নিশ্চিত হোক শিক্ষাগুরুর মর্যাদা, আর নয় লাঞ্ছনা
আজ থেকে প্রায় ১৭ বছর আগের ঘটনা। তখন আমি ক্লাস ফাইভের শিক্ষার্থী। কবি কাজী কাদের নেওয়াজের লেখা একটি কবিতা সে সময় আমাদের পাঠ্যবইয়ে স্থান পেয়েছিল। কবিতার নাম ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের জীবনের একটি ঘটনা নিয়ে এ কবিতাটি রচিত হয়েছে। মূলত এ কবিতাটি শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়। আমাদের সমাজ বিনির্মাণে শিক্ষক ও শিক্ষিকাদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
সম্রাট আওরঙ্গজেবের অন্য নাম ছিল আলমগীর। বাবর, হুমায়ূন, আকবর, জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানের পর তিনি ছিলেন ষষ্ঠ মুঘল সম্রাট। ১৬১৮ সাল থেকে শুরু করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রায় ৪৯ বছর তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের শাসক হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তার শাসনামলে মুঘল সাম্রাজ্য সবচেয়ে বেশি বিস্তৃত হয়। দক্ষিণ ভারতের কিছু অংশ ছাড়া ভারতীয় উপমহাদেশের সম্পূর্ণ অংশ তিনি শাসন করেছিলেন। মৌর্য সম্রাট অশোক ছাড়া ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় কোনো শাসক খুঁজে পাওয়া যাবে না যার সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি সম্রাট আওরঙ্গজেবের মতো এতটা সুদীর্ঘ ছিল।
সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্রকে দিল্লির এক মৌলবি পড়াতেন। তিনি সম্রাটের বাড়িতে এসে তার পুত্রকে পাঠদান করতেন। একদিন সকালে সম্রাট দেখতে পান তার পুত্র একটি পাত্র হাতে নিয়ে তার শিক্ষকের পায়ে পানি ঢালছে। আর শিক্ষক নিজের হাত দিয়ে নিজেরই পায়ের ধুলাবালি ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করছেন। শিক্ষকের পায়ে কেবলমাত্র পানি ঢেলে সম্রাটের পুত্র তার শিক্ষকের প্রতি কর্তব্য সম্পাদন করছে। দূর থেকে এ দৃশ্য দেখে সম্রাট ভীষণ মর্মাহত হলেন। তিনি তাই তার ছেলের শিক্ষককে খাসকামরায় ডেকে পাঠালেন। শিক্ষক ভাবতে লাগলেন, হয়তো বা সম্রাটের ছেলেকে তার পায়ে পানি ঢালতে বলার কারণে সম্রাট ভীষণ রাগান্বিত হয়েছেন।
অত্যন্ত ভীত ও সন্ত্রস্ত অবস্থায় তিনি সম্রাটের সামনে উপস্থিত হলেন। সম্রাট তাকে দেখে বললেন, ‘আমার পুত্রকে আপনি পড়াচ্ছেন ঠিকই কিন্তু আপনার কাছ থেকে কোনো প্রকার ভদ্রতা, শিষ্টাচার বা আদব-কায়দা শিখতে পারছে বলে মনে হচ্ছে না।’ শিক্ষক প্রথমে তার কথার অর্থ বুঝতে পারলেন না। সম্রাট তাকে বললেন, ‘সকালে দেখলাম আমার পুত্র একটি পাত্র পায়ে নিয়ে আপনার পায়ে পানি ঢালছে। আর আপনি নিজ হাতে আপনার পায়ের ধূলা-ময়লা সাফ করছেন। এ ধরনের আচরণ নিছক বেয়াদবি আর গুরুজনের প্রতি অবহেলা ছাড়া আর কিছু নয়।’
তিনি শিক্ষককে প্রশ্ন করলেন, ‘আমার ছেলে কেনও নিজ হাতে আপনার পা পরিষ্কার করে দিলো না?’ সম্রাটের মতে তার পুত্র যদি শিক্ষকের পায়ে পানি ঢেলে দেওয়ার পাশাপাশি নিজের হাতে তার পা পরিষ্কার করে দিতেন, তাহলে কেবলমাত্র শিক্ষককে তার উপযুক্ত মর্যাদা প্রদান করা হতো। সম্রাটের কাছ থেকে শিক্ষক এ ধরনের কথা শুনে খুবই আনন্দিত হন। তিনি সম্রাটের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। কবি কাদের নেওয়াজ তার কবিতায় সম্রাটের প্রতি শিক্ষকের কৃতজ্ঞতাকে প্রকাশ করেছেন ঠিক এভাবে-
‘আজ হতে চির উন্নত হলো শিক্ষাগুরুর শির
সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ আলমগীর।’
বর্তমানে আমাদের দেশে যেসব স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থী রয়েছে, তারা ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ কবিতাটি পড়েছে কি না সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই। কেননা আমাদের সময়ে যে পাঠ্যবই ছিল, সেটি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একাধিকবার পরিবর্তন করা হয়েছে। তবে আমি মনে করি, বাংলাদেশ, ভারত বা পাকিস্তানের সমাজ ব্যবস্থায় শিক্ষকদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যকে কি রকম হবে, সেটা বোঝার জন্য ব্যক্তিগত উদ্যোগে হলেও এ কবিতাটি সবার পড়া জরুরি।
আমরা ছোটবেলা থেকে এ কথা শুনে বড় হয়েছি যে বাবা ও মায়ের পর শিক্ষক-শিক্ষিকাদের স্থান। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যদি বলতে চাই, প্রত্যেক ধর্মে শিক্ষকদের বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। ইসলামের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) থেকে শুরু করে সকল নবী ও রাসূলকে মানবজাতির জন্য প্রেরণ করা হয়েছে শিক্ষক হিসেবে।
হযরত আলী (রা) বলেছেন, ‘যার থেকে আমি একটি হরফ হলেও শিক্ষা লাভ করেছি, তিনি আমার মনিব আর আমি তাঁর দাস।’ নবী মুহাম্মদ (সঃ) বদর যুদ্ধে যুদ্ধবন্দিদের মুক্তির জন্য শিক্ষার বিনিময়ের ঘোষণা দিয়েছিলেন। যুদ্ধ শেষে মুহাম্মদ (সঃ) ঘোষণা দিয়েছিলেন, যেসব যুদ্ধবন্দি নিজেদের মুক্তির জন্য অন্তত দশজন শিশুকে লেখাপড়া শেখাতে পারবে, তারা মুক্তি পাবে।
দুর্ভাগ্যবশত আজকের বাংলাদেশে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমরা যেভাবে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের শিক্ষার্থীদের দ্বারা বিভিন্নভাবে হেনস্তা হতে দেখছি। একজন শিক্ষার্থী হিসেবে এ ধরনের ঘটনা আমার মাঝে উদ্বেগের সৃষ্টি করে। আমি জেনারেশন জেড এর একজন সদস্য এবং এ ধরনের ঘটনার জন্য আমি ভীষণ লজ্জিত ও অনুতপ্ত। এটা ঠিক যে সাম্প্রতিক সময়ে আমরা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মাঝে নীতি-নৈতিকতার স্খলন দেখেছি। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সাথে শিক্ষার্থীদের সম্পর্কের মাঝে বড় ধরনের ফাটল তৈরি হয়েছে।
শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অনেকে তাদের পেশার প্রতি সুবিচার করতে পারেননি। আমরা যখন স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থী ছিলাম, আমরাও বিভিন্ন সময়ে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের দ্বারা বিভিন্ন ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি। আমার স্পষ্ট মনে আছে যে ক্লাস টেনে অধ্যয়নকালীন আমাদের শ্রেণি শিক্ষক ছিলেন দুর্নীতিপরায়ণ। যদিও তিনি সব সময় নীতি-নৈতিকতার কথা বলতেন। তিনি ছিলেন এনায়েতপুরের পীর সাহেবের একজন মুরিদ। যেসব শিক্ষার্থী তার কাছে প্রাইভেট পড়তো, তাদের তিনি যেভাবে মূল্যায়ন করতেন, আমরা যারা তার কাছে প্রাইভেট পড়তাম না আমরা তার থেকে অনেক সময় সে ধরনের মূল্যায়ন পাইনি।
প্রাক নির্বাচনির গণিত পরীক্ষায় একটা অঙ্কে সামান্য ভুলের কারণে তিনি আমাকে কোনো নম্বর না দিয়ে শূন্য দিয়েছিলেন। যারা তার বাসায় বা কোচিং সেন্টারে প্রাইভেট পড়তে যেতো, তাদের অনেক সময় তিনি পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্রের কথা জানিয়ে দিতেন। আমাদের স্কুলে এ ধরনের অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকা ছিলেন যারা নীতি-নৈতিকতার দিক থেকে ছিলেন বিভিন্নভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। অথচ আমরা কোনো দিন কোনও শিক্ষক বা শিক্ষিকাকে অসম্মান করিনি।
এটা ঠিক যে, তাদের অগোচরে তাদের নিয়ে আমরা সমালোচনা করেছি। তাদের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করেছি। স্কুল বা কলেজ লাইফে অনেক সময় আমরা শিক্ষক-শিক্ষিকার সামনে দিয়ে হাঁটার সাহস পাইনি। যেসব শিক্ষার্থী ক্লাসে দুষ্ট প্রকৃতির ছিল, তাদেরও আমি কখনও সামনাসামনি সেভাবে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অসম্মান করতে দেখিনি। তারাও অনেক সময় শিক্ষক-শিক্ষিকাদের শাসনের ভয়ে ভীত থাকতো। আমাদের সময় শিক্ষক-শিক্ষিকারা অনেক সময় ক্লাসরুমে বেতের ব্যবহার করতেন। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোতে বেতের ব্যবহার করা হয় কি না সেটা আমার জানা নেই। তবে ভারত ও পাকিস্তানের অনেক শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষিকারা বেতের ব্যবহার করেন। শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি আমাদের দেশে সব সরকারের আমলে হয়েছে।
দীর্ঘ প্রায় পাঁচ বছর ধরে আমি স্লোভেনিয়াতে বসবাস করছি। স্লোভেনিয়ার ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা থেকে আমি ব্যাচেলর সম্পন্ন করছি ফিজিক্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের ওপর। স্লোভেনিয়ার পাশাপাশি হাঙ্গেরি, তুরস্ক, পর্তুগাল ও যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সাময়িক সময়ের জন্য আমার পড়াশোনার সুযোগ হয়েছে। আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে একটা কথা বলতে চাই। ভারতীয় উপমহাদেশের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মাঝে মানবিকতা বোধ বলে একটা বিষয় আছে যেটি ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকার মাঝে আমি খুঁজে পাই না। আমাদের দেশে অনেক সময় একজন শিক্ষার্থী কোনো বিষয়ে পাসমার্ক তুলতে না পারলে, শিক্ষক-শিক্ষিকারা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে ওই শিক্ষার্থীকে পাস করানোর চেষ্টা করে। আমরা আমাদের বিভিন্ন ব্যক্তিগত সমস্যার কথা অবলীলায় আমাদের শিক্ষক বা শিক্ষিকাদের সাথে শেয়ার করতে পারি।
তারা আমাদের বিভিন্নভাবে সহায়তার চেষ্টা করেন। ভারত ও পাকিস্তানের শিক্ষকদের মাঝেও আমি এ ধরনের সহযোগিতামূলক মনোভাব লক্ষ্য করেছি। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজ ব্যবস্থা রক্ষণশীল, এ কারণে আমরা বিভিন্ন সময় আফসোস প্রকাশ করি। তারপরেও এ উপমহাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় এখনও অনেক সুন্দর বিষয় আছে যা পশ্চিমে অনুপস্থিত।
স্লোভেনিয়া ও হাঙ্গেরি এ দুই দেশে আমি আমার কিছু শিক্ষক-শিক্ষিকার থেকে এমন আচরণ পেয়েছি যেটা অতীতে আমার কখনও কল্পনায় ছিল না। থার্ড ইয়ারে আমাদের ল্যাব ফাইভ নামক একটি মডিউল ছিল। এ মডিউলের এক্সামে আমি তিনবারের বেশি ফেল করেছি। আমার শিক্ষিকা একাধিকবার আমার ল্যাব রিপোর্ট রিজেক্ট করেছে। একটানা চার ঘণ্টা ল্যাব রিপোর্ট ডিফেন্স করার পরেও আমাকে পরীক্ষায় তিনি ফেল করিয়েছেন।
প্রফেসর জিওভান্নি ডি নিনো নামে আমাদের আরেক শিক্ষক রয়েছেন। তার জন্ম ইতালিতে যদিও তিনি ফ্রান্স থেকে পিএইচডি করেছেন। প্রফেসর জিওভান্নি অত্যন্ত একরোখা ও অ্যারোগান্ট স্বভাবের মানুষ। সামান্য বিষয় নিয়ে তিনি শিক্ষার্থীদের অপমান অপদস্ত করতে দ্বিধাবোধ করেন না। তার মতের সাথে মিল হয় না এমন বিষয় তিনি কখনও শুনতে পছন্দ করেন না।
এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিক্সকে তিনি সব সময় বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখান। তার দৃষ্টিতে ফিজিক্স মানে কেবলমাত্র থিওরি। তিনি আমাদের অ্যানালাইটিক্যাল ম্যাকানিক্স, কোয়ান্টাম মেকানিক্স ও নন-লিনিয়ার অপটিক্সের ক্লাস নেন। তার পরীক্ষা পদ্ধতি অন্যান্য শিক্ষকদের চেয়ে একেবারে ভিন্ন। তিনি মৌখিক পরীক্ষা নেন। পরীক্ষায় তিনি বিভিন্ন টপিক নিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে প্রশ্ন করেন এবং শিক্ষার্থীদের ব্ল্যাক বোর্ডে লিখে ওই টপিকের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় তার কাছে এক্সপ্লেইন করতে হয়।
যদি কোনো শিক্ষার্থী তার মন মতো এক্সপ্লেইন করতে না পারেন, তাকে তিনি তৎক্ষণাৎ ফেইল করিয়ে দেন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক শিক্ষার্থী আছেন যারা অন্যান্য মডিউলে পাস করেছেন, কিন্তু শুধুমাত্র প্রফেসর জিওভান্নির কোর্সে পাস মার্ক তুলতে না পারার কারণে তাদের গ্র্যাজুয়েশন শেষ হচ্ছে না। এ এক প্রফেসরের কারণে আমাদের ইউনিভার্সিটির অনেক স্টুডেন্ট তিন বছরের ব্যাচেলর প্রোগ্রাম ছয় বছরে শেষ করতে পারেননি। গত বছর অ্যানালাইটিক্যাল মেকানিক্স পরীক্ষায় প্রফেসর জিওভান্নি আমার থেকে ডি’অ্যালামবার্ট প্রিন্সিপাল সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম।
আমি ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে তাঁকে ডি’অ্যালামবার্টের প্রিন্সিপাল বুঝিয়ে দিয়েছি। এরপর আমাকে তিনি ডি’অ্যালামবার্টের প্রিন্সিপাল ব্যবহার করে লাগরাঞ্জের ইকুয়েশন প্রমাণ করতে বলেন। আমি ব্ল্যাকবোর্ডে সে প্রমাণ দেখাই। প্রমাণের পাশপাশি তিনি আমাকে সমগ্র ডেমনস্ট্রেশন ব্যাখ্যা করতে বলেন। আমি সাধ্য অনুযায়ী তার কাছে পুরো ডেমনস্ট্রেশন ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি। এরপর তিনি আমাকে হলোমনিক আর নন-হলোমনিক কন্সট্রেইন্ট সম্পর্কে প্রশ্ন করেন।
হলোমনিক আর নন-হলোমনিক কন্সট্রেইন্ট সম্পর্কে আমার যতটুকু জ্ঞান ছিল পুরোটা আমি তার কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করি। আমার উত্তর তার মনোপুত হয়নি। তাই আড়াই ঘণ্টা অরাল এক্সাম দেওয়ার পরেও তিনি আমাকে ফেইল করান। একবার এক ছাত্রকে তিনি কোয়ান্টাম ম্যাকানিক্স পরীক্ষায় সাত ঘণ্টা অরাল এক্সামের পরেও ফেইল করিয়েছিলেন। ১৮০ ইসিটিএসের মধ্যে তিনি প্রায় ১৬১ ইসিটিএস সম্পন্ন করেছিলেন এবং প্রায় সকল মডিউলে তার রেজাল্ট ছিল ভালো।
কোয়ান্টাম মেকানিক্সে পাস করার মধ্য দিয়ে শেষ নয় ইসিটিএস শেষ করতে তার পাঁচ বছর লেগে যায়। আমি অনেক শিক্ষার্থীকে প্রফেসর জিওভান্নির রুমে কাঁদতে দেখেছি। তাদের অনেককে প্রফেসর জিওভান্নির কাছে অনুনয় করতে দেখেছি এ বলে যেন তিনি দয়ার বশবর্তী হয়ে তাদের মিনিমাম মার্ক দিয়ে পাস করিয়ে দেন। কেননা এ এক শিক্ষকের কারণে তাদের গ্র্যাজুয়েশন সঠিক সময়ে শেষ হচ্ছিলো না। আমার এক সময়কার ক্লাসমেট পিটার।
পাঁচ বছর হয়ে গিয়েছে। শুধুমাত্র প্রফেসর জিওভান্নির কোর্সে পাস না করার কারণে পিটার সেকেন্ড ইয়ার থেকে থার্ড ইয়ারে প্রমোশন পাচ্ছে না। কিছু কিছু শিক্ষার্থীর প্রতি প্রফেসর জিওভান্নি অসম্ভব রকমের বায়াসড আচরণ করেন। আমার মাঝে-মধ্যে মনে হয়, ইয়াজিদের সেনাপতি শিমারের অন্তরে ছিটাফোঁটা হলেও দয়া-মায়া থাকতে পারে। প্রফেসর জিওভান্নির অন্তরে সেটিও নেই। বিভিন্ন নেতিবাচক অভিজ্ঞতার পরেও আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও শিক্ষার্থীকে প্রফেসর জিওভান্নির বিরুদ্ধে কোনও ধরনের অভিযোগ করতে শুনিনি।
ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালামের একটি উক্তি স্মরণ করতে চাই। একটি জাতিকে ধ্বংস করতে কোনো ধরনের সামরিক অস্ত্র বা পারমাণবিক বোমার প্রয়োজন নেই। দেশের শিক্ষা-ব্যবস্থায় বিপর্যয় একটি জাতিকে সমূলে ধ্বংস করার জন্য সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অস্ত্র। আজকের শিশু আগামী দিন ইঞ্জিনিয়ার হবে, ডাক্তার হবে, আমলা হবে। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের হাত দিয়ে ভবিষ্যতের নাগরিকেরা তৈরি হয়।
শিক্ষা যদি জাতির মেরুদণ্ড হয়, শিক্ষক-শিক্ষিকারা জাতি গঠনের কারিগর। রাষ্ট্রের যিনি রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে নির্বাচিত হন, তিনিও শিক্ষাজীবনে বিভিন্ন শিক্ষক-শিক্ষিকার সান্নিধ্যে হাতেখড়ি লাভ করেন। আধুনিক সিঙ্গাপুরের স্থপতি লি কুয়ান ইউ তার দেশের অগ্রগতির জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। এগুলোর মধ্যে একটি পদক্ষেপ ছিল প্রাইমারি স্কুল থেকে শুরু করে সকল স্তরে সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষক-শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া ও তাদের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে সর্বোচ্চ বেতন কাঠামো নিশ্চিত করা।
আজকের দিনে আমাদের দেশের বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অনেকে যেভাবে শিক্ষার্থীদের হাতে লাঞ্ছিত হচ্ছেন সেটা কোনোভাবে মেনে নেওয়ার মতো নয়। এক ভিডিওতে দেখলাম, মফস্বলের এক সেকেন্ডারি স্কুলের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা জোর করে প্রধান শিক্ষিকাকে হাত ধরে টেনে অসম্মানজনকভাবে পদত্যাগে বাধ্য করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অনেকে আমাদের দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যেভাবে কলা অনুষদের ডিনকে অপমান করেছে ও তাকে পদত্যাগে বাধ্য করেছে সেটা রীতিমতো হতাশাজনক। এখন কেউ যদি শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠে অধ্যয়ন করা এ সকল শিক্ষার্থীর শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন সেটি অমূলক কিছু হবে না। যেসব শিক্ষার্থী এভাবে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের লাঞ্ছিত করেছেন, তারা আগামী দিন তাদের বাবা-মা ও পরিবার থেকে শুরু করে এ সমাজের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? আমাদের অভিভাবকদের উচিত আমাদের এ বিষয়ে জোরালোভাবে শিক্ষা প্রদান করা।
শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নিয়ে আমাদের বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ থাকতে পারে এবং এ বিষয়টি অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমাদের সকলের উচিত এ সকল অভিযোগের বিষয়ে প্রশাসনকে অবহিত করা। প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চালাতে পারে এবং যদি উপযুক্ত প্রমাণের ভিত্তিতে তারা দোষী সাব্যস্ত হন, তখন তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী প্রশাসন পদক্ষেপ নেবে। অভিযোগ প্রমাণের আগ পর্যন্ত জোর করে কাউকে পদত্যাগ করানোর পক্ষপাতী আমি নই।
৩৬ শে জুলাই তথা পাঁচ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান আমাদের নতুন এক বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে হাতছানি দিচ্ছে। সাধারণ মানুষের আশা, আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন সেদিনকে পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হবে যেদিন আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি ঘটবে এবং দেশের সকল মানুষ এক শিক্ষার ছায়াতলে আবদ্ধ হতে পারবে। একটি দেশ অবকাঠামোগত দিক থেকে যতই উন্নতি লাভ করুক না কেনো, শিক্ষাক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত প্রগতি না আসলে এ উন্নয়নের সুফল ওই দেশের সাধারণ মানুষ সেভাবে ভোগ করতে পারে না।
শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পাস কাটিয়ে আমরা কখনও আলোকিত মানুষ গড়তে পারবো না। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে আমাদের জীবনে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ভূমিকা কোনো অংশে পিতামাতার চেয়ে কম নয়। তাই তাদের তাদের প্রাপ্য সম্মান নিশ্চিত করতে হবে। তারা জাতি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে সে বিষয়ে আমাদের সহায়ক শক্তির ভূমিকা পালন করতে হবে। যদি তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকে, সেটি নিষ্পত্তির জন্য আইন, আদালত ও প্রশাসন রয়েছে। নতুন বাংলাদেশে কোনো শিক্ষক-শিক্ষিকাকে যেন লাঞ্ছনার শিকার হতে না হয় অথবা তাকে যেন জোর করে পদত্যাগে বাধ্য না করা হয় সে বিষয়ে আমাদের সবাইকে সচেষ্ট হওয়া একান্ত জরুরি।
রাকিব হাসান রাফি,
শিক্ষার্থী,
ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ফিজিক্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স,
ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা,
স্লোভেনিয়া।
এমআরএম/জেআইএম
সর্বশেষ - প্রবাস
- ১ প্রশাসনিক সংকট ও ভবিষ্যতের করণীয়: একটি সুষম বিশ্লেষণ
- ২ অস্ট্রেলিয়ার সৈকতে ২ মেয়েকে বাঁচাতে গিয়ে বাংলাদেশি দম্পতির মৃত্যু
- ৩ সংকট থেকে উত্তরণ: নৈতিকতা, সুশাসন ও সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন
- ৪ অস্ট্রেলিয়ায় মানবপাচার চেষ্টা, ইন্দোনেশিয়ায় ১২ বাংলাদেশি উদ্ধার
- ৫ আবারও বিশ্বসেরা বিজ্ঞানীর তালিকায় প্রবাসী অধ্যাপক সাইদুর রহমান