স্বপ্নীল মালয়েশিয়া গড়ার কারিগর বাংলাদেশিরা
স্বপ্নীল মালয়েশিয়ার চাকচিক্যময় রূপের পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন বাংলাদেশি শ্রমিকরাই। অক্লান্ত শ্রম ও মেধায় ‘বাংলাদেশিরা’ই গড়েছেন আধুনিক মালয়েশিয়া। আর এ মেধাবীদের নেতিবাচকভাবেই বাংলাদেশিদের ‘বাংলা’ বলে সম্বোধন করা হয় দেশটিতে।
জীবন-জীবিকার তাগিদে এদেশে এসেছেন তারা। কিন্তু মালয়েশিয়া তাদের যতটা দিয়েছে, তার চেয়ে কম দেননি তারাও এই দেশটিকে। নিজ হাতে গড়েছেন এদেশের যত স্থাপনা, অবদান রেখেছেন কৃষিতে।
এখানে বাংলাদেশিদের মেধার পাশাপাশি রয়েছে শ্রমের অবদান। অনেক বছর ধরে এদেশে থাকা প্রবাসীরা জানান, পুত্রজায়া, সাইবারজায়া,তামিলজায়া, পাহাং, শাহ আলম, মালাক্কা, চেরাস, পুচং, কাজাং, জহুরবারু, পেনাংয়ের মনোমুগ্ধকর রূপের পেছনে রয়েছেন লাল সবুজ পতাকার দেশের ‘শিল্পীরা’ই।
এদেশে বাংলাদেশি শ্রমিক ক্রমেই বেড়ে চলেছে। তবে এদেশে আসা শ্রমিকদের দক্ষতা ও বৈধতার বিষয়টিতে জোর দিচ্ছেন এখানে অবস্থানরত প্রবাসীরা। তাদের মতে, কাজের সুযোগ এখানে বিস্তর। মালয়েশিয়া জুড়ে চলমান ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিটের (এমআরটি) কাজে বাংলাদেশি শ্রমিকই বেশি। অনেক জায়গা রয়েছে এখনও অনাবাদী। সেখানে কৃষিতে লাগতে পারে হাজার শ্রমিক।
তাই নিজেদের ভালোর জন্যই দক্ষতা ও বৈধতা নিয়ে আসা উচিত বলে মন্তব্য করেন নির্মাণ শ্রমিক নরসিংদীর মো. মকবুল হোসেন। একযুগ ধরে মালয়েশিয়ায় থাকা মকবুল হোসেন বলেন, ‘মালয়েশিয়ার সবচেয়ে সুন্দর আর দৃষ্টিনন্দন শহর পুত্রজায়া। এই শহরের প্রতিটি ইট-সুড়কি বাংলাদেশের শ্রমিকদের হাতে গাঁথা।’
তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘পাহাড় কেটে রাস্তা গড়েছি, বাড়িঘর হয়েছে। সবাই যখন এই জায়গাকে সুন্দর বলে, তখন নিজের ভেতরে অন্যরকম লাগে। কারণ, আমাদের ঘাম এখানেই ঝরেছে, এখানেই শুকিয়েছে।’
মকবুল হোসেনেরও আজ ভালো অবস্থা। কয়েকবছর ধরে সাব কন্টাক্টে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। তিনি জানান, বাংলাদেশের দক্ষ শ্রমিকদের সঙ্গে অনেক সময় পেরে ওঠেন না অন্য দেশের শ্রমিকরা। বিশেষ করে তামিলরা। তারাই কিছুটা ঈর্ষা হয়ে জায়গা দখলের প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশিদের জন্য সমস্যা তৈরি করেন।
এছাড়া কিছুক্ষেত্রে বাংলাদেশিদেরও ভুল রয়েছে।’ নিজেদের ঐক্যের অভাবেই অন্যরা আজ ‘বাংলা’ বলে তাচ্ছিল্য করার সুযোগ পায় বলে মনে করেন তিনি।
অথচ এদেশের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বাংলাদেশিদের অবদান। এসব প্রশস্ত রাস্তা, উঁচু দালান-কোঠা সর্বত্রই রয়েছে বাংলাদেশিদের হাতের ছোঁয়া। কুয়ালালামপুর থেকে চেরাস, কাজাং তামিলজায়ার দিকে যাওয়ার রাস্তা সরু ছিল এক সময়। সেগুলো আজ প্রশস্ত, অবদান বাংলাদেশিদের। পাহাড় কেটে রাস্তা বানানোর কাজটি তারাই করেছেন।
নির্মাণ শ্রমিক সিলেটের আমিরুল একযুগ ধরে মালয়েশিয়ায় কাজ করছেন। তিনি বলেন, ‘নিজ বাড়ির আঙিনার কাজ যেমন যত্নে করে মানুষ, সেই যত্নেই কাজ করেছি। এখান থেকে রুটি-রুজি বলেই শুধু না, এখানকার মানুষের আদর-ভালোবাসাও কাজের উৎসাহ দিত।’
আমিরুল ও মকবুল কাজের ফাঁকে দেশ থেকে আসা শ্রমিকদের সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। তারা বলছেন, যারা কলিং ভিসায় আসছে, তারা যেন ভালো কাজ করার সুযোগ পায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নির্মাণশ্রমিক ক্ষোভের সঙ্গে এ প্রতিবেদককে জানান, বাংলাদেশিরাই কখনও কখনও বাংলাদেশিদের জন্য সমস্যা তৈরি করে। সেই সুযোগটি নেয় তামিলসহ অন্যরা। বাংলাদেশিরা একে অন্যের পাশে না দাঁড়ানোর কারণে সমস্যায় পড়েন বেশি।
তার সঙ্গে সুর মেলালেন নির্মাণ শ্রমিক আবুল। আবুল বলেন, ‘বাংলাদেশিদের ওপর বিভিন্ন সময়ে অন্যরা নানা রকম অত্যাচার করে। অনেক সময় প্রতিবাদের মানুষ জোটে না বলে কোনো ঘটনার তেমন সমাধানও হয় না।’
দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে এই প্রবাসীরা জানান, ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৮ সাল-এ সময়টিতে বাংলাদেশিরা বেশ নিরীহ ছিল। তাদের ওপর পূর্ব ভারত থেকে আসা মালয়ী তামিলরা অত্যাচার করত, সুযোগ পেলেই ছিনতাই করত।
এসব তামিলরা বাংলাদেশিদের কাছে এটা-সেটা চাইত, না দিলে গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করত না। শুধু তাই নয়, তাদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে মেরে পাসপোর্ট কেড়ে নিত।
ধীরে ধীরে বাংলাদেশিরাও তাদের টেক্কা দিয়ে চলার জ্ঞান অর্জন করে। তবে অভিজ্ঞরা জোর দিয়েই বলছেন, যারা দক্ষ ও বৈধ হয়ে এদেশে আসছেন তাদের অবস্থায় এক সময় ভালো হয়েছে। কারণ তাদের ভয় কম থাকে, আয়ও বাড়ে নির্বিঘ্নে। কাজ করতে পারে বলে কাজ ভালো হয়। সফলতাও আসে দ্রুত।
এভাবে নিজের ও দেশের সম্মান বিবেচনায় রেখে চললে ‘বাংলা’ নামটিই এক সময় প্রশংসা ও গর্বের হয়ে উঠবে বলে প্রবাসীরা মনে করছেন।
এসআর