ভিডিও EN
  1. Home/
  2. প্রবাস

বসন্ত এসে গেছে

আধুনিক সভ্যতা দিয়েছে বেগ কেড়ে নিয়েছে আবেগ

মো. ইয়াকুব আলী | প্রকাশিত: ০৩:৫৬ পিএম, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪

অস্ট্রেলিয়ার পঞ্জিকা অনুযায়ী বসন্তকাল শুরু হয়েছে পহেলা সেপ্টেম্বর থেকে তাই বাতাসে বসন্তের বার্তা পাওয়া যাচ্ছে। এখনকার আবহাওয়াকে বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনা করলে বলা চলে মাঘ পেরিয়ে ফাল্গুন শুরু হয়েছে। ভোরে আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উষ্ণতা বাড়তে থাকে। বেলা দশটার পর তাপমাত্রার পারদ অনেক ওপরে উঠে যায়।

আবার সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে ঝপ করে তাপমাত্রা পড়ে যায়। তখন আবার ঠান্ডা লাগতে শুরু করে। এভাবেই বোঝা যায় ঋতু পরিবর্তনের বার্তা। সকালের বাতাসটা থাকে নাতিশীতোষ্ণ এবং কোমল। বাতাসটা খুব গায়ে মাখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু বাস্তবতার কারণে দ্রুতই অফিসে ঢুকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের রুক্ষ ঠান্ডা বাতাসে ডুবে যেতে হয়। আর মাঝে মাঝে উদাস দৃষ্টিতে বাইরে গাছের পাতার নড়াচড়া দেখে হিংসা হয়। গাছ হয়ে জন্মালে কত ভালোই না হতো। তখন মনের মধ্যে বেজে চলে কবি গুরুর গানের কলি –

‘ওরে গৃহবাসী
খোল, দ্বার খোল, লাগল-যে দোল
স্থলে জলে বনতলে লাগল-যে দোল
দ্বার খোল, দ্বার খোল’

শীতের সময় খুব ভোরে থেকে উঠার একমাত্র ঘণ্টা ছিল মোবাইলের অ্যালার্ম। কিন্তু গত কদিন ধরে পাখিদের কিচিরমিচির শুনে নির্দিষ্ট সময়ের কিছু আগেই ঘুম ভাঙছে। তখন বুঝতে পারলাম পাখিরাও জেনে গেছে বসন্তের আগমনী বার্তা। ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ ধুয়ে তৈরি হয়ে বাইরে আসলেই ভোরের আলোর দেখা পাওয়া যায়। কারণ দিনের দৈর্ঘ্য বাড়ছে। ভোরের কোমল আলোয় চারিদিকে একটা মায়াবী পরিবেশ তৈরি হয়।

আধুনিক সভ্যতা দিয়েছে বেগ কেড়ে নিয়েছে আবেগবসন্তের আগমনে ফুটেছে মান্দার

তাপমাত্রাটা তখনও সহনীয় না হওয়াতে জামার ওপর জ্যাকেটটা পরতে হয়। ট্রেন স্টেশনে পৌঁছালে পূব সূর্যি মামার লাল আভা চোখে পড়ে। এরপর গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ট্রেনে চড়ে বসতে হয়। ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকি। যদিও সেখানে প্রতিদিন একই দৃশ্যের দেখা মেলে। তাই মাঝে মধ্যে ব্যাগ থেকে বই বের করে তার পাতায় ডুব দিই। কিন্তু কবি গুরুর মতো ‘আমার আপনহারা প্রাণ আমার বাঁধন-ছেড়া প্রাণ’ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে।

বসন্তের আগমনে কামিনী ফুটেছে রাশিরাশিবসন্তের আগমনে ফুটেছে চাইনিজ জেসমিন

ট্রেন থেকে নামার পর টানেল থেকে বের হবার সময় চলন্ত সিঁড়িতেই বসন্তের বাতাসের ঝাপ্টা গায়ে লাগে। তখন ইচ্ছে করেই জ্যাকেটটা খুলে সেই বাতাস গায়ে মাখি। ট্রেন থেকে নামার পর বেশ কিছুক্ষণ বাসের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। সেই ফাঁকে মোড়ের দোকান থেকে কফি নিয়ে নিই। কফি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার সময় আশপাশের দৃশ্য দেখি। এই সময় পাশের পার্কে কোকিলের গলা শোনা যায়। ছোটবেলায় কোকিল ডাকলেই আমরা তার সাথে গলা মেলাতাম। তখন কোকিল মনে করতো আশেপাশেই নিশ্চয়ই আরো কোকিল আছে। তখন সে আরো জোরে এবং দ্রুত ডাকতে শুরু করতো। এখানে সেটা আর করতে পারি না তাই তার মধুর স্বর শুনেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। কোকিলের এই গান মনে করিয়ে দেয়-

আধুনিক সভ্যতা দিয়েছে বেগ কেড়ে নিয়েছে আবেগবসন্তের সকালে সূর্যের আগমনী

‘কুহু কুহু শোনা যায়
কোকিলের কুহু তান
বসন্ত এসে গেছে, বসন্ত এসে গেছে’

দুপুরের খাবারের বিরতিতে অফিসের আশপাশের এলাকায় হাঁটাহাঁটি করার অভ্যাস। বছরের এই সময়টায় সেটা হয়ে উঠে দারুণ উপভোগ্য। বসন্তের ‘লিলুয়া বাতাস’এ ভেসে আসে বিভিন্ন ফুলের মৌমৌ সুবাস। হেঁটে যেতে যেতেই থমকে দাঁড়াতে হয় ফুলের সুবাসে। মজার ব্যাপার হচ্ছে নির্দিষ্ট গাছটা পেরিয়ে গেলেই কেনজানি ফুলের ঘ্রাণটা এসে আমাদের নাকে লাগে। তখন বুক ভরে মধু গন্ধের বাতাস দিয়ে ফুসফুসটা ভরিয়ে ফেলি। এ সময় ফুটে অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় ফুল-গোল্ডেন ওয়াতল। দেখতে অনেকটা বাংলাদেশের বাবলা ফুলের মতো। বাংলাদেশের বসন্তের মতো অস্ট্রেলিয়াতেও দেশীয় অনেক ফুলের দেখা মেলে, যেমন - কামিনী, মান্দার ইত্যাদি। তখন মনের মধ্যে বেজে চলে-

‘জীবনে বসন্ত এসেছে
ফুলে ফুলে ভরে গেছে মন
ও বান্ধবী অনামিকা
আজ তোমাকেই প্রয়োজন’

গত সপ্তাহে বসন্তের আগমনী বাতাসের সঙ্গে যুগলবন্দি হলো পূর্ণিমার চাঁদের। পূর্ণিমা সবসময় আমাদের জীবনে বাড়তি আনন্দের ক্ষণ বয়ে নিয়ে আসে কিন্তু নাগরিক জীবনে বিদ্যুৎের আলোর ঝলকানির কাছে যেন চাঁদের আলো আজ ফিকে হয়ে এসেছে। তাই পূর্ণিমা রাত্রে আমরা বাসার সব আলো বন্ধ করে বাসার পেছনে চলে যায়। সেখানে চাঁদের আলোয় চলে আমাদের লুকোচুরি খেলা। চাঁদের আবছা আলোছায়াতে আমাদের খেলা যেন আর ফুরোতেই চায় না। আমাদের ছোটবেলায় গ্রামে তখনও বিদ্যুৎ এসে পৌঁছেনি। পাড়ার সকল ছেলেমেয়ে মিলে আমরা তখন পূর্ণিমা রাত আসলেই লুকোচুরি খেলতাম যেটাকে আমাদের স্থানীয় ভাষায় বলে - পলানটুক। জানিনা এখনকার গ্রামের বাচ্চারা আর এগুলো খেলে কি না। আর মোবাইলের ইউটিউবে বেজে চলে সব আনন্দময় গান-

আধুনিক সভ্যতা দিয়েছে বেগ কেড়ে নিয়েছে আবেগবসন্তের আগমনে কামিনী ফুটেছে রাশিরাশি

‘পূর্ণিমাসন্ধ্যায় তোমার রজনীগন্ধায়
রূপসাগরের পারের পানে উদাসী মন ধায়।’

আধুনিক সভ্যতা আমাদের দিয়েছে বেগ আর কেড়ে নিয়েছে আবেগ। আমরা প্রাকৃতিক আনন্দের উপকরণ বাদ দিয়ে এমনসব উদ্ভট বিষয় নিয়ে মেতে থাকি যার মধ্যে কোন বিনোদন নেই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় এগুলো শুধুমাত্র ছবি তোলার উপকরণ এবং অন্যের চেয়ে নিজেকে এগিয়ে রাখার প্রতিযোগিতা। আমাদের সময় নেই দুদন্ড কোথাও দাঁড়িয়ে বা বসে বসন্তের বাতাস গায়ে মাখার, বাতাসের মধুর সুবাস নেওয়ার। সময় নেই পূর্ণিমা রাত্রে চাঁদের বুড়িকে সঙ্গ দেওয়ার। আমরা একটা মুহূর্তও নিজের জন্য বাঁচি না। আমরা ভাবি না পরের পূর্ণিমা চাঁদ আমি দেখতে পাবো কি না। পরের বসন্তের বাতাস গায়ে মাখার সৌভাগ্য আমার হবে কি না। আমরা শুধু ছুটে চলি–

‘রোজ রাতে আর চাঁদের বুড়ি কাটেনা চরকা রোজ
ও বুড়ি তুই আছিস কেমন?
হয়না নেয়া খোঁজ’

এমআরএম/এমএস