স্বপ্নের মালয়েশিয়ায় দুঃস্বপ্নের জীবন
কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠেই হোটেলে হাউজকিপিংয়ের কাজ করতে ছুটে চলা আর রাতে কাজ শেষে বাসায় ফিরে ক্লান্ত হয়ে ঘুম। আবার সকাল হলেই কাজে ছুটে চলা। গত চার মাস ধরে এভাবেই দিনরাত কাটছে মালয়েশিয়া প্রবাসী ১৬ বছরের সুদর্শন যুবক মোফাজ্জলের।
দু’চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে স্টুডেন্ট ভিসায় মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমালেও কয়েক মাসের মধ্যেই মোফাজ্জেলের কাছে প্রবাসের এ জীবন দুঃস্বপ্নের জীবন হয়ে ওঠে। স্থানীয় এক এজেন্টের মাধ্যমে মাসিক দেড় হাজার রিঙ্গিত বেতনে কুয়ালালামপুরের একটি হোটেলে কাজ করছেন তিনি। প্রায় পাঁচ মাস আগে তিন লাখ টাকা খরচ করে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমায় এই যুবক।
রোববার বুকিত বিনতাং এলাকার হোটেলটিতে জাগো নিউজের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে মোফাজ্জল জানান, প্রতিদিন একনাগাড়ে ১২ ঘণ্টা ডিউটি করতে হয়। দিনে গড়ে ২০ থেকে ২৫টি রুমের বিছানার চাদর বিছানো, ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করা, প্রতিটি রুমে তোয়ালে, সাবান, শ্যাম্পু ও গোসলখানার বিভিন্ন সামগ্রী সাজিয়ে রাখার কাজ করতে করতে অনেকটা যন্ত্রের মতো হয়ে গেছেন। সারাদিন একটানা কাজে ব্যস্ত থাকায় সূর্যের আলো ভালো করে কবে দেখেছেন মনে পড়ে না।
টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল থানার ধলাপাড়া গ্রামের সাইদুর রহমানের দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে দ্বিতীয় মোফাজ্জল গ্রামে থাকতে নিজের হাতে এক গ্লাস পানিও তুলে খেতেন না বলে জানান। কিন্তু প্রবাস জীবনে তাকে বেঁচে থাকার সংগ্রামে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হচ্ছে।
কেন-কীভাবে কুয়ালালামপুরে এলেন জানতে চাইলে প্রথমে ইতস্ততা বোধ করলেও এক পর্যায়ে তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, এসএসসি পাসের আগেই তাকে ফেসবুকের নেশায় পেয়ে বসে। পড়ালেখায় মনোযোগ ছিল না। সারারাত জেগে ফেসবুক চালানো আর দিনভর ঘুমানো।
কোনোভাবে এসএসসি পাস করে কলেজে ভর্তি হয়। এরই মধ্যে তার কয়েকজন বন্ধু তাকে মালয়েশিয়ায় পড়াশোনার পাশাপাশি কাজের সুযোগ আছে বলে স্বপ্ন দেখায়। এরপর থেকেই চিন্তা-চেতনায় শুধু মালয়েশিয়া আসার স্বপ্ন।
কিন্তু এখানে আসার পর সে জানতে পারে স্টুডেন্ট ভিসা সবচেয়ে খারাপ ভিসা। কলেজে পড়ালেখার পাশাপাশি কাজের সুযোগ নেই বললেই চলে। এদিকে দেশ থেকে নিয়ে আসা টাকাও ফুরিয়ে আসে। অবশেষে নিরুপায় হয়ে স্থানীয় এক এজেন্টের মাধ্যমে হোটেলে চাকরি নেন।
মোফাজ্জল জানান, এক বছর পর ভিসা নবায়নের জন্য তাকে ছয় থেকে সাত হাজার রিঙ্গিত দিতে হবে, নতুবা তাকে এ দেশ ছেড়ে যেতে হবে। এখানে থাকা-খাওয়ার খরচও অনেক বেশি। যে টাকা বেতন পান সে টাকায় একটু ভালো বাসায় থাকতে গেলে টাকা জমানো খুব মুশকিল। তাই কম টাকার বাসা ভাড়া নিয়ে কোনোভাবে রাত কাটায়। ছারপোকার কামড়ে প্রায় রাতেই ঘুম আসে না।
মোফাজ্জল আরো জানান, তাদের আর্থিক অবস্থা খারাপ না। দেশে তার বাবার ইট-ভাটার ব্যবসা রয়েছে। আগামী এক বছর সে চাকরি করে টাকা-পয়সা জমাতে না পারলে দেশে ফিরে আসবে। মালয়েশিয়ায় এসে সে নতুন করে জীবনকে চিনেছে। ফেসবুক আর বন্ধুবান্ধবের আড্ডায় আর সময় কাটাবে না। একটি গাড়ি কিনে নিজেই ড্রাইভিং করে টাকা-পয়সা উপার্জন করবে। দুঃস্বপ্নের জীবন থেকে মুক্ত হয়ে নিজ দেশেই স্বপ্নের জীবন শুরু করবে।
মালয়েশিয়ায় এ জীবনের গল্প শুধু মোফাজ্জলের একার নয়, হাজার হাজার তরুণ-যুবকের।
এমইউ/বিএ/এনএইচ/আরআইপি