ভিডিও EN
  1. Home/
  2. প্রবাস

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় করোনা মোকাবিলায় অভিবাসীরা কি মূল বাধা?

আহমাদুল কবির | প্রকাশিত: ০৩:২২ পিএম, ২৬ জানুয়ারি ২০২১

করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে সব থেকে কঠিন সময় মোকাবিলা করে আসছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অভিবাসী কর্মীরা। মহামারিকালে প্রশ্নবিদ্ধ তাদের জীবনযাত্রার মান। জীবনের চাকা সচল রাখতে তাদেরকে ভাঙতে হচ্ছে মহামারিতে জারি করা নানা নিয়মনীতি।

করোনার ভয়কে উপেক্ষা করতে তাদেরকে চালিয়ে নিতে হচ্ছে জীবন। আদতে তাদের পক্ষে মানা সম্ভব হচ্ছে না করোনার লাগাম টেনে ধরতে জারি করা বিধিবিধান।

মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম দ্য স্ট্রেইট টাইমসে ২৪ জানুয়ারি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে বিষয়টি। সেখানে বলা হয়েছে, মালয়েশিয়া এবং থাইল্যান্ডে নতুন করে করোনা বৃদ্ধির কারণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রায় এক কোটি অভিবাসী। এমন পরিস্থিতিতে ছড়িয়ে পড়া এই মহামারি ঠেকানো সম্ভব নয়।

কয়েক দশক ধরে এ অঞ্চলে স্বল্প বেতনে কাজ করা শ্রমিকদের সমস্যা সমাধান এবং এটি বাস্তবায়নে একটি কার্যকর দীর্ঘমেয়াদি জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে শ্রমিকদের সুস্থ জীবিকা নির্বাহ এবং কাজের মানোন্নয়নে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। এমনটিই বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

মালয়েশিয়াভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা নর্থ সাউথ ইনিসিয়েটিভের নির্বাহী পরিচালক অ্যাড্রিয়ান পেরেরা বলেন, কোভিডের আগে অনেক প্রতিষ্ঠান অভিবাসীদের নিয়োগে অগ্রাধিকার দিতেন। কারণ তাদেরকে বাধ্যতামূলক কাজ করানো সহজ ছিল।

করোনার শুরুতে সিঙ্গাপুর খুব সচেতন ছিল। তবে বিদেশি কর্মীদের বাসস্থানগুলোতে এই মহামারি বৃদ্ধির ফলে দেশটির সরকার হতভম্ভ হয়ে পড়ে। যার কারণে তারা পরবর্তীতে দেশব্যাপী লকডাউন দিতে বাধ্য হয়। দ্বীপ দেশটি তখন থেকে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে এই প্রাদুর্ভাবকে নিয়ন্ত্রণে এনেছে। এর মধ্যে শ্রমিকদের চলাচলে বিধিনিষেধ বিশেষভাবে উল্লেখ ছিল।

বর্তমানে মালয়েশিয়ায় দৈনিক সংক্রমণ প্রায় চার হাজার ছাড়িয়েছে। এই মাসের শুরুতে মালয়েশিয়া সরকার জরুরি অবস্থা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে লকডাউন কার্যকর করে। মালয়েশিয়ায় নতুন সংক্রমণের বেশিরভাগই বাংলাদেশ, নেপাল, মিয়ানমার এবং ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশ থেকে আসা অভিবাসী বলে দাবি তাদের।

ভাইরাসের সংক্রমণের বৃদ্ধির কারণে দেশটির কর্তৃপক্ষ যেসব অঞ্চলে অতিরিক্ত শ্রমিক রয়েছে তা কমিয়ে আনছে। মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রীর মতে, দেশটির ১৫ লাখেরও বেশি নথিভুক্ত অভিবাসী কর্মীদের মধ্যে ৯১ শতাংশই বসবাসের জন্য আবাসন আইন মানে না।

জানা গেছে, মালয়েশিয়ায় করোনার সর্বশেষ সংক্রমণের অন্যতম প্রধান উৎস হলো রাবার গ্লোভ প্রস্তুতকারক টপ গ্লোভের কারখানাগুলো। যা গত বছরের নভেম্বর মাসে টপ গ্লোভের শ্রমিকদের কয়েক হাজার সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পরে সরকার তাদের আবাসস্থলে অভিযান চালায়।

আবাসন আইন না মানার দায়ে গ্লোভ নির্মাতা ব্রাইটওয়ে হোল্ডিংয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগও দায়ের করে কর্তৃপক্ষ। টপ গ্লোভে গত সপ্তাহে কমপক্ষে ৩০৫ জন নতুন কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছে।

মালয়েশিয়ায় যেসব প্রতিষ্ঠান শ্রমিক নিয়োগ দিচ্ছে, তাদেরকে অভিবাসী কর্মীদের জন্য নিজস্ব শনাক্ত কেন্দ্র তৈরি করতে হবে বলে জানিয়েছেন দেশটির মানবসম্পদ মন্ত্রী এম সারভানান। তিনি বলেছেন, তাদের অবশ্যই কেয়ারেন্টাইন, ভ্যাকসিনসহ চিকিৎসা ব্যয় মালিক পক্ষকে বহন করতে হবে।

এদিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সীমান্তজুড়ে অবৈধ অভিবাসনে নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা জোরদার করায় কোডিভ নিয়ন্ত্রণে সফলতা পেয়েছে সিঙ্গাপুর।
সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ও অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পিটার কলিগন বলেন, করোনা নিয়ন্ত্রণে সফল দেশগুলো নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর এবং তাইওয়ানের দিকে লক্ষ্য করেন। তাদের মধ্যে একটি বিষয় সাধারণভাবে মিল রয়েছে। তা হলো, তারা সীমানার নিরাপত্তা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে।

মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষ গত বছর লকডাউনের মাঝামাঝি সময়ে অবৈধ অভিবাসীদের ধরতে বিশেষ অভিযান চালিয়েছিল। ওই প্রক্রিয়ায় শতাধিক অভিবাসীকে আটক করেছিল তারা। জাতিসংঘের সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন অনুসারে মালয়েশিয়ায় প্রায় ২০ থেকে ৪০ লাখ অনিবন্ধিত শ্রমিক রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

থাইল্যান্ডে, করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা তূলনামূলকভাবে কম। দেশটির আক্রান্তের সংখ্যা মাত্র ১৩ হাজার। তবে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, অভিবাসী কর্মীরা সম্প্রতি সংক্রমণের মূল উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা দেশের সমস্ত সংক্রমণের প্রায় এক চতুর্থাংশ।

থাইল্যান্ডে আনুমানিক ৪০ থেকে ৫০ লাখ অভিবাসী শ্রমিকদের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কিছু সংখ্যককে সামাজিক সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। তবে যারা বাজারে বা খামারে কাজ করছেন তাদের মধ্যে ভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি।

এই অঞ্চলে অভিবাসী শ্রমিকরা ঘিঞ্জি ভবনে বাস করেন। তারা এক রুমে প্রায় ছয় জন করে সকাল ও রাতে শিফট পদ্ধতিতে বসবাস করেন বলে জানিয়েছে, এনজিও মাইগ্রান্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ থাইল্যান্ডের সমন্বয়কারী অ্যাডিসর্ন কেএডমংকোল। তবে শক্তিশালী সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ ব্যতীত থাইল্যান্ডের পক্ষে সর্বশেষ প্রাদুর্ভাব থেকে দ্রুত মুক্ত হওয়া কঠিন হবে।

সর্বশেষ প্রাদুর্ভাবের কারণ হিসেবে অবৈধ অভিবাসীদের কর্মসংস্থানকে দায়ী করে থাই প্রধানমন্ত্রী প্রয়ূথ চ্যান-ওচা জানান, অনিবন্ধিত শ্রমিকদের নিয়োগকে কঠোরভাবে প্রতিহত করবেন। পাচারকারী শ্রমিকদের তদন্ত ও গ্রেফতারে পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছে তার সরকার।

এ পদক্ষেপের অংশ হিসেবে সামুত সাখন প্রদেশের সামুদ্রিক অঞ্চলের বাজার এবং অভিবাসী অঞ্চলের আশপাশে কাঁটাতারের বেড়া তৈরি করেছিল তারা। যেখানেই সর্বশেষ প্রাদুর্ভাবের সূচনা হয়েছিল এবং পরবর্তীতে শ্রমিকদের স্থান ত্যাগ করতে বাধা দেয়া হয়েছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার টিকা অভিযানের সাফল্যের জন্য কার্যকর সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ গুরুত্বপূর্ণ।

এএনইউতে কলিগন বলছেন, একটি সফল টিকাদান কর্মসূচির জন্য ৮০-৯০ শতাংশ লোককে টিকা দেওয়া দরকার। সমস্যা হলো, যদি অনেক লোক সীমান্ত অতিক্রম করে এমন সব দরিদ্র অঞ্চলে বসবাস করে, যেসব অঞ্চলে ভ্যাকসিন সরবরাহ নেই। সেখানে সংক্রমণের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেবে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার মাইগ্রেশন বিশেষজ্ঞ নীলিম বারুয়া বলেছেন, সিঙ্গাপুর এমন একটি অর্থনীতির অঞ্চল, যেখানে অভিবাসী শ্রমিকরা অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে।

গত বছরের গোড়ার দিকে যখন দৈনিক সংক্রমণের সংখ্যা এক হাজারে উঠে আসে, তখন কর্তৃপক্ষ আবাসস্থলগুলো নিয়ন্ত্রণ করে এবং চলাচল সীমিত করে দেয়। পরে তাদের পরীক্ষা করে পৃথক করা হয়। কয়েক মাস ধরে ধীরে ধীরে কঠোর অবস্থানে যাওয়ার কারণে শ্রমিকদের আবাসস্থলে আক্রান্তের সংখ্যা তখন থেকে প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে।

সেরোলজি পরীক্ষায় দেখা গেছে, সিঙ্গাপুরে শ্রমিকদের আবাসস্থলে বসবাসকারী প্রায় তিন লাখ ২৩ হাজার কর্মীর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই এক পর্যায়ে সংক্রমিত হয়েছিল। পরে সরকার তা নিয়ন্ত্রণে আনে।

সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ নভেনা হাসপাতালের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ লিওং হো নাম বলেছেন, যদি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অভ্যাস পরিবর্তন না করে, তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলো করোনাকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিতে পারবে না।

এমআরএম/এমকেএইচ