ভিডিও EN
  1. Home/
  2. প্রবাস

বিজয় দিবসে মিশিগানে ‘মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ’

অনন্ত সাইফ | প্রকাশিত: ১২:৫৫ এএম, ২৯ ডিসেম্বর ২০২০

ফয়েজ মোমেন ও সাইফুল আজম সিদ্দিকী, মিশিগান থেকে

বিজয় দিবস উপলক্ষে ১৯ ডিসেম্বর সামাজিক মাধ্যম ‘জুমে’ একটি আলোচনায় মিলিত হন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান প্রবাসীসহ বীর মুক্তিযোদ্ধারা। ‘মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ’ শীর্ষক দু’ঘণ্টার এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিতরা যোগ দেন।

করোনাকালে তাদের সবাইকে অশেষ শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ জানিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করেন মূল আয়োজক ও সঞ্চালক ফয়জুল মোমেন। শনিবার বিকেলের অনলাইন অনুষ্ঠানটিতে মিশিগান ছাড়াও আরো কয়েকটি স্টেট, যেমন ক্যালিফোর্নিয়া, নিউজার্সি ও সাউথ ক্যারোলিনা থেকেও আগ্রহী দর্শক-শ্রোতারা অংশ নেন।

অনুষ্ঠানের শুরুতে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর দিনটির স্মৃতিচারণ করেন বীর প্রতীক ক্যাপ্টেন সিতারা রহমান, তার স্বামী বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. আবিদুর রহমান, গেরিলা-কমান্ডার প্রকৌশলী ইউসুফ সালাহউদ্দিন আহমেদ এবং শহীদ জননী জাহানারা ইমামের সন্তান সাইফ ইমাম জামী। ক্যাপ্টেন সিতারা এবং সাইফ জামী পরস্পরকে দীর্ঘ প্রায় পঞ্চাশ বছর পর দেখতে পেয়ে কিছুটা আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন শুরুতে!

তাদের প্রাথমিক স্মৃতিচারণের পর মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের উপর আধাঘণ্টার একটি ভিডিও চিত্র উপভোগ করেন সবাই; মূলতঃ চারটি ডকুমেন্টারি থেকে এই ভিডিও-চিত্রটি সংকলন করা হয়: তানভীর মোকাম্মেলের ‘১৯৭১’, তারেক মাসুদের ‘মুক্তির গান’, তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদের ‘মুক্তির কথা’ এবং Vanya Kewley ও গীতা মেহতার ‘Major Khaled’s War’।

ভিডিওক্লিপগুলোতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ-দৃশ্যের পাশাপাশি উদ্দীপনী কিছু গানের পরিবেশনা জুম-অনুষ্ঠানের দর্শকদের, বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধাদের আবেগ-তাড়িত করে ফেলে; পেছনের মহান-দিনগুলির স্মৃতি মনে পড়ে যায় তাদের। অনুষ্ঠানের অতিথি এবং শ্রোতারা তখন মিথষ্ক্রিয় একটি আলোচনায় সক্রিয় অংশ নেন।

যুদ্ধ চলাকালীন শাড়িতে গ্রেনেড লুকিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে কিভাবে ত্রিপুরা পোঁছেছিলেন, তার রোমাঞ্চকর বর্ণনা দেন ক্যাপ্টেন সিতারা! ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’ নামের একটি অস্থায়ী হাসপাতাল সেই সময় চালু রাখেন ড. জাফরুল্লাহসহ সিতারা, মূলতঃ যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা ও সেবাদানের লক্ষ্যে। (এই হাসপাতালটিই পরবর্তীতে গণস্বাস্থ কেন্দ্রে রূপ নেয় স্বাধীন বাংলাদেশে)।

ক্যাপ্টেন সিতারা আপার আরেকটি পরিচয় হলো তিনি বীর উত্তম লেঃ কর্নেল হায়দারের বোন। যুদ্ধ শেষে ভাই মেজর হায়দার যিনি ছিলেন ২-নং সেক্টরের সেক্টর-কমান্ডার, তার সাথে যখন দেখা হয়, তখন তিনি শুনতে পান রুমীসহ আরো অনেক গেরিলা-ছেলের নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার কথা। মেজর হায়দার তার অসীম সাহসীকতা ও নেতৃত্বের জন্য পরে বীর উত্তম উপাধিতে ভূষিত হন, কিন্তু দুৰ্ভাগ্যজনকভাবে ‘৭৫ এর ৭ই নভেম্বর বিদ্রোহী সিপাহীরা তাকে হত্যা করেন, একটা বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে।

সিতারা এই বিয়োগান্ত ঘটনা স্মরণ করে বলেন, জেনারেল ওসমানী পরবর্তীকালে তাকে এক সময় আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘হায়দারকে আমি তখন পাঠিয়েছিলাম, খালেদ মোশাররফ আর জিয়াউর রহমানের মধ্যে মিটমাট করানোর জন্য। তারা তো সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একসাথে যুদ্ধ করেছিল একাত্তরে!’

বীর বিক্রম শহীদ রুমীর ভাই সাইফ জামী এ সময় তার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেন ক্যাপ্টেন সিতারাকে; একাত্তরের ষোলোই ডিসেম্বর পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণ-অনুষ্ঠান শেষে মেজর হায়দারসহ আরো অনেক গেরিলা যোদ্ধা (চুল্লু, আলম, শাহাদত প্রমুখ) সেদিন রাতে জাহানারা ইমামের সাথে দেখা করতে আসেন।

শহীদ জননী তখন মেজর হায়দারকে বলেন, জামীর মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে না পারার আক্ষেপের কথা। মেজর হায়দার সে মুহূর্তে তার AK47 রাইফেলটি জামীর হাতে দিয়ে বলেন, ‘আজ থেকে তুমি আমার বডি-গার্ড!’ (জাহানারা ইমাম তার ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইতেও এ ঘটনাটির সুন্দর বর্ণনা দিয়ে গেছেন)। কথাগুলো বলার সময় আবেগ ও কান্নায় যেন জড়িয়ে যাচ্ছিল জামী ভায়ের কণ্ঠ!

মিশিগান-প্রবাসী প্রকৌশলী ইউসুফ সালাহউদ্দিন আহমেদ সে সময় ছিলেন প্রকৌশল বিশবিদ্যালয়ের ছাত্র (বর্তমানে যা বুয়েট); ছাত্র-রাজনীতিতে তখন বেশ সক্রিয়ই ছিলেন তিনি। ইতোপূর্বে (সত্তুরের জুন মাসে) বাংলাদেশের প্রথম পতাকা যখন ডিজাইন করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে, তখন তার সাথে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন তিনি, ‘ফেব্রুয়ারী ১৫ বাহিনী’র একজন সদস্য হিসাবে।

পরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বি. এল. এফ. (Bangladesh Liberation Force) এর একজন সদস্য হিসেবে ভারতে গেরিলা-যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন এবং পরে জুন মাসে সীতাকুণ্ড-সন্দ্বীপ এলাকা দখলে নিয়ে সেখানে কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। তার বর্ণনায় শোনা যায় সীতাকুণ্ড এলাকায় কিভাবে একক কমান্ডের অধীনে মুক্তিবাহিনী ও অন্যদের সাথে মুজিব বাহিনী যুদ্ধ পরিচালনা করে।

৩-নং সেক্টরে সিলেট-ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া অঞ্চলে যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করেন ডা. আবিদুর রহমান, যার কিনা একাত্তরের জুন মাসেই আমেরিকা আসার পূর্ব-পরিকল্পনা ছিল; কিন্তু দেশ মাতৃকার ডাকে তখন একজন চিকিৎসক হয়েও হাতে অস্ত্র তুলে নেন তিনি, দেশকে স্বাধীন করার জন্য! যুদ্ধে আপামর সর্ব-স্তরের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশ নেয়া, আহত সহ-যোদ্ধাদের তাৎক্ষণিক চিকিৎসা দেয়া, এবং নিজের চোখের সামনেই অনেক মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুবরণের কাহিনী বলার সময় কেঁদে ফেলেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা!

আলোচনা ও স্মৃতিচারণের মাঝে থাকে একটি মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক পর্ব, এতে গান এবং আবৃত্তিতে অংশ নেন ফারহানা ইলোরা হুসেইন, শিহাব উল্লাহ, সাইফ সিদ্দিকী এবং ছোট্ট সোনা-মনি সুমেহরা ডারাফজিন। ‘মিশিগান শিশু-ক্লিনিকে’র অফিস ম্যানেজার ইলোরা হুসেইন তার অপূর্ব-সুরেলা কণ্ঠে গেয়ে শোনান দেশ-প্রেমের দুটো গান: খান আতাউর রহমানের ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে’ এবং নজরুল ইসলাম বাবুর লেখা ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’।

গান শুরু করার আগে ইলোরা আপা শোনালেন তার মায়ের লেখা একটি বইয়ের কথা (‘পরবাসে ৭১’), যা একাত্তরে তাদের পরিবারের অভিজ্ঞতা, বিশেষ করে ভারতের উদ্বাস্তু ক্যাম্প-জীবন নিয়ে খুব দরদ দিয়ে লেখা। সপ্তম গ্রেডের ছাত্রী সুমেরাহ এরপর শামসুর রহমানের ‘যুদ্ধ জয়ের কথা’ কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনায়, একটি মনোরম স্লাইড-শো’এর মাধ্যমে।

‘একাত্তরের চিঠি’ বই থেকে একটি চিঠি পড়ে শোনান শিহাব উল্লাহ, যা মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রউফ ববিন তার মাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন একাত্তরের আগস্ট মাসে। ভাস্কর চৌধুরীর লেখা ‘আমার বন্ধু নিরঞ্জন’ কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনান সাইফ সিদ্দিকী তার বলিষ্ঠ কণ্ঠে। শিহাব এবং সাইফ - পেশায় উভয়েই মেধাবী প্রকৌশলী, মিশিগানের সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও খুব সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন এখন।

আলোচনার দ্বিতীয় পর্বে ১১- নম্বর সাব-সেক্টরের বীর মুক্তিযোদ্ধা খলিলুর রহমান চৌধুরী তার যুদ্ধকালীন কয়েকটি ঘটনার স্মৃতিচারণ করেন; একটি ঘটনা ছিল খুব মর্ম-স্পর্শী : একবার এক অপারেশনে ভুল বোঝা-বুঝির শিকার হয়ে মুক্তিবাহিনীর কিছু ছেলে মারা যান, তো পরদিন পাক-আর্মি চলে যাবার পর খলিলুর রহমানরা ওই পাঁচটি লাশ গরুর গাড়ি করে ফিরিয়ে নিয়ে আসছিলেন।

jagonews24

পথিমধ্যে গাইবান্ধার ভরতখালী নামের একটি জায়গা যেখানে একটি পতিতালয় ছিল, সেখানে তাদের লুকিয়ে থাকতে হয়। সেখানকার পতিতারা তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেদিন তাদের আশ্রয় দিয়ে জীবন বাঁচিয়েছিল, খলিল সাহেবের তাই প্রশ্ন আজো: আমরা কি তাদের সঠিক মূল্যায়ন করতে পেরেছি কখনো?

সান ফ্রান্সিসকো থেকে অংশ নেয়া মেধাবী প্রকৌশলী সুকমল মদক তার যুদ্ধকালীন স্মৃতি তুলে ধরেন আবেগময় ভাষায়; যুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ৫-৬ বছর, কিন্তু এখনো স্পষ্ট মনে আছে তার ওই আতঙ্কের দিনগুলির কথা! মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার কারণে টাঙ্গাইলে তার মামাদের যে নির্মমভাবে হত্যা করে রাজাকার-পাক বাহিনী, সে হৃদয়-বিদারক কাহিনীর উল্লেখ করেন সুকমলদা।

সঞ্চালক ফয়জুল মোমেন একটা সময় পড়ে শোনান তার বাবার লিখে যাওয়া যুদ্ধকালীন স্মৃতি থেকে কিছু কথা, যেখানে উঠে এসেছে কুমিল্লা অঞ্চলে বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর খালেদ মোশাররফ আর মেজর হায়দারের যুদ্ধ-প্রশিক্ষণের তারিফ ও প্রশংসার প্রসঙ্গ!

বিশাল আত্মত্যাগের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও পরে একটি পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধ ও তার ইতিহাস নিয়ে যে অবহেলা শুরু হয়, মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক মূল্যায়ন বরং উল্টো পথে যাত্রা শুরু করে- এর জন্য অনুষ্ঠানের বক্তারা কেউ কেউ মনে করেন, যুদ্ধটা নয় মাসে দ্রুত শেষ না হয়ে বরং আরো দীর্ঘস্থায়ী হলে এ রকম অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটতো না; আপামর সব মানুষের মনে তখন মুক্তিযুদ্ধের ধর্ম-নিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক চেতনা-বোধ স্থায়ী জায়গা করে নিতো।

যুদ্ধকালীন বি.এল. এফ বা মুজিব-বাহিনীর কর্ম-তৎপরতা নিয়েও কিছুটা আলোচনা চলে এক পর্যায়ে, বিশেষ করে তাদের প্রশিক্ষনের পেছনে মার্কিনীদের ফান্ডিং, মুক্তিবাহিনীর সাথে তাদের দ্বন্দ্ব- এসব নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন ড. আবিদ, প্রকৌশলী ইউসুফ এবং গবেষক আরিফ ইউসুফ।

এখনো মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে এক বিশাল অনাবিষ্কৃত ইতিহাস পড়ে আছে বলে মন্তব্য করেন আরিফ ভাই। (উল্লেখ্য, আরিফ ইউসুফ ভাই মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন-এক্টিভিস্টদের ভূমিকা নিয়ে সম্প্রতি Blockade নামের একটি বহুল-প্রশংসিত ডকুমেন্টারি নির্মাণ করেন)।

অনুষ্ঠানের শেষে সঞ্চালক ফয়জুল মোমেন সবাইকে আবারো ধন্যবাদ জানান, অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে তাতে সক্রিয় অংশ নেয়ার জন্য। বাংলাদেশের, বিশেষ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে এ ধরনের অনুষ্ঠান আরো আয়োজন করা প্রয়োজন বলে সকলেই মত দেন এবং পরষ্পর শুভেচ্ছা বিনিময় করে অনুষ্ঠান থেকে বিদায় নেন।

এমআরএম