ভিডিও EN
  1. Home/
  2. প্রবাস

আমি কলঙ্কিনী হয়ে বাঁচতে চাই না!

রহমান মৃধা | প্রকাশিত: ০১:৩৩ পিএম, ১৮ অক্টোবর ২০২৪

আমি সেই মা, যাকে তার সন্তানেরা ভালোবেসে ‘সোনার বাংলা’ বলে ডাকে। ভাষা আমার বাংলা, দেশও বাংলা। কত সুন্দর! এই নাম আমি পেয়েছিলাম আমার পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে। আমার তিন দিকে ভারত, তবুও আমি গর্বের সাথে যুগ যুগ ধরে বুকভরা ভালোবাসা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।

আমার কোলে জন্ম নেওয়া আমার সন্তানেরা আমাকে ভীষণ ভালোবাসতো। সেই ভালোবাসার সাক্ষী আমি যুগ যুগ ধরে হয়ে আছি। আমার ওপর বারবার ঝড় এসেছে, আঘাত এসেছে, তবুও আমার সন্তানরা আমাকে রক্ষা করেছে। একবার আমার নাম বদলানো হয়েছিল, কিন্তু তাতে আমার আত্মার কোনো ক্ষতি হয়নি। কারণ, আমার সন্তানরা সেই বহিঃশত্রুকে তাড়িয়ে আমাকে মুক্ত করেছে। কত সন্তান আমার জন্য জীবন দিয়েছে, তাদের সেই আত্মত্যাগ আমি কখনও ভুলতে পারি না।

আমার বুকের মধ্যে আশ্রয় নিয়ে তারা বড় হয়েছে। ভালোবাসার আলিঙ্গনে মুগ্ধ হয়ে তারা আমাকে সোনার বাংলা করার স্বপ্ন দেখিয়েছে। আমি ভেবেছিলাম, বাকি জীবনটা তাদের সঙ্গেই সুখে কাটাব। কারণ, আমার তো সবই আছে—স্বাধীনতা, উর্বরতা, প্রাচুর্য।

তারা প্রতিনিয়ত ফসল ফলাচ্ছে, যে যা ইচ্ছে তাই ফলাতে পারছে। আমাকে ‘সোনার বাংলা’ বলে সবাই স্নেহ করে, আমাকে ‘সকল দেশের রাণী’ বলেও আখ্যা দেয়। আমি ভাবতাম, এই উন্নত সমাজ গঠনের যাত্রা সার্থক হবে। কিন্তু কী চেয়েছিলাম আর কী হচ্ছে!

আজ ৫৩ বছর কেটে গেলো!

কিন্তু কোথায় সেই উন্নত সমাজ? আমি তো আর পারছি না এই পশ্চাদপদতা সহ্য করতে! কী অন্যায় করেছি আমি, যে আমার নিজের সন্তানেরা আজ আমার বুকের ওপর বিষ ঢালছে? আমার উর্বরতা করছে ধ্বংস, কর্মক্ষমতা নষ্ট করছে। তারা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছে। আমার সংখ্যালঘু, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের করছে বিতাড়িত— অথচ, সবাই আমার সন্তান।

তারা আমার নামের ওপর কলঙ্কের ছাপ ফেলে দিচ্ছে, আর গোটা বিশ্ব আমাকে কলঙ্কিনী বলে ঠাট্টা করছে। আমার সন্তানদের মধ্যে অনেকেই দুর্নীতিতে নিমজ্জিত, ঘুসখোর হয়ে উঠেছে। কেন? আমি কী অপরাধ করেছি যে তারা আমাকে এত ছোট করছে?

তারা কি দিনের পর দিন অন্ধকারে ডুবে থাকবে? নৈতিকতা, সুশিক্ষা বিসর্জন দিয়ে কুশিক্ষার বীজ বপন করছে। কারিকুলামের উন্নতি হচ্ছে না, উত্তম শিক্ষকের অভাব প্রকট। অথচ শিক্ষাই তো একটি জাতির মেরুদণ্ড! তারা শুধুই সার্টিফিকেট নিচ্ছে, কিন্তু সুশিক্ষিত হয়ে উঠছে না। মানবসম্পদ তৈরির সেরা উপায়— জ্ঞাননির্ভর শিক্ষা, পেশাগত দক্ষতা, সেটাও তারা বুঝতে চায় না।

আমার সন্তানরা কোথায়?

যারা একদিন শিক্ষার কারিগর ছিল, তারাও এখন আমার মুখে চুনকালি মাখাচ্ছে। পরীক্ষায় নকল করছে, দায়িত্ব-কর্তব্য এড়িয়ে যাচ্ছে। তারা কি সত্যি আমাকে পৃথিবীর নিম্নস্তরে নিয়ে যেতে চায়? আমার ১৭ কোটি সন্তানের মধ্যে কেউ নেই যে এর প্রতিবাদ করবে? কেউ কি নেই আমার সুন্দর সমাজ গড়ার স্বপ্নকে বাস্তব করতে? কেন তারা এত নিশ্চুপ? কেন তারা সুশিক্ষা গ্রহণ করছে না? কেন তারা নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাইছে না? কেন তারা আমাকে সম্মানিত করার পরিবর্তে অপমানিত করছে?

তবুও আশা ছাড়িনি!

আমি জানি, আমার সন্তানদের মধ্যে ভালোবাসা এখনও আছে। আমি সেই দিনটির অপেক্ষায় আছি, যেদিন তারা আমাকে সত্যিকারের ‘সোনার বাংলা’ করবে। তারা শপথ নেয় আমাকে ভালোবাসার, আমাকে শ্রদ্ধা করার— কিন্তু কেন তারা তা ভঙ্গ করে? আমি তো তাদের মা! আমি তাদের জন্য সব উজাড় করে দিয়েছি, আমার যা কিছু আছে, সবই তাদের। তারা কি সেই গর্ব, সেই বিশ্বাস, সেই আশাকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না? তারা কি আমাকে আবার নতুন করে গড়বে না?

আমার স্বপ্ন!

বাংলাদেশি জাতি অসাধারণ মানবিক গুণাবলি সম্পন্ন, তাদের মধ্যে যেমন সৃজনশীলতা, আবেগ, বন্ধুত্বপ্রবণতা আছে, তেমনি আছে কিছু দুর্বলতা। সমালোচনা, পরশ্রীকাতরতা এবং মিথ্যাচারের বিষ ছড়িয়ে পড়েছে সমাজের বিভিন্ন স্তরে।

তবুও আমি বিশ্বাস করি, সঠিক দিকনির্দেশনা এবং মানসিক উন্নতির মাধ্যমে তারা এই সকল দুর্বলতা থেকে বেরিয়ে আসবে। ধর্ম, গণতন্ত্র, এবং নৈতিকতার মধ্যে ভারসাম্য এনে তারা নতুন পথ তৈরি করবে। তারা সুশিক্ষা গ্রহণ করে আমাকে বিশ্বের মর্যাদাশীল দেশ হিসেবে গড়ে তুলবে।

আমার স্মৃতি

আমার প্রায় এক কোটি সন্তানেরা আজ আমাকে ছেড়ে দূরপ্রবাসে। তারা প্রবাসের অচেনা মাটিতে দিন কাটাচ্ছে, পরিশ্রম করছে—শুধু একটাই স্বপ্ন নিয়ে, যে একদিন তারা আমাকে (আমার সোনার বাংলাকে) সোনার চেয়েও খাঁটি করবে। সেই প্রত্যাশায় তারা কঠিন সংগ্রাম করে চলেছে, আমি জানি। তাদের মধ্যেই একজন আমার বুকের ধন। সে যখন ছোট ছিল কী না করেছে আমার জন্য, বিশেষ করে সেই ১৯৭১-এর যুদ্ধে! তারপর দেশ স্বাধীন হলো মনের আনন্দে তখন কতই না খেলাধুলা করতো আমার সোনার মাটিতে। সেই সময়গুলো ছিল আমার জীবনের সেরা মুহূর্ত। কিন্তু সময় বদলেছে। জীবনের তাগিদে, ভবিষ্যতের আশায়, সে আমাকে ছেড়ে প্রবাসে গেছে। আমি জানি, প্রবাসে জীবন সহজ নয়। সেখানে প্রতিটি দিনই তার জন্য নতুন একটি পরীক্ষা, নতুন এক লড়াই।

প্রবাসের কঠিন পরিবেশে থেকেও, সে আমার কথা ভাবে। সে আমার জন্য দুঃখবোধ করে, আমাকে মনে করে। মাঝে মাঝে আমার কথা ভেবে হয়তো তার চোখে জলও আসে। প্রবাসের ব্যস্ততা, একাকীত্ব, সবকিছু সহ্য করে, সে একটি আশায় বেঁচে আছে—একদিন সে ফিরে আসবে আমার কোলে। আমি জানি, তার মনের কোণে এখনও সেই ছোট্ট ছেলেটি লুকিয়ে আছে, যে প্রতিদিন আমার কোলের আশায় থাকতো।

আমার এই সন্তান প্রবাসে থেকে নিজেকে গড়ে তুলছে, নিজের ভবিষ্যৎকে নির্মাণ করছে, আর সেই সঙ্গে আমার দেশের ভবিষ্যতের জন্যও লড়াই করছে। একদিন সে তার অর্জন নিয়ে আমার কাছে ফিরে আসবে। সে ফিরে আসবে, যখন আমার এই সবুজ মাটি আবার তার পায়ের ছোঁয়া পাবে। আমি জানি, আমার সন্তানেরা একদিন ফিরে আসবে—সবাই। তারা যে দেশ ছেড়ে গেছে, সেই দেশে ফিরে এসে নতুন এক দিনের সূচনা করবে।

আমি সেই দিনের অপেক্ষায় আছি, যেদিন আমার সন্তানেরা আর দূরপ্রবাসে নয়, আমার এই দেশে থাকবে। তারা নিজের দেশেই থাকবে, আমার বুকেই গড়ে তুলবে তাদের ঘরবাড়ি, তাদের স্বপ্ন। আমি দেখতে চাই, তারা আমার মাটিতে নিজেদের হাতের ছোঁয়ায় সোনার ফসল ফলাবে, নিজেদের ঘাম দিয়ে দেশ গড়বে।

আর আমি তখন বুক ভরে আতিথেয়তা করবো। শুধু আমার সন্তানেরাই নয়, অন্য দেশের মানুষও আমার বুকে এসে বসবাস করবে। আমি তাদের সবাইকে আপন করে নেবো, সবাইকে বুকে আগলে রাখবো। আমার মাটি তখন সমৃদ্ধ হবে শুধু সোনায় নয়, ভালোবাসায়, বন্ধুত্বে। আমার সন্তানেরা এবং অন্য দেশের মানুষেরা মিলেমিশে আমার বুকে নতুন স্বপ্ন বুনবে, নতুন ইতিহাস রচনা করবে।

এই আশায় আমি প্রতিদিন বাঁচি, এই আশায় আমি অপেক্ষা করি। কারণ আমি জানি, আমার সন্তানেরা আমাকে কখনও ভুলবে না। তারা একদিন ফিরে আসবেই, আমার বুকেই গড়ে তুলবে এক নতুন দিনের সূচনা। আমি সেই স্বপ্নই দেখি—আমার সোনার বাংলা হবে সত্যিই সোনার, যেখানে ভালোবাসা আর বন্ধুত্বের সুবাসে প্রতিটি ঘর জ্বলজ্বল করবে।

নতুন প্রজন্মের প্রতি আমার বিশ্বাস

আমি বিশ্বাস করি, আমার নতুন প্রজন্মও বড় হবে। তারা শিক্ষা নেবে, তারা সোনার বাংলাকে গড়বে। তাদের প্রয়োজন শুধু সাধনা, চেষ্টা, মোটিভেশন এবং আত্মবিশ্বাস। আমার প্রত্যাশা, এই প্রজন্ম এআই এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে জ্ঞানের আলোকিত পথ খুঁজে নেবে, এবং তারা নিজেদের আলোকিত করবে। তারা শিখবে সুশিক্ষার মর্ম, বুঝবে মূল্যবোধ। তারা বড় হবে, তারা দেশকে গড়ে তুলবে, তারা সেই সোনার বাংলা তৈরি করবে, যে স্বপ্ন একদিন আমি দেখেছিলাম। তারা গর্বের সাথে বলবে, ‘সকল দেশের সেরা সে যে আমার জন্মভূমি।’

আমার সন্তানেরা—তোমাদের কাছে আমার চাওয়া

তোমরা আমাকে গর্বিত করো! আমি চাই আমার প্রত্যেক সন্তান মনে-প্রাণে বলুক— ‘সকল দেশের সেরা সে যে আমার জন্মভূমি।’ আমি চাই তোমরা সুশিক্ষিত জাতি হয়ে আমাকে আলোকিত করো, আমাকে গর্বিত করো। আমি আর কলঙ্কিনী হয়ে বাঁচতে চাই না!
আমি সেই ভালোবাসার সোনার বাংলা হয়ে তোমাদের মাঝে থাকতে চাই।

রহমান মৃধা
সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
[email protected]

এমআরএম/এমএস