ভিডিও EN
  1. Home/
  2. প্রবাস

ড. ইউনূসের দৃষ্টিভঙ্গি ও বর্তমান বাংলাদেশ

রহমান মৃধা | প্রকাশিত: ০৯:২৭ এএম, ১৬ নভেম্বর ২০২৪

ড. মুহাম্মদ ইউনূস, নোবেলজয়ী এই বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব, বাংলাদেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য বারবার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছেন। তার সাম্প্রতিক বক্তব্যগুলোতে উঠে এসেছে মানুষের মৌলিক অধিকার, বিশেষ করে পাসপোর্ট, শিক্ষার সুযোগ, প্রবাসীদের সমস্যার সমাধান এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সহজীকরণ।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস, বাংলাদেশ এবং বিশ্বব্যাপী নন্দিত নোবেলজয়ী, বিশ্বকে একটি টেকসই ও সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনের জন্য তার ‘থ্রি জির থিওরি’ - তিনটি শূন্য নীতি - প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন। এই থিওরির মূল ধারণা হলো একটি এমন পৃথিবী, যেখানে কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনা হবে, সম্পদের অসম বণ্টন রোধ করা হবে এবং সবার জন্য কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা হবে। জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম প্রধান সংকট এবং এর ভয়াবহ প্রভাব আমাদের দেশের উন্নয়ন ও টেকসই ভবিষ্যতের জন্য হুমকি স্বরূপ।

এই প্রেক্ষাপটে, ড. ইউনূসের ‘জিরো কার্বন এমিশন’ লক্ষ্য পূরণে তিনি একদিকে যেমন পাসপোর্ট, কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকারগুলোকে নিশ্চিত করার কথা বলেছেন, তেমনি বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি, প্রবাসীদের সম্মানজনক অবস্থান এবং দেশের দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নের দিকেও নজর দিতে বলেছেন।

তার বক্তব্য অনুসারে, দেশের উন্নয়নকে টেকসই করতে হলে আমাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং বৈদেশিক সম্পর্ককে আরও সঠিকভাবে পরিচালনা করতে হবে। এ ধরনের উদ্যোগই একটি দরিদ্রতামুক্ত, উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পারে। তবে এই প্রক্রিয়ায় যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে, সেগুলো কীভাবে মোকাবিলা করা যেতে পারে তা গভীরভাবে বিবেচনা করা জরুরি।

পাসপোর্ট: জনগণের মৌলিক অধিকার;

ড. ইউনূস পাসপোর্টকে জনগণের অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। একটি পাসপোর্ট শুধু একটি ভ্রমণ নথি নয়; এটি বৈশ্বিক নাগরিকত্বের প্রতীক। বর্তমানে বাংলাদেশে পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে গিয়ে সাধারণ জনগণ নানা জটিলতায় পড়ে। দীর্ঘ সময়, ঘুস বা দুর্নীতি এবং প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনার কারণে মানুষ এই মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। একটি কার্যকর প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও সুশাসনের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব। পাসপোর্টের প্রক্রিয়া সহজীকরণ করা গেলে বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি দেশের সম্মানও বাড়বে।

প্রবাসী রেমিট্যান্স ও এয়ারপোর্টে ঝামেলা;

প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি। অথচ তারা যখন দেশে ফেরেন, বিমানবন্দরে তাদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং হয়রানির ঘটনা নিয়মিত শোনা যায়। তাদের কষ্টার্জিত অর্থ দেশের অর্থনীতি সচল রাখছে, অথচ তাদের মর্যাদা ঠিকভাবে দেওয়া হয় না। ড. ইউনূসের বক্তব্য এই বিষয়ে আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। বিমানবন্দরগুলোতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার, স্বচ্ছতা এবং যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রবাসীদের অভিজ্ঞতা উন্নত করা সম্ভব।

বিদেশে শিক্ষার সুযোগ;

উন্নত বিশ্বে উচ্চশিক্ষার সুযোগ বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য বড় একটি স্বপ্ন। কানাডা, আমেরিকা বা জার্মানির মতো দেশে পড়াশোনা করার সুযোগ বাড়ানো গেলে দেশের দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা সম্ভব। ড. ইউনূসের কথা অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়ানো, ভিসার প্রক্রিয়া সহজীকরণ এবং সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করা হলে শিক্ষার্থীদের জন্য দরজা খুলে যাবে। এই উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন হলে দেশের মানবসম্পদ উন্নত হবে এবং তারা ভবিষ্যতে দেশের উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখতে পারবে।

বৈদেশিক কর্মসংস্থান: সহজ ও সম্মানজনক প্রক্রিয়া;

মালয়েশিয়া, জার্মানি বা অন্যান্য দেশে কাজের সুযোগকে সহজ ও ঝামেলামুক্ত করার প্রস্তাব একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হতে পারে। বর্তমানে বিদেশে চাকরির জন্য পাসপোর্ট, ভিসা এবং অন্যান্য প্রক্রিয়ায় প্রচুর সময় ও অর্থ ব্যয় করতে হয়। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য এবং সরকারি ব্যবস্থার জটিলতার কারণে অনেকেই প্রতারণার শিকার হন। ড. ইউনূসের প্রস্তাব অনুসারে, সরকার যদি সরাসরি বৈদেশিক নিয়োগ সংস্থাগুলোর সঙ্গে চুক্তি করে এবং স্বচ্ছ প্রক্রিয়া চালু করে, তবে এটি দেশের শ্রমশক্তি রপ্তানির জন্য একটি বড় পদক্ষেপ হবে।

রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব ও বর্তমান অবস্থা;

ড. ইউনূস যথার্থই বলেছেন, দেশের কর্মরত রাষ্ট্রদূতদের অনেক আগেই এসব সমস্যার সমাধানে কার্যকর ভূমিকা নেওয়া উচিত ছিল। তারা দেশের বাইরে বাংলাদেশের প্রতিনিধি, অথচ তাদের কর্মদক্ষতা ও আন্তরিকতার অভাবে সমস্যাগুলো আরও জটিল হয়েছে। সদ্য সুইজারল্যান্ডে বাংলাদেশের উপদেষ্টার ওপর হেনস্তার ঘটনা আরও একবার এই সমস্যার দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। রাষ্ট্রদূতদের আরও দায়িত্বশীল হতে হবে এবং তাদের কাজের ওপর নিয়মিত নজরদারি চালাতে হবে।

গ্রামকে প্রযুক্তিবান্ধব ও প্রকৃতিসম্মত করার দৃষ্টিভঙ্গি;

বাংলাদেশের গ্রামগুলোকে প্রযুক্তি ও প্রকৃতিসম্মত উন্নয়নের আওতায় আনা একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ হতে পারে। প্রযুক্তির ব্যবহারে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন এবং শিক্ষা প্রসারে অভাবনীয় পরিবর্তন আনা সম্ভব। সোলার প্যানেল, ইন্টারনেট সংযোগ এবং পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো গড়ে তোলা গেলে গ্রামাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা উন্নত হবে। পাশাপাশি, গ্রামকে সবুজ রাখার জন্য বৃক্ষরোপণ ও টেকসই কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

সব সরকারি কর্মচারীদের জনগণের সেবায় অনুপ্রাণিত করতে হলে তাদের প্রশিক্ষণ ও নৈতিক শিক্ষা বাড়াতে হবে। দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়ে তুলতে হলে প্রয়োজন কার্যকর পর্যবেক্ষণ এবং পুরস্কার ও শাস্তির নীতিমালা। জনসেবা মানসিকতা তৈরি করতে কর্মচারীদের জন্য স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ বাড়ানো যেতে পারে, যেন তারা তাদের চাহিদা ও সমস্যাগুলো কাছ থেকে উপলব্ধি করতে পারেন।

উন্নয়ন বনাম অগাছা পরিষ্কার;

ড. ইউনূসের দেওয়া উদাহরণ—গাছ এবং অগাছার তুলনা—আমাদের চিন্তার গভীরে প্রোথিত হওয়া উচিত। একটি দেশকে উন্নত করতে হলে অগাছাগুলো পরিস্কার করতে হবে। দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, এবং অদক্ষতাকে অগাছার সঙ্গে তুলনা করলে এটি স্পষ্ট হয় যে, সেগুলো দেশের উন্নয়নপ্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। অগাছা নিজে থেকেই গজায়, কিন্তু ফলনশীল গাছগুলো যত্ন নিতে হয়। এজন্য, দক্ষ জনশক্তি তৈরি, স্বচ্ছতা এবং সমন্বিত উন্নয়ন পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন সম্ভব।

প্রভাব ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা;

ড. ইউনূসের প্রস্তাবিত উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের অর্থনীতি, শিক্ষাব্যবস্থা এবং বৈদেশিক সম্পর্ক একটি নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে। তবে, এর জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক দক্ষতা এবং নাগরিক অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

অবশেষে, আমাদের মনে রাখতে হবে, উন্নয়ন একটি সম্মিলিত প্রয়াস। ড. ইউনূসের কথা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে এবং দায়িত্বের বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে অগাছাগুলো উপড়ে ফেলতে হবে এবং ভালো ফলন পেতে হলে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। এটি কেবল সরকারের নয়, বরং আমাদের সবার দায়িত্ব।

রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক ফাইজার, সুইডেন
[email protected]

এমআরএম/এএসএম