প্রবাসী পারভীনের এক শরীরে বাবা-ছেলের অমানবিকতা
‘আর সইতে পারছি না। দেশে ফিরতে না পারলে গলায় দড়ি দেয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। পেটের দায়ে বিদেশে আইছি, এখন না খেয়ে মরছি। আমায় বাঁচান। আমি বাঁচতে চাই। ক্ষুধার জ্বালায় পরাণ যায় যায়। এমন রুগণ শরীরেও মালিকের নির্যাতন। আবার মালিকের ছেলেও ছাড়ে না। মালিকের মেয়ের নির্যাতন অারও অসভ্য, ভয়ঙ্কর।'
বিদেশে এসে তিনবার বিক্রি হয়ে এখন নরকে আছি। আমায় দেশে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করেন। আমায় রক্ষা করুন। একটু ভালো থাকার জন্য সৌদি আরবে গিয়েছিলেন গৃহকর্মী পারভীন আক্তার। এখন মরণকান্নাই সার। সব খুইয়ে বিদেশের মাটিতে পাড়ি দিয়ে খুলনার খালিশপুরের এ নারীর বেঁচে থাকাই এখন দায়।
পারভীনের সঙ্গে ফোনালাপে জানা গেছে, প্রথমে যে মালিকের কাছে ছিলাম ওই মালিক বেতন চাওয়ায় আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। সেই থেকেই আমি খুব অসুস্থ। ১০ মাস ধরে কষ্ট করছি। এরা চিকিৎসাও করায় না। বাইরে যাওয়ার সুযোগও দেয় না। এ দেশের মানুষ যে এত খারাপ আগে বুঝিনি।
কীভাবে সৌদি এসেছেন জানতে চাইলে পারভীন বলেন, আমাদের গ্রামে আরও কয়েকজন এ ভিসায় সৌদি আরবে এসেছেন। মূলত তাদের কথা শুনেই ঢাকায় এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করি। পরে ঢাকার ওই এজেন্সিই সব ব্যবস্থা করে। সৌদি আরবে আমার দু'বছর তিন মাস চলছে।'
মালিক পরিবর্তনের বিষয়ে জানতে চাইলে পারভীন জানান, মালিক আমাকে ছাড়তে চায় না। কথা বললেই নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে থাকে। আমাকে এ পর্যন্ত তিনবার বিক্রি করেছে। দেশে আসার চেষ্টায় বহু টাকা-পয়সা নষ্ট হয়েছে। বিষয়টি বারবার এজেন্সিকে জানানো হয়েছে তারপরও তারা কোনো খবর নেয়নি।
রেহেনা পারভীনের মেয়ে মালা খাতুন জানান, বাবা খুব অসুস্থ। পরিবারের সচ্ছলতা ফেরাতে মা গৃহকর্মী ভিসায় সৌদি আরবে গেছেন। সৌদিতে পৌঁছানোর পর থেকে মা প্রচণ্ড কান্নাকাটি করে। সৌদির মালিকরা প্রতিনিয়ত অত্যাচার করে। মা'কে বাথরুমে পর্যন্ত আটকিয়ে রাখে। ঠিকমতো টাকা-পয়সাও দেয় না। দেশে ফেরানোর জন্য ঢাকার বিভিন্ন এজেন্সির দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি। এমনকি প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়েও গেছি। সবাই আশ্বাস দেয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো কাজ হয়নি।
পারভীনের মেয়ে মালার অভিযোগ, এ বিষয়ে জানতে এজেন্সি স্মার্ট কেয়ার কর্পোরেশনে যোগাযোগ করা হলে তারা জানায়, পারভীন আক্তারকে আমরাই গৃহকর্মী ভিসায় সৌদি আরব পাঠিয়েছি। মূলত এ ধরনের সমস্যা হয় না। ভয়েস রেকর্ড করে পাঠানো হয়েছে। দ্রুত সমাধান হয়ে যাবে।
মালার অভিযোগ- বিষয়টি সমাধানের জন্য বহুবার স্মার্ট কেয়ার এজেন্সিতে গেছি। অভিযোগ দিয়েছি। এমনকি ওদের হাতে পায়ে ধরেছি তারপরও সমাধান হচ্ছে না। খুলনা থেকে ঢাকা আসতে আমাদের বহু টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু কোনোদিক দিয়ে কিচ্ছু হচ্ছে না।
রেহেনা পারভীনে চাচাতো ভাই জানান, বুঝতে পারছি না কি করব। দীর্ঘদিন থেকে এজেন্সিগুলোর কাছে যাচ্ছি। কোনো কাজ হচ্ছে না। ঢাকায় বহু মানুষের কাছে বিষয়টির জন্য বলেছি। বাংলাদেশ সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছি আমার বোনকে দেশে ফেরানোর জন্য।
সৌদি আরবের রিয়াদে দুই বছরের বেশি সময় ধরে থাকা পারভীন আক্তার আরও জানান, দালালের সঙ্গে যে কাজের কথা বলে তিনি এসেছেন সে কাজতো পাইনি বরং আমাকে মাত্র ৫০০ সৌদি রিয়াল বেতনে (বাংলাদেশি টাকায় ১১ হাজার) একসঙ্গে তিন বাসার গৃহকর্মীর কাজ দেয়া হয়েছে। দুই বছর ধরে কাজ করার পরও এক টাকাও বেতন বাড়ানো হয়নি।
বিদেশে নারী গৃহকর্মী দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের বিধিমালা থাকলেও কিছু অসাধু ট্রাভেল এজেন্সি সরকারের দেয়া নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ভাড়াটে দালালদের মাধ্যমে নানা রকম মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে হাজার হাজার নারীকে বিদেশে পাঠায়। এর মধ্যে সব থেকে বেশি নারী শ্রমিক পাঠানো হয়েছে সৌদি আরবে।
এএসএস/এমআরএম/পিআর