পর্তুগালে কেমন যাচ্ছে বাংলাদেশিদের জীবন
দীর্ঘদিনের লকডাউন ও জরুরি অবস্থা থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে শুরু করেছে লিসবনসহ সমগ্র পর্তুগাল। দ্বিতীয় ধাপের লকডাউন ১ মে থেকে অনেকটাই শিথিল হয়ে স্বাভাবিক কাজকর্ম, অফিস আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য ও জীবনযাপন শুরু হয়েছে।
খুলছে স্পেনের সঙ্গে বন্ধ থাকা সীমান্ত ও অনেক দেশের সাথে সরাসরি বিমান যোগাযোগ। সবকিছু মিলিয়ে নতুন এক সম্ভাবনার দিন গুনছে পর্তুগালের স্থানীয়সহ বিপুল সংখ্যক অভিবাসী কমিউনিটি।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে পর্তুগিজ সরকার ১৮ মার্চ থেকে প্রথম লকডাউন ঘোষণা করে। ফলে বন্ধ হয়ে যায় পর্যটনসহ বেশিরভাগ ব্যবসা-বাণিজ্য ও কাজ-কর্ম, শুধুমাত্র জরুরি খাদ্য পণ্য ও সেবা ব্যতীত।
দীর্ঘদিন থেকে বাংলাদেশ কমিউনিটি লিসবনসহ সমগ্র পর্তুগালের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহরে পর্যটন শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাজের সঙ্গে জড়িত। বিশেষ করে সুভিনিয়ার ব্যবসা এবং হোটেল ও রেস্টুরেন্টে। তাই প্রথম ধাপে লকডাউনে এসব ব্যবসা ও কাজকর্ম স্থবির হয়ে যায়।
গত বছরের ২ মে থেকে যদিও লকডাউন প্রত্যাহার করা হয় তথাপি ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা, স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন বিধিনিষেধের ফলে অনেকে প্রতিষ্ঠান পুনরায় খুলতেই পারেনি অথবা যারা খুলেছিলেন আশানুরূপ সাড়া না পেয়ে এক পর্যায়ে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন।
আর যারা কাজ করছিলেন তারা পুনরায় কাজে যোগ দেয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। কিছু কিছু কোম্পানি ও তাদের কর্মীরা লে-অফের সুবিধা পেলেও বেশিরভাগ কর্মী ছিল সেই সুবিধার বাহিরে।
এই প্রসঙ্গে পর্তুগালের ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও পর্তুগাল বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রানা তাসলিম উদ্দিন বলেন, দীর্ঘ ১৩ মাসের টানা জরুরি অবস্থার পর ১ মে থেকে পর্তুগাল সরকার লকডাউন তুলে নিয়েছে। এই ১৩ মাসে কমিউনিটির মানুষ তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও পেশাগতভাবে বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তবে সরকারের ঘোষিত বিভিন্ন প্যাকেজের মাধ্যমে নানাবিধ সুবিধা অনেকেই পেয়েছেন আবার নিয়ম-বহির্ভূত অবস্থায় থাকার কারণে এই সুবিধা থেকে অনেকেই বঞ্চিত হয়েছেন।
তিনি বলেন, আমাদের লোকাল অনেক সংগঠনের মাধ্যমেও অনেকে সহায়তা পেয়েছেন। আমি মনে করি পর্তুগালের বাংলাদেশিরা অতটা সুবিধাবঞ্চিত হননি। এর কারণ হিসেবে বলতে পারি, যারা চাকরিজীবী ছিলেন তারা ঠিকই তাদের বেতন পেয়েছেন আবার অনেকে লে অব পেয়েছেন।
শুধু ব্যবসায়ীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কারণ দোকান বা ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের অনেক মালিকই ভাড়া কমাননি বা অর্ধেক করেছেন ভাড়া। এছাড়া, আমাদের অনেক ব্যবসায়ী মিনি মার্কেট ব্যবসায়ী।’ আর এরা এই জরুরি অবস্থায় বেশ ভালো ব্যবসা করেছেন বলে জানা যায়।
তাসলিম উদ্দিন বলেন, সবকিছু মিলিয়ে আমাদের হাতেগোনা কিছু মানুষ ছাড়া বাকি সব মানুষ ভালোই ছিলেন বা ভালো আছেন। আমাদের এই হিসেব অনেক সময় সঠিক নাও হতে পারে। এর মূল কারণ আমাদের দেশের মানুষ সহজে কারো কাছে হাত পাতেন না বা সরকারি ও অন্যান্য কোনও সংস্থা থেকেও কোনো সাহায্য নিতে চান না।
‘এই হিসেবে সমস্যাজনিত মানুষদের আসল পরিসংখ্যান পাওয়া বেশ দুষ্কর। তবে মোটের উপর আমি বলতে পারি আমাদের লোকেরা ভালোই আছেন আর এখন লকডাউন তুলে নেয়ার কারণে অনেকে আশাবাদি অল্প সময়ের মধ্যে সবাই তাদের সঙ্কট মোকাবিলা করতে পারবেন।’
তিনি বলেন, আমরা জানি ইউরোপ হলো সামারভিত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বেশিরভাগ অর্থনৈতিক কাজকর্ম হয়ে থাকে এই সময়েই। ব্যবসা-বাণিজ্য ও কাজকর্ম বিশেষ করে পর্যটন শিল্পে বছরে ৮-৯ মাস কাজ থাকে।
এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত কাজের চাহিদা বেশি থাকে এবং অন্যমাসগুলো বাংলাদেশিসহ অন্যান্য দেশের অভিবাসীরা ছুটি কাটাতে স্ব-স্ব দেশ বা বিভিন্ন দেশে পরিবার বন্ধু-বান্ধব এবং আত্মীয়-স্বজনের সাথে সময় কাটান।
অনেকেই আছেন ২০১৯ সালের অক্টোবর মাস থেকে এখন পর্যন্ত বেকার কারণ সেই সময়ে ওই বছরের সামার শেষ হলে বিপুল পরিমাণ অভিবাসী যারা পর্যটন শিল্প এবং আবাসিক হোটেল বা রেস্টুরেন্টের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তারা বেকার এবং পরবর্তী বছরের মার্চ-এপ্রিল পুনরায় কাজে যোগ দেয়ার অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু তাদের সেই অপেক্ষা আর শেষ হয় না এবং তা দীর্ঘায়িত হতে হতে দুই বছর হতে চলেছে।
‘এখানে বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের বেশিরভাগ ছিলেন পর্তুগিজ সুভিনিয়ার ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত ফলে পর্যটক শূন্য পর্তুগালে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ের একটি এটি। বিগত দেড় বছরে এই খাতের বেশিরভাগ ব্যবসায়ী পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন।’
তিনি বলেন, যারা টিকে থাকার চেষ্টা করছেন তারাও পড়েছেন বিপুল পরিমাণ ধার-দেনায়। বেশিরভাগ ব্যবসায়ী সময় মতো পরিশোধ করতে পারছেন না দোকান ভাড়াসহ অন্যান্য খরচ। তাই এই খাতে অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে।
এক সময়ে শুধুমাত্র লিসবন ডাউনটাউনে প্রায় ২ হাজারের বেশি বাংলাদেশি সুবিনিয়র শপ ছিল যার বেশিরভাগ এখন বন্ধ। যদিও ১লা মে থেকে পর্তুগালে অনেকটা স্বাভাবিক জীবন যাপন শুরু হয়েছে তথাপি কবে নাগাদ আবার সব কিছু পূর্বের ন্যায় স্বাভাবিক হয় তা কেউ বলতে পারছেন না। আবার অনেকে আশঙ্কা করছে হয়তো পরিস্থিতি কখনোই আর আগের অবস্থায় ফিরে যাবে না। তাই এই খাতের ব্যবসায়ীর চরম অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে কথা হলে বাংলাদেশ কমিউনিটি অব ফোর্তোর সভাপতি শাহ আলম কাজল বলেন, পর্তুগালে করোনা পরিস্থিতিতে সবার মতো প্রবাসী বাংলাদেশিদের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায় এবং অনেক প্রবাসী চাকরি হারিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করেন, পর্তুগিজ সরকার, বাংলাদেশ দূতাবাস এবং বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে কিছু সহযোগিতা করা হয় যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল ছিল। বর্তমানে লকডাউন তুলে দেয়ায় সবার মতো প্রবাসী বাংলাদেশিরা নতুন আশায় বুক বেধে ভালো দিনের অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন।
তিনি বলেন, গত বছর প্রথম লকডাউন শুরু হলে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি অভিবাসী বিভিন্ন অ্যাপভিত্তিক ডেলিভারিতে সংযুক্ত হয় বিশেষ করে সাইকেল ও মোটরসাইকেলের মাধ্যমে। তাছাড়া অনেকেই রাইড শেয়ারিং সেবায় যুক্ত হন।
তিনি আরও বলেন, লকডাউন ও বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপের ফলে এবং করোনার ভয়াল থাবা থেকে মুক্ত থাকার জন্য বেশিরভাগ মানুষ ঘরে বসে খাবার ও পণ্য পেতে বেশি সাচ্ছন্দ্য করতেন। ফলে এই সেবার যথেষ্ট চাহিদা তৈরি হয় এবং বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি তরুণ এই সেবার সাথে যুক্ত হয়ে ভালো উপার্জন করেছে।
সবকিছু স্বাভাবিক হওয়ার ফলে এবং মানুষের দীর্ঘদিন ঘরে বন্দিদশা থেকে মুক্তি লাভের কারণে সকলে এখন খোলা জায়গায় বা বাহিরে বন্ধু-বান্ধব অথবা সমুদ্র সৈকতে বেশি পাড়ি জমাবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
‘ইতোমধ্যে এই সেবার চাহিদা কিছুটা ভাটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে ফলে অনেক বাংলাদেশি অভিবাসীকে পুনরায় তাদের পূর্বের পেশা অথবা অন্যকোনো কিছুতে সংযুক্ত হতে হবে বলে মনে করেন অনেকেই।’
লকডাউনের সময়ে যারা এখানে মিনি মারকাডো বা নিত্য-প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন তারাও বেশ ভালো করেছে। এই সময়ে মানুষ দূর-দূরান্তে মানুষ সুপারশপে না গিয়ে ঘরের পাশে ছোট ছোট গ্রোসারি শপগুলো থেকে নিত্য-প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করেছে।
ফলে তাদের ব্যবসা কয়েকগুণ বেড়ে যায় এবং নতুন নতুন অনেক প্রতিষ্ঠান ঘরে উঠে এই সময়ে। অল্প পুঁজিতে এবং কম সময়ে এই ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান শুরু করা যায় যার কারণে লিসবনসহ বিভিন্ন শহরে তা চোখে পড়ার মতো এখন।
বিগত এক বছরের বেশি সময় বাংলাদেশি খাবারের রেস্টুরেন্টগুলো অনেকটা চ্যালেঞ্জিং সময় পার করেছে। একেক সময় একেক নিয়মের ফলে তারা বেশ কঠিন সময় পার করেছে। শুধুমাত্র ডেলিভারি নির্ভর ব্যবসা অনেক প্রতিষ্ঠানের খরচ জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হয়েছে।
কিছু রেস্টুরেন্ট এই সময়ে বন্ধ থাকলেও বেশিরভাগ চলেছে লোকসান বা সমান সমান খরচে। গত ১৯ এপ্রিল থেকে রেস্টুরেন্টের উপর থেকে কিছুটা বিধিনিষেধ শিথিল করায় এখন অনেকের এই খাতে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে।
লকডাউনে অনেক বাংলাদেশি উদ্যোক্তা স্থানীয় বিভিন্ন উদ্যোগ শুরু করেছে। তাদের ব্যবসায়ের ধারণা এবং স্থানীয় সুবিধাভোগী হওয়াতে তারা ভালো করছে। বিশেষ করে স্থানীয় কৃষি কাজে শ্রমিক সরবরাহ এবং বিভিন্ন লজিস্টিক সাপোর্ট।
কৃষি, কনস্ট্রাকশন, ক্লিনিং এবং মেনটেনেন্স সেক্টরে গত দুই বছর থেকে বেশকিছু সফল উদ্যোগ দেখা গেছে। সীমিত সময়ে এবং পুঁজিতে এখানে ভালো করা যায় যদি সঠিক অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান থাকে। অনেক তরুণ উদ্যোগী হওয়াতে এই সকল ব্যবসায়ে সামনের দিনগুলোতে আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
লকডাউনের সময়ে যারা পূর্বে সঠিক নিয়ম-কানুন অনুসরণ করে কাজ করেছে তারা লে-অব অথবা সামাজিক নিরাপত্তা খাতে থেকে প্রতি মাসে বেতনের একটি অংশ নগদ সুবিধা পেয়েছে। বিপত্তি বাঁধে যারা কোনো ধরনের চুক্তি ছাড়া কাজ করেছে বা মহামারি শুরুর আগে বেকার ছিলেন।
তাদের বেশিরভাগ মানুষই দীর্ঘ এই সময়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়েছে। যদিও সময়ে বাংলাদেশ কমিউনিটির বিভিন্ন সংগ্রহ, বাংলাদেশ দূতাবাস এবং স্থানীয় অনেক সংগঠন জরুরি সেবা নিয়ে সহযোগিতা করেছেন। কিন্তু তা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল।
করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার ফলে ১লা মে থেকে মোটামুটি সবকিছু স্বাভাবিক করে দেয়ার ফলে এখন প্রায় সকল ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও পর্যটন কেন্দ্র খুলে দেয়ার ফলে অনেক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। করোনা আবার যদি আঘাত না করে তাহলে সবাই নিকট ভবিষ্যতে আবারও স্বপ্নের সোনালী দিনের অপেক্ষায়।
ইসলামিক রিলিজিয়াস অ্যান্ড কালচারাল কমিউনিটি ইন পর্তুগাল সিআরসিআইপিটি মাতৃ মনিজ জামে মসজিদের সভাপতি মোশাররফ হোসেন বলেন, পর্তুগাল একটি পর্যটননির্ভর দেশ হওয়ার কারণে বিশ্বব্যাপী করোনার প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পাওয়ার পর থেকে দেশটি অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
‘এখানকার বাংলাদেশিরা শতকরা ৯০ শতাংশ পর্যটন ব্যবসার সাথে জড়িত হওয়ার কারণে করোনা মহামারিতে পর্তুগাল প্রবাসী বাংলাদেশিরা ব্যাপকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে পড়েন।’
তিনি আরও বলেন, যারা কাজ করতেন তারাও কাজ হারিয়ে ব্যাপক অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হয় এই পরিস্থিতিতে সিআরসিপিটিসহ বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক সংগঠন তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে। দ্বিতীয় ধাপের লকডাউনে ব্যবসায়ীরা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হন যার ফলে অনেকে ব্যবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
‘আর যারা ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারাও হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েছেন এই ভেবে যে সামনে কী হবে। পর্তুগালে করোনাকালে বাংলাদেশিরা শুরু থেকে এ পর্যন্ত ভালো নেই তারপরও আমরা মনে করি সবকিছু জুনের মধ্যে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। পর্যটননির্ভর পর্তুগাল পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত হবে ব্যবসায়ী ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে আবারও প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসবে।
এমআরএম/জিকেএস