সিঙ্গাপুরে হতাশায় দিন কাটছে বাংলাদেশিদের
‘ছুটিতে বাংলাদেশে যাওয়ার কথা ছিল। পরিবারের কথা চিন্তা করে যাইনি৷ সুস্থ অবস্থায় দেশে গিয়ে যদি আমার করোনাভাইরাসের লক্ষণ দেখা দেয় তাহলে আমার জন্য পরিবার, সমাজ ও দেশ বিপদে পড়বে। এসব কারণেই দেশে যাওয়া হয়নি। দিনেদিনে বাংলাদেশেও করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে। ধনী-গরিব, হিন্দু-মুসলিম, সাদা-কালো, কিছুই বাদ পড়ছে না। পরিবারের জন্য উৎকণ্ঠায় দিন পার করছি’।
কথাগুলো বলছিলেন সিঙ্গাপুর প্রবাসী আমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, পরিবারের কথা চিন্তা করতে করতে এখন আমাদের নির্ঘুম রাত কাটে। আধো ঘুমে সকালে অফিসে গেলে কাজে মন বসে না৷ এখন আল্লাহর কাছে দোয়া করা ছাড়া প্রবাসীদের আর কিছুই করার নেই’।
কবির হোসেন নামে আরেক বাংলাদেশি জানান, সঙ্কটময় মুহূর্তে সিঙ্গাপুরে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ভালোই আছে৷ দেশটিতে এখনো লকডাউন করা হয়নি৷ আমাদের দিনগুলি চলছে আগের মতোই স্বাভাবিক। দৈনন্দিন জীবন চলছে রুটিন মাফিক।
তিনি জানান, আগে ডিউটি শেষ করে কিংবা বন্ধের দিন বাইরে বন্ধুদের সাথে আড্ডা গল্প গুজব করতাম। বিভিন্ন পার্কে ঘুরে বেড়াতাম৷ এখন আর সেই সুযোগ নেই। কাজ শেষে বাসায় ফিরে ডরমিটরির নিচে বসে গল্প-গুজব করি৷ কেউবা ওয়াইফাই কানেকশন দিয়ে মুভি দেখে কিংবা দেশে প্রিয়জনদের সাথে কথা বলে৷
প্রবাসীদের দুশ্চিন্তার সবচেয়ে বড় কারণ- অনেকের ওয়ার্ক পাশের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। কোম্পানি তাদের নতুন করে পারমিট রিনিউ করাতে চাচ্ছে না। তারা এখন কী করবে? তাদের প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে অনিশ্চয়তায়৷
এ ব্যাপারে প্রবাসী তৌকির বলেন, ‘আমার কোম্পানি ওয়ার্ক পারমিট রিনিউ করবে না৷ কথা ছিল ২৩ মার্চ আমাকে বিমান টিকিট দেবে। কিন্তু হঠাৎ ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন দেশে যেতে পারছি না৷ কোম্পানিতে কল দিলে বলে এখন আমাদের কিছুই করার নেই৷ পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা কর’৷
তিনি বলেন, কোম্পানির দায়িত্বরতদের আমি বলেছি এত খরচ কোথা থেকে যোগাড় করব৷ যতদিন দেশে না যাই ততদিন আমাকে কাজ দিয়ে রাখেন। তারা কাজ দিতে রাজি হয়নি৷ আমাকে এখন রুমেই থাকতে বলা হয়েছে। এখন আমার এমন অবস্থা খাবার খরচও যোগাতে পারছি না। যে টাকা ছিল তা দিয়ে বাড়ির জন্য কেনাকাটা করে ফেলেছি। হতাশ হয়ে যাচ্ছি’।
তিনি আরও বলেন, ‘এরই মধ্যে অনেকেই চাকরি থেকে ছেড়ে দেশে যেতে চেয়েছিলাম। বিমান চলাচল বন্ধ হওয়ায় এখনই কেউই যেতে পারছে না। দুইদেশের সরকার যদি আন্তরিকতার সঙ্গে কিছু করে তাহলে হয়তোবা চাকরি করতে পারব। এদেশের আইন-কানুন খুব কড়াকড়ি। এরা নিয়মের বাইরে কিছুই করতে চায় না। বাংলাদেশ দূতাবাসের কাছে আমার আবেদন তারা যেন আমাদের জন্য কিছু করে। নয়তোবা না খেতে মারা যাব’।
হাসান নামে আরেক প্রবাসী বলেন, ‘আমার ভালো একটা কোম্পানিতে চাকরি হয়েছিল। কিন্তু যে কোনো কারণে গত মাসে এক মাসের নোটিশে রিজাইন দিয়েছিলাম। কথা ছিল এই মাসের শেষের দিকে দেশে গিয়ে আবার নতুন কোম্পানিতে ফিরে আসব৷ কিন্তু সিঙ্গাপুর সরকার নতুন নিয়ম করেছে। এখন দেশে গেলে আর আসা যাবে না। তাদের নতুন এই সিদ্ধান্তে মানসিক চিন্তায় পড়ে গেছি’৷
তিনি বলেন, ‘পরে অনেক ভেবে-চিন্তে কোম্পানির বসকে বিষয়টা খুলে বলি৷ বস সব শুনে বলল, তুমি রিজাইন পেপার তুলে নাও৷ তার পরামর্শে রিজাইন পেপার তুলে নিয়েছি৷ নতুন নিয়মের কারণে ভালো একটি চাকরি হারালাম’।
এরই মধ্যে নভেল করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা ২১ হাজার ছাড়িয়েছে। আর আক্রান্ত হয়েছেন সাড়ে চার লাখেরও বেশি মানুষ। আক্রান্তদের মধ্যে ১ লাখ ১৩ হাজার ৮০৮ জন চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে উঠেছেন।
গত ৩১ ডিসেম্বর চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে প্রথমবারের মতো শনাক্ত হয় প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। এরই মধ্যে বিশ্বের অন্তত ১৯৮টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে এই ভাইরাস। এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত এতে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৬৬ হাজার ৭৫৯ জন। মারা গেছেন ২১ হাজার ১৪৮ জন।
গত ২৪ ঘণ্টায় সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছেন ইতালিতে। এদিন দেশটিতে করোনাভাইরাস প্রাণ কেড়েছে অন্তত ৬৮৩ জনের, নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন ৫ হাজার ২১০ জন। এ নিয়ে সেখানে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭৪ হাজার ৩৮৬ জন, মারা গেছেন ৭ হাজার ৫০৩ জন।
মৃত্যুপুরী হয়ে উঠেছে ইউরোপের আরেক দেশ স্পেনও। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশটিতে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৬৫৬ জন, আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় সাড়ে সাত হাজার মানুষ। এ নিয়ে সেখানে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৯ হাজার ৫১৫ জন, মৃত্যু ৩ হাজার ৬৪৭ জনের।
করোনার সংক্রমণ দ্রুত বাড়ছে যুক্তরাষ্ট্রেও। এদিন দেশটিতে নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন ১০ হাজার ৪৮৬ জন, মারা গেছেন ১৪২ জন। সেখানে এখন মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৩৪২, মৃত্যু ৯২২ জনের।
এছাড়া, ইরানে গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন ১৪৩ জন, নতুন রোগী ২ হাজার ২০৬ জন। ফলে দেশটিতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার ১৭ জন, মৃত্যু ২ হাজার ৭৭ জনের।
ভয়াবহ পরিস্থিতি ফ্রান্সেও। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশটিতে মারা গেছেন ২৩১ জন, আক্রান্ত ২ হাজার ৯২৯ জন। অর্থাৎ দেশটিতে মোট মৃত্যুর ঘটনা ১ হাজার ৩৩১টি, আক্রান্ত ২৫ হাজার ২৩৩ জন।
এমআরএম/এমকেএইচ