ভিডিও EN
  1. Home/
  2. প্রবাস

আধুনিক সমাজেও শ্রমিক শোষণ দৃশ্যমান

আম্বিয়া অন্তরা | নিউইয়র্ক | প্রকাশিত: ০২:০৪ এএম, ০১ মে ২০২১

‘আসিতেছে শুভদিন, দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ!’ শ্রমিকদের কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়েই গড়ে উঠেছে আজকের এই মানব সভ্যতা। কিন্তু এই শ্রমজীবীরা আজও শোষিত, বঞ্চিত। আজকের আধুনিক সমাজেও শ্রমজীবীদের শোষণের চিত্র দৃশ্যমান।

১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা উপযুক্ত মজুরি আর দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। অসহনীয় পরিবেশে প্রতিদিন ১৬ ঘণ্টা কাজ করতে হত। সপ্তাহজুড়ে কাজ করে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙে যাচ্ছিল। শ্রমজীবী শিশুরা হয়ে পড়েছিল কঙ্কালসার।

তখন দাবি উঠেছিল, কল-কারখানায় শ্রমিকের গোটা জীবন কিনে নেয়া যাবে না। দিনে ৮ ঘণ্টা শ্রমের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলনের সময় ওই বছরের ১লা মে শ্রমিকরা ধর্মঘট আহ্বান করে। প্রায় তিন লাখ অবহেলিত শ্রমিক ওই সমাবেশে অংশ নেন।

আন্দোলনরত ক্ষুদ্ধ শ্রমিকদের রুখতে গিয়ে একটা সময় পুলিশ শ্রমিকদের মিছিলে এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। এ সময় ১১ জন নিরস্ত্র শ্রমিক নিহত হন। আহত ও গ্রেফতার হন আরও অনেকে। পরবর্তীতে প্রহসনমূলক বিচারের মাধ্যমে গ্রেফতার শ্রমিকদের মধ্য থেকে ছয়জনকে আন্দোলনে অংশ নেয়ার অপরাধে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

কারাগারে বন্দিদশায় এক শ্রমিক নেতা আত্মহননও করেন। এতে বিক্ষোভ আরো প্রকট আকারে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয় যুক্তরাষ্ট্র সরকার। ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে ১ মে শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

১৮৯০ সাল থেকে ১ মে বিশ্বব্যাপী পালন হয়ে আসছে ‘মে দিবস’ বা ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’কত বছর এ রকম ভয়ংকর নিয়মের অবসান ঘটিয়ে আন্দোলন করতে আসছিল তা হয়তো আমাদের জানা নেই।

আজ পহেলা মে, আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। যাদের পরিশ্রমের বিনিময়ে এই সভ্যতা টিকে আছে যাদের অবদানে আগামী বিশ্ব। এই মহতি দিনে মেহনতি মানুষদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাটুকু জানিয়েই আমরা শেষ করে দেই এই দিবস। অথচ প্রতিদিনই তাদের সঙ্গে আমাদের মানবিক আচরণ করা উচিত।

বৈশ্বিক মহামারি করোনার কালো থাবায় সারা বিশ্ব আজ তাল-মাতাল। আর মহামারিতে শ্রমজীবী মানুষের জীবন এখন ভয়ঙ্কর আতঙ্ক। চারদিকে লকডাউন! বন্ধ উপার্জনের সকল পথ। না খেতে পেয়ে অনেকেই হয়ে পড়ছে কঙ্কালসার। কেউবা ভাইরাসের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে বেরিয়ে পড়ছে কাজের সন্ধানে।

‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়
পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’

সুকান্ত ভট্টাচার্যের এই কথাও যেন হার মেনেছে আজ। মৃত্যুকে তুচ্ছ করে তারা ছুটে যাচ্ছে দু’মুঠো ভাতের সন্ধানে। পুরো পৃথিবী বিভিন্ন শাসন ব্যবস্থার মোড়কে ক্যাপিটালিজমের চর্চায় মগ্ন হয়ে আছে।

তাই পুঁজিবাদীরাই প্রতিটি রাষ্ট্রের অদৃশ্য চালক হয়ে আছে। আর আজও বঞ্চিত হচ্ছে এই শ্রমজীবী মানুষগুলোই। ১৮৮৬ সালে শোষণের যে চিত্র ছিল তা বদলেছে বটে, কিন্তু হয়রানি আজও চলমান।

বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃত সারা বিশ্বে। তবুও অন্য দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও একই চিত্র দৃশ্যমান। যাদের রক্ত পানি করা পরিশ্রমে গড়ে উঠছে আমাদের অর্থনীতি তাদের খুব যত্ন করে রেখেছি সমাজের একেবারে তলানিতে।

এই শ্রেণি-বৈষম্য শুধু আমাদের সমাজেই সীমাবদ্ধ রাখিনি। কৌশলে শ্রমিক শ্রেণির ভেতরেও রেখেছি আমরা। সুদূর অতীত থেকে পরম্পরা রক্ষা করে এগিয়ে যাচ্ছে এই বৈষম্য। নারী-পুরুষের বৈষম্য। একই কাজ করে একজন পুরুষ শ্রমিক যে পারিশ্রমিক পায় তা পায় না একজন নারী শ্রমিক।

একটি উদাহরণ দিচ্ছি আমি দেশে থাকার সময় দীর্ঘদিন এনজিও কর্মী হিসেবে কাজ করেছি। রাজধানীর মহাখালী কড়াইল এরিয়ায় কাজের সুবাদে নিম্ন আয়ের শ্রমিক শ্রেণির মানুষের খুঁটিনাটি জানার সুযোগ হয়েছে। গভীরভাবে উপলব্ধি করেছি, তাদের জীবন ওই জীবন কিছুটা আমি যাপন করেছি।

একজন পুরুষ শ্রমিক দিনে কাজ করে পেতেন ২০০-৩০০ টাকা (এখন ৪৫০-৫০০ টাকা) কিন্তু একই কাজের পারিশ্রমিক নারী শ্রমিক রাস্তার ইট-পাথর ভেঙে পেত ২০০-২৫০ টাকা (এখন ৩০০-৩৫০ টাকা)। শুধু তাই নয় নারী বলে কাজে নিতেও সংকোচ দেখায় প্রতিটা মানুষ।

তাছাড়া বাসায় বাসায় গিয়ে রান্নার কাজ করে এমন বেশ কয়েকজনের বেতন জেনে আমি রীতিমতো অবাক হতাম। ৮-১০ ঘণ্টা কাজ করে মাস শেষে হাতে পেতেন ২০০০ থেকে ৫০০০ টাকা।

আমরা যদি অন্য একটা হিসেব করি তাহলে নারীর বঞ্চনার বড় ক্ষেত্রের সন্ধান মিলবে। দেশের সিংহভাগ নারী ঘরের পাহাড় সমান কাজ সামলান। একজন পুরুষের কাজ ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা, কিন্তু একজন নারীর কাজের শুরু সকাল থেকে আর শেষ মধ্যরাত অবধি।

যদি অর্থনৈতিক দিক থেকে বিবেচনা করি তবে এই কাজের অবদানে বেড়ে যেত আমাদের দেশীয় জিডিপির প্রায় অর্ধেক। কিন্তু গৃহশ্রমের কোনো মূল্য মেলে না বরং চিত্রটা উল্টো।

প্রতি বছর ১২ হাজার নারীর শরীরে ধরা পড়ে জরায়ু ক্যান্সার! আর জরায়ুর সমস্যা প্রায় ৭৫ শতাংশ নারীর। এর মধ্যে বেশিরভাগ নারীই শ্রমিক/নিম্ন আয়ের। কারণ আমাদের দেশে নেই পর্যাপ্ত পাবলিক টয়লেট। যেগুলো আছে তাতে ৫ টাকা থেকে ১০ টাকা এন্ট্রি ফি লাগে।

নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষের কাছে ১০ টাকা অনেক বেশি হওয়ায় তা এড়িয়ে যায় নারীরা। তারা প্রয়োজন সত্যেও অতিরিক্ত চাপ নিয়ে কাজ করে। ফলে জরায়ু ক্যান্সারসহ নানা রোগে আক্রান্ত হন এই মানুষগুলো।

তাহলে কি এই সমাজ ধরে নিয়েছে নারীরা যোগ্য না কিন্তু তারা এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই আমাদের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী, জাতীয় সংসদ স্পিকারও একজন নারী, মন্ত্রিসভায় নারী, এছাড়া সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বহু গুরুত্বপূর্ণ পদেও নারীর শক্ত অবস্থান বিদ্যমান।

সমীকরণে বর্তমানে প্রায় ২৫ মিলিয়ন নারী বিভিন্ন কর্মপেশায় নিয়োজিত। এত নারীর শক্ত হাত থাকা সত্ত্বেও সাধারণ নারীরা তাদের শ্রমের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি থেকে কেন বঞ্চিত?

শুধু শ্রমিক দিবসেই নয় রাষ্ট্রের উচিত এই বিষয়গুলো নিয়ে ভাবার। সকল কাছে নারীর অংশগ্রহণের প্রতিবন্ধকতাকে দূর করে একটা সমন্বয়ের মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর ভূমিকা আরো ত্বরান্বিত করা।

শ্রমবাজারে নারীদের প্রবেশাধিকার সুষম পথ দেখিয়ে মজুরি বৈষম্যের দূর করে সঠিক সমন্বয়ের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে নারীদের স্ব-কর্মসংস্থানা কর্মসূচির মাধ্যমে। সামাজিক অবস্থান তৈরি করা, আগামী বিশ্ব হয়ে উঠুক মানুষের সকল ভেদাভেদ ভুলে ইতিহাস সোনালী অক্ষরে লিখে রাখুক এই শ্রমিকদের অবদান।

এমআরএম/ইএ