বাল্টিক সাগরের কোল ঘেঁষে: এক স্মরণীয় ভ্রমণকথা
বাল্টিক সাগর, ইউরোপের উত্তরের রহস্যময় জলরাশি, যার তীরে মিশে আছে ইতিহাস, সংস্কৃতি, আর প্রকৃতি। সুইডেনের কোল ঘেঁষে বয়ে যাওয়া এই সাগর শুধুই একটি ভৌগোলিক স্থান নয়; এটি একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষের জীবনযাত্রায় গভীর প্রভাব ফেলেছে। বাল্টিক সাগরের বুকে ছড়িয়ে থাকা অগণিত দ্বীপপুঞ্জের ইতিহাস, প্রকৃতি আর সৌন্দর্য নিয়ে গড়ে উঠেছে এক মনোমুগ্ধকর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা।
সম্প্রতি, আমি এই সাগরকে ঘিরে অবস্থিত কয়েকটি দ্বীপপুঞ্জ ভ্রমণের সুযোগ পেয়েছিলাম। আমার ভ্রমণ শুরু হয়েছিল সুইডেনের নিনেসহামন থেকে। বাল্টিক সাগরের তীরে অবস্থিত এই শহরটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য সুপরিচিত। তবে Nynäshamn-এর আসল আকর্ষণ হলো Strandvägen, একটি দীর্ঘ হাঁটার পথ যা মূলত ১৯১২ সালের অলিম্পিক পালতোলা নৌকা প্রতিযোগিতা উপভোগের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। পথে হাঁটতে হাঁটতে সাগরের দৃশ্য আর পালতোলা নৌকার দৃশ্য দেখতে দেখতে কখন যে ৮-১০ কিলোমিটার পার করে ফেলেছি, তা নিজেও বুঝতে পারিনি।
দ্বীপপুঞ্জগুলোর মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় Utö দ্বীপের কথা। এটি প্রথমবার দ্বীপপুঞ্জ ভ্রমণের জন্য আদর্শ। এখানে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন হাঁটার পথ, সমুদ্রসৈকত, আর পর্যাপ্ত পরিষেবা। দ্বীপটির বিশেষত্ব হলো এর প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং শান্ত পরিবেশ, যা আপনাকে নিভৃতির এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা দেবে।
এরপর গেলাম Nåttarö দ্বীপে, যেখানে বালুকাময় সৈকত আর মনোরম হাঁটার পথগুলো আপনার ভ্রমণকে আরও আনন্দদায়ক করে তুলবে। এছাড়াও Ostholmen দ্বীপে বুকিং করা সাউনার সুবিধা রয়েছে, যা প্রকৃতির সঙ্গে এক গভীর সংযোগ গড়ে তোলে। সাউনার অভিজ্ঞতা আপনার ভ্রমণকে আরও স্বার্থক করে তুলতে পারে।
Huvudskär দ্বীপটি ছিল আমার পরবর্তী গন্তব্য, যা দ্বীপপুঞ্জের সবচেয়ে সুন্দর স্থানগুলোর একটি। এখানকার জাদুকরী পাথুরে ভূমি আর স্ফটিকস্বচ্ছ জলরাশি যেন প্রকৃতির এক অপরূপ ক্যানভাস। যারা অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজে থাকেন, তাদের জন্য এখানে স্নরকেলিং-এর সুযোগ অনন্য। Dalarö Sjötransporter নামক একটি পরিবহন সংস্থা মৌসুমী সময়ে এই দ্বীপে ভ্রমণের ব্যবস্থা করে, যা ভ্রমণকারীদের জন্য দারুণ এক অভিজ্ঞতা।
Fjärdlång দ্বীপটি দ্বীপপুঞ্জের আরেকটি রত্ন, যেখানে প্রকৃতির কোলে নির্জনে সময় কাটানোর সুযোগ মেলে। দ্বীপটির হাঁটার পথগুলো মেষের ঘেরা মাঠের মধ্য দিয়ে চলে গেছে, আর এখানকার পাথুরে স্থানগুলোতে আপনি প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার সুযোগ পাবেন। এই দ্বীপের কিছু পরিষেবা যেমন টয়লেট ও কিয়স্ক (দোকান) ভ্রমণকে আরও সুবিধাজনক করে তোলে।
বাল্টিক সাগর শুধু সুইডেনের তীর ধরে বয়ে যাওয়া একটি জলরাশি নয়; এটি সুইডেনের ইতিহাস, সংস্কৃতি, আর জীবনযাত্রার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে রয়েছে। শীতকালে যখন সাগর তুষারের চাদরে ঢেকে যায়, তখন এই স্থানটি আরও মায়াবী হয়ে ওঠে। সাগরের শান্ত অথচ রহস্যময় স্বভাব সুইডেনের মানুষের জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলেছে। বিশেষ করে, তাদের স্থিতিশীলতা এবং প্রকৃতির সঙ্গে গভীর সংযোগ বজায় রাখার মানসিকতায় সাগরের প্রভাব অনস্বীকার্য।
বাল্টিক সাগরের তীরবর্তী দ্বীপপুঞ্জগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে একটি অনন্য সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে, যা সুইডেনের ঐতিহ্য এবং পরিচয়ের অংশ হয়ে রয়েছে। Nynäshamn-এর Strandvägen পথে হাঁটার সময় সেই পুরনো দিনের পালতোলা নৌকা প্রতিযোগিতার স্মৃতিচারণা যেন ইতিহাসের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ গড়ে তোলে।
অনেকবার বাল্টিক সাগর পাড়ি দিয়ে আমি ফিনল্যান্ড, এস্টোনিয়া, রিগা ভ্রমণ করেছি। প্রায়ই মনের জানালায় উঁকি দিয়েছে এই দ্বীপগুলো, যা অবশেষে আমার পদচারণায় স্পর্শিত হলো। এই ভ্রমণ অভিজ্ঞতা শুধু আনন্দের সঞ্চার করেনি; এটি আমাকে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার সুযোগ দিয়েছে। বাল্টিক সাগরের প্রশান্ত অথচ রহস্যময় জলরাশি আর দ্বীপের মুগ্ধকর সৌন্দর্য ভ্রমণের আনন্দকে আরও গভীর এবং স্মরণীয় করে তুলেছে। সারাদিন সাগরের দ্বীপপুঞ্জ ভ্রমণের শেষ পর্বে যখন সূর্য ডুবতে শুরু করল, তখন যে মনোমুগ্ধকর দৃশ্য উপভোগ করতে পেরেছিলাম সহধর্মিণীর সঙ্গে, সেটা না হয় নিজের জন্যই রাখি।
তবে, সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে পথহারা এবং ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। ভাবতে ভাবতে একটি গাড়ি পাশ দিয়ে যেতে হাত তুলে ইশারা দিতেই গাড়িটি থেমে গেল। ভদ্রমহিলা জানতে চাইলেন, ‘কোনো সমস্যা?’
বললাম, ‘পথ হারিয়ে ফেলেছি, বুঝতে পারছি না কোন দিকে যাব। টেলিফোনের চার্জও শেষ হয়ে গেছে। কী করবো বুঝতে পারছি না!’
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘আমার গাড়িতে উঠে পড়, আমি তোমাদের নিকটতম স্টেশনে পৌঁছে দেব।’ তিনি আমাদের তার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে চা-কফির ব্যবস্থা করলেন এবং কিছুক্ষণ সঙ্গ দিলেন। পথের ক্লান্তি ভুলে, আনিকার স্নেহভরা আতিথ্য আমাদের এতটাই মুগ্ধ করলো যে বিদায় বেলায় কীভাবে তার ঋণ শোধ করবো ভাবতে থাকলাম।
মারিয়া, আমার সহধর্মিণী, মনে করিয়ে দিলেন, ‘তুমি যে দুটো আম কিনেছিলে সমুদ্রসৈকতে বসে খাবো বলে, তা তো খাওয়া হয়নি। আনিকাকে দিয়ে দাও।’ বিদায় বেলায় বললাম, ‘কীভাবে তোমার ঋণ শোধ করি বলো তো?’
আনিকা বললেন, ‘ঋণ কি শোধ করা খুবই জরুরি?’
আমি বললাম, ‘ঠিক তা না, তবে আমার কাছে দুটি বাংলাদেশের আম আছে। আমরা সাগর পাড়ে বসে খাবো বলে কিনেছিলাম, কিন্তু ভুলে গেছি। তুমি আম দুটো রেখে দাও, কাল এক সময় খেয়ো।’
আম দুটো পেয়ে আনিকা এতটাই আপ্লুত হলেন যে ভাবতে পারিনি। কারণ, তিনি কোনো এক সময় বাংলাদেশের সুইডিশ দূতাবাসে কাজ করেছেন। বাংলাদেশের কথা শুনতেই আড্ডা জমে গেলো। রাত অনেক হয়েছে, তবে ট্রেনে স্টকহোমে ফেরার আগে টেলিফোন নম্বর বিনিময় করে নিলাম। ট্রেন থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে মারিয়া হাত খানি ধরে বললেন, ‘দিনটা ভালো কেটেছে আজ।’
রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।
[email protected]
এমআরএম/জেআইএম