ দেশের ভোগ চাহিদা ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসার, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান, সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়ন, চলমান সরকারি-বেসরকারি নির্মাণ শিল্পের বিকাশ এবং আমদানি-রফতানি বৃদ্ধি ইত্যাদির ওপর নির্ভরশীল। রাতারাতি রাজস্ব সংগ্রহের উচ্চপ্রবৃদ্ধি সম্ভব নয়। এর আগে বাজেটে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে এনবিআরের সঙ্গে আলোচনা করা হত।

কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে এনবিআরের মতামতের প্রতি তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। সেজন্য বছরান্তে বিরাট রাজস্ব ঘাটতি দেখা যায়। অদূরভবিষ্যতে করোনার প্রকোপ কমে গেলে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতি চাঙ্গা হবে, এরূপ ধারণায় আগামী অর্থবছরের সার্বিক রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হচ্ছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার ৭৮ কোটি টাকা।

বর্তমান অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি থেকে কমিয়ে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৫১ হাজার ৫০৮ কোটি টাকা নির্ধারিত হচ্ছে। কিন্তু বর্তমান অর্থবছরে এনবিআর রাজস্ব সংগ্রহে যে নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তাতে এ সংস্থার ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।

খবরে প্রকাশ, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে এনবিআর রাজস্ব প্রবৃদ্ধি পূর্ববর্তী বছরের এ সময়ের তুলনায় ৬ শতাংশ বেশি হলেও রাজস্ব আদায় ঘাটতি প্রায় ৫১ হাজার কোটি টাকা। দেশে-বিদেশে অব্যাহত লকডাউনের কারণে ব্যবসা মন্দা, আমদানি-রফতানি হ্রাস প্রভৃতি কারণে বছরের শেষ প্রান্তিকেও আশানুরূপ রাজস্ব সংগ্রহ হবে না।

সেক্ষেত্রে প্রকৃত রাজস্ব সংগ্রহ মূল লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১ লাখ কোটি টাকা কম হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা স্বাভাবিক থাকলে এবং এনবিআর কর্মচারীরা রাজস্ব সংগ্রহে তত্পর হলে বছরে ১৬-১৮ শতাংশ এমনকি ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আশা করা যায়। অর্থ বিভাগ যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে তাতে প্রায় ৪০ শতাংশ প্রবৃদ্ধির প্রয়োজন, যা কোনো অবস্থায়ই সম্ভব নয়। রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধির জন্য এনবিআরের প্রশাসনিক সংস্কার, আয়কর ও ভ্যাট সংগ্রহে অটোমেশন এবং করজাল বিস্তৃতির কোনো বিকল্প নেই।

রাজস্ব নীতিমালা প্রণয়নে এনবিআরকে লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে যেমন মনোযোগী হতে হবে, অন্যদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়।

রাজস্বনীতিতে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ীরা সেক্ষেত্রে আস্থার সঙ্গে পরিকল্পনা গ্রহণ ও ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে পারেন।

এনবিআর তথা সরকারের বিবেচনার জন্য কতিপয় পরামর্শ নিচে তুলে ধরা হলো।

১. (ক) প্রত্যক্ষ কর আহরণের ক্ষেত্রে করোনা পরিস্থিতির ক্রমাবনতির কারণে করবৃদ্ধি যৌক্তিক হবে না। গত বছর ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা বাড়িয়ে ৩ লাখ টাকা এবং বয়স্ক ও নারীদের ক্ষেত্রে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছিল। এবারো এবং আরো কয়েক বছর করমুক্ত আয়সীমা অপরিবর্তিত রাখা যেতে পারে।

গত বছর আয়করের নিম্নহার ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার ফলে প্রান্তিক করদাতাদের সুবিধা হয়েছে। তবে উচ্চহার ৩০ থেকে ২৫ শতাংশ করায় উচ্চ আয়ের করদাতারা লাভবান হয়েছেন। উপরন্তু করপোরেট করহার ২ দশমিক ৫ শতাংশ কমানোর ফলে সার্বিকভাবে কর আহরণে নিঃসন্দেহে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

গত বছর গৃহীত উল্লিখিত পদক্ষেপে কর আহরণে কী প্রভাব পড়েছে, তা এনবিআর সূক্ষ্মভাবে পর্যালোচনা করতে পারে। কর আহরণ নীতিমালা প্রগ্রেসিভ রাখার স্বার্থে উচ্চকর ৩০ শতাংশ পুনর্বলবৎ করা যেতে পারে। অনেক অর্থনীতিবিদ ও করবিশেষজ্ঞ বিত্তশালীদের আয়ের ও সম্পদের ওপর সম্পদ কর প্রবর্তনের সুপারিশ করেছেন।

১. (খ) করপোরেট করহার আরো কমানোর জন্য এক শ্রেণির ব্যবসায়ী নেতা দাবি তুলেছেন। স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে করপোরেট করহার ২৫ শতাংশ। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর আর্থিক হিসাব তুলনামূলকভাবে স্বচ্ছ, অর্থাৎ দুটি হিসাবের খাতা চালু রাখার সুযোগ নেই।

কাজেই কোম্পানিগুলো স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হয়ে ২৫ শতাংশ করহারের সুযোগ নিতে পারে। বছর বছর করপোরেট করহার কমানোর উদ্যোগ কর আহরণে আত্মঘাতী ফল বয়ে আনতে পারে।

১. (গ). ২০২০-২১ অর্থবছর অপ্রদর্শিত আয় বা কালো টাকা সাদা করার অবারিত সুযোগ দেয়া হয়েছে। এতে এ বছর প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা বৈধ হয়েছে এবং ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত করও সংগৃহীত হয়েছে। আইনটি নিয়ে সমালোচনাও হচ্ছে প্রচুর। অনেকের মতে, এ আইন বলবৎ থাকলে সৎ আয়করদাতারা নিরুৎসাহিত হবেন।

নানা কারণে কখনো কখনো অনেকের উল্লেখযোগ্য অর্থ আয়কর নথিতে অপ্রদর্শিত থেকে যায়। এ সুযোগ গ্রহণ করে অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করে অর্থনীতির মূলধারায় নিয়ে আসা যাবে। এছাড়া অর্থ পাচার রোধে এ আইনের সুযোগ সহায়ক হবে। এ পর্যায়ে শেষবারের মতো আগামী অর্থবছরও এ আইন বলবৎ রাখা যেতে পারে। তবে নৈতিকতার স্বার্থে ১০ শতাংশ হারে আয়করের সঙ্গে অন্তত ৫ শতাংশ জরিমানার বিধান করা যেতে পারে।

১ (ঘ). আয়কর আহরণে অগ্রিম আয়করের ভূমিকা যুগান্তকারী ফল বয়ে এনেছে। নানামুখী চাপ থাকা সত্ত্বেও অগ্রিম আয়কর সংগ্রহের বিধান শিথিল করা উচিত হবে না। অগ্রিম আয়কর রিটার্ন দাখিলের মাধ্যমে সমন্বয়ের সুযোগ বলবৎ রয়েছে।

তবে সঞ্চয়পত্রের মুনাফা থেকে ১০ শতাংশ হারে কর কেটে নেয়া এবং ব্যাংক হিসাবের স্থিতির ওপর এক্সাইজ কর কাটা দারুণভাবে সমালোচিত হচ্ছে। সঞ্চয়পত্রের মুনাফার করহার কমিয়ে ৫ শতাংশ এবং ব্যাংক স্থিতির এক্সাইজ কর বিলোপের বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে।

২. বিনিয়োগ ও দেশীয় শিল্প বিকাশে ক্যাপিটাল মেশিনারিজ ও যন্ত্রাংশ আমদানিতে যে শুল্ককর সুবিধা দীর্ঘদিন ধরে চালু রয়েছে তা অব্যাহত রাখা যেতে পারে। অনুরূপভাবে দেশীয় শিল্পকে প্রণোদনা প্রদান ও প্রতিরক্ষণের জন্য যেসব খাতের উৎপাদনে বিভিন্ন মেয়াদে কর অবকাশ বা হ্রাসকৃত হারে শুল্ক নির্ধারিত আছে তা অব্যাহত রাখাসহ প্রতিশ্রুতিশীল ও উদীয়মান আরো কয়েকটি খাতকে কর অবকাশের আওতায় আনা যেতে পারে।

৩. করোনা, সার্স, ডেঙ্গু, ক্যান্সার প্রভৃতি প্রাণঘাতী রোগের চিকিৎসায় সেসব ওষুধ, মেডিকেল যন্ত্রপাতি ও সামগ্রী ব্যবহূত হয়, সেগুলোর ওপর আরোপিত শুল্ক, অগ্রিম আয়কর ও ভ্যাট প্রত্যাহার বিবেচনা করা যেতে পারে।

৪. নতুন ভ্যাট আইন বলবৎ করার পর আমদানি পর্যায়ে যে অগ্রিম মূসক প্রদানের বিধান করা হয়েছে, তাতে পরবর্তী সময়ে মূসক ফেরত প্রদান সম্পর্কিত কিছু জটিলতার উদ্ভব হয়েছে। উপরন্তু বর্তমান করোনা মহামারির কারণে ব্যবসা মন্দার দরুণ অগ্রিম মূসক একদিকে ব্যবসায়ীদের ওপর আলাদা বোঝা ও ভোক্তাদের ওপর অযৌক্তিক দ্রব্য মূল্যবৃদ্ধির চাপের সৃষ্টি হয়েছে। সে কারণে এ মূসক অগ্রিম দ্রব্যভেদে ২-৩ শতাংশে নামিয়ে আনা যেতে পারে।

৫. মূসক আদায়ে ইএফডি মেশিন স্থাপন একটি ভালো পদক্ষেপ। কিন্তু মেশিন স্থাপনের অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়। এ পর্যন্ত মাত্র তিন হাজার মেশিন স্থাপন করা হয়েছে। আসন্ন অর্থবছরের মধ্যে টেন্ডারকৃত এক লাখ মেশিনই স্থাপনের পদক্ষেপ নিয়ে পরবর্তী সময়ে পর্যায়ক্রমে সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ইএফডি মেশিন স্থাপনের ক্রয় প্রক্রিয়া করা যেতে পারে।

৬. নতুন কাস্টমস আইন ২০১৮-১৯ অর্থবছর সংসদে উত্থাপিত হয়েছিল। সময়ের স্বল্পতায় পাস না হওয়ায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে এটি পুনরায় জাতীয় সংসদে পেশ করা হয়। ওই বছরও পাস হয়নি। ২০২০-২১ অর্থবছরে অর্থ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সুপারিশসহ সংসদে পাস হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। আসন্ন বাজেট অধিবেশনে এনবিআর এবং অর্থমন্ত্রী আইনটি পাসের ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগ নিতে পারেন। রাজস্ব সংগ্রহে গতি আনয়ন ও ব্যবসা সহজ ও সুষমকরণে এ আইন সহায়ক হতে পারে।

৭. আসন্ন বাজেটে শুল্ক ও মূসক বৃদ্ধি যথাসম্ভব পরিহার করতে হবে। রাজস্ব আহরণ ও ব্যবসায়িক প্রয়োজনের জন্য যেসব সীমিতসংখ্যক দ্রব্যাদি শুল্ক ও কর হ্রাস-বৃদ্ধির জন্য নির্বাচন করা হবে, সেসব হ্রাস-বৃদ্ধি কোনো অবস্থায়ই যেন উৎপাদক ও ভোক্তাদের স্বার্থবিরোধী না হয়, এনবিআর কর্মকর্তা ও নীতিনির্ধারকদের সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

শেষ কথা: এবারের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যের তুলনায় করোনা মহামারীর ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষতি ও বিপর্যয় রোধে অধিক পরিমাণ আর্থিক ও নীতিসহায়তা থাকতে হবে।

সম্ভাব্য অপ্রয়োজনীয় এবং পরে করা যাবে এরূপ ব্যয় পরিহার করে একটি বাস্তবায়নযোগ্য বাজেট প্রণয়নই মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। একই সঙ্গে এনবিআরকে কর আহরণের ক্ষেত্র বৃদ্ধি ও রাজস্ব সংগ্রহ প্রক্রিয়া আধুনিকায়নে মনোযোগী হতে হবে। কর-জিডিপি হার বৃদ্ধি এখন সময়ের দাবি।

মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, এনডিসি: সাবেক সিনিয়র সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান, বর্তমানে জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত

এমআরএম/জেআইএম