ভিডিও EN
  1. Home/
  2. প্রবাস

প্রবাসের দিনলিপি

মো. ইয়াকুব আলী | প্রকাশিত: ০১:৪৬ পিএম, ১০ জুলাই ২০২৪

মুঠোফোনের রিংটোনে খুব ভোরে ঘুম ভেঙে যায়। এখন শীতকাল চলছে। তাই কম্বলের নিচ থেকে আর বের হতে ইচ্ছা করে না। বাড়ির কাঠের মেঝেতে ঠান্ডায় পা দেওয়া দায়। গরম জুতা পরে ঘরের মধ্যে চলাফেরা করতে হয়। প্রসাধন কক্ষ থেকে বেরিয়ে গোসলখানায় গিয়ে দাঁত ব্রাশ করে মুখ ধুয়ে তৈরি হতে হয়।

এরপর পানির কল থেকে পানি নিয়ে দুই এক ঢোক খেয়েই দৌড়। বাইরে বেরিয়ে জুতা মোজা পরে গাড়িতে উঠতে হয়। বাসা থেকে স্টেশন গাড়িতে মাত্র মিনিট পাঁচেকের পথ। বেশিরভাগ দিনই গাড়ির কাঁচ এবং আয়নাগুলো পরিষ্কার টিস্যু দিয়ে করতে হয়। অনেক সময় পানি ঢেলে ধুতে হয় কারণ সাতসকালে বরফ জমে থাকে। পানি দিলে সেটা আবার বরফ হয়ে যায়। এভাবে বেশকবার ধোয়ার পর কাঁচগুলো পরিষ্কার হয়। এরপর গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে হাত রাখলে মনে হয় আঙুলের মধ্যে ঠান্ডা সুচ ঢুকে যাচ্ছে।

এই পাঁচ মিনিটের পথ হেঁটে গেলে লাগে মিনিট বিশেক। এখনও মনে পড়ে যখন এদেশে প্রথম এসেছিলাম তখন এই রাস্তাটুকু হেঁটে যেতাম। তখনও জুতা পরার অভ্যাস গড়ে উঠেনি। দেশ থেকে আনা বাটার ছইওয়ালা স্যান্ডেলই ভরসা। তখনও জিন্সে অভ্যস্ত হয়নি। দেশ থেকে আনা পাতলা কাপড়ের প্যান্ট ভেদ করে ঠান্ডা বাতাস ঢুকে পড়ে। অবশ্য হাটার কারণে শরীর গরম থাকায় সেটা অতটা টের পাওয়া যায় না। দেশে থাকতে জীবনে কখনওই মাফলার বা টুপি পারিনি কিন্তু এখানকার ঠান্ডা অনেক কিছুই পরতে বাধ্য করেছিল।

দেশ থেকে আনা বানরমুখ টুপিটা খুবই কাজে লেগেছিল। ঝড় হোক বৃষ্টি হোক আমাকে কাজে যেতেই হতো। কারণ আমার সাথে এসেছে স্ত্রী এবং কন্যা। তাদের মুখে দুবেলা দুমুঠো অন্ন তুলে দিতে হত। তখনও গাড়ি চালনার ছাড়পত্র পাইনি। অবশ্য গাড়ির কেনারও সামর্থ্য ছিল না। দুই কিলোমিটার দূরের শপিংমল থেকে বাজার করে ট্রলি ঠেলে ঠেলে বাসায় ফিরি। মেয়ের হাঁটতে কষ্ট হতো বলে তাকে ট্রলিতে তুলে নিতাম। স্টেশনে যেতে যেতে এসব স্মৃতিই মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়।

প্রবাসের দিনলিপিপ্রবাস জীবনের চাকচিক্য সবসময়ই আমাদের হাতছানি দেয়

স্টেশনে পৌঁছে মিনিট পাঁচেকের অপেক্ষা। ট্রেন একেবারে ঘড়ির কাঁটার সাথে তাল মিলিয়ে চলে আসে। প্রতিদিন একই জায়গায় দরজাটা খুলে যায়। এমনকি যারা অপেক্ষায় থাকে সেই মুখগুলোও পরিচিত। এরপর সবাই মিলে ট্রেনে চড়ে বসা। জনপরিবহনে নীরবতা পালন করাই না কি ভদ্রতা। তাই ট্রেনভর্তি মানুষ থাকলেও বোঝার উপায় নেই। মানুষে মানুষে কথা না বলার এই ব্যাপারটা আমার কাছে একটা বিশাল অসুস্থতা মনে হয়।

ট্রেনে পাশের সিটে যিনি বসেন সেই মুখটাও চেনা। এরপর ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে প্রতিদিন একই দৃশ্য দেখা যায়। তাই একটা সময় সেগুলোতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। আর হাতের মুঠোয় তো জাদুর বাক্স আছেই। ট্রেন থেকে নেমে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠার সময় বাংলদেশের গার্মেন্টসে কাজ করা মেয়েগুলোর কথা খুব মনে পড়ে। ওরাও ঠিক এমনভাবেই সারিধরে হেঁটে কাজে যায় আবার কাজ থেকে ফেরে। কিন্তু ওরা আমাদের মতো নির্দিষ্ট মজুরি পায় না। ওদের কে কতটা ঠকাতে পারলো সেটা দিয়েই সমাজে অবস্থান তৈরি হয়।

ট্রেন থেকে নেমে বাস স্টেশনে পৌঁছে বাসের জন্য মিনিট পনেরোর অপেক্ষা। এই সময়টা কাটানোর এবং ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচার জন্য পাশের দোকান থেকে কফি নিয়ে নিই। নিয়মিত কফি কেনার ফলে ওদের সাথে একটা যান্ত্রিক আন্তরিকতা তৈরি হয়ে গিয়েছে। যান্ত্রিক বলছি কারণ প্রতিদিন একই বার্তালাপ হয়। কপির দোকানের মেয়েটা অবশ্য গলায় মধু ঢেলে শুভেচ্ছা জানায়। আবার এক দুই দিন না গেলে বলে তোমাকে আমরা মিস করেছি। যদিও জানি এগুলো সবই কথার কথা তবুও ভালো লাগে।

প্রবাসের দিনলিপিপ্রবাস জীবন যান্ত্রিকতায় ঠাসা

এই দোকানটা থেকে কফি কেনার অন্যতম কারণ হলো ওদের কফি কাপটার ডিজাইন দারুণ। এরপর বাস আসলে আবার ঠাসাঠাসি করে বাসে চড়ে বসি। সেখানেও কবরের নীরবতা। অবশ্য আমাদের সাথে মাঝে মধ্যে কিছু স্কুল পড়ুয়া কিশোর উঠে। তখন ওরা চিৎকার চেঁচামেচি ঠেলাঠেলি করে বাসটা মাথায় করে রাখে। অনেকেই বিরক্ত হয় কিন্তু আমার ভালোই লাগে। অন্ততপক্ষে ওদের মধ্যে তো জীবনের একটা স্পন্দন আছে। ওদের দেখলে আমার নিজের কিশোর বয়সের কথা মনে পড়ে যায়। আহা রুটিন বিহীন কি দারুণ সময় ছিল সেটা।

বাস থেকে নেমে মাত্র কয়েক মিনিটের হাঁটা পথ। এর মধ্যেই পাশের দোকানগুলো খুলে যায়। ওদের সাথে দেখা হলে শুভ সকাল বলে শুভেচ্ছা বিনিময় করি। অফিসে আমিই সাধারণত সবার আগে আসি। এরপর একে একে সবাই আসে এবং শুভেচ্ছা জানাই। এরপর কর্মব্যস্ত দিন শুরু হয়। কম্পিটারের বিশাল তিনটা মনিটরে চলে হিসাব কষা। একটাতে আমি ইমেইলের পাশাপাশি মেসেঞ্জার আর হোয়াটস্যাপ অন করে রাখি। যেন সহজেই বন্ধুদের খোঁজ খবর নিতে পারি। অন্য একটাতে চলে সফটওয়্যার। আর তৃতীয়টাতে খোলা থাকে ইমারতের নকশা। সংখ্যা নিয়ে কাজ করতে করতে সময় কেটে যায়। এর ফাঁকে ফাঁকে সময়টাকে আনন্দময় করতে আমি অবশ্য সহকর্মীদের সাথে অনেক ধরনের অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলি।

একটা সময় দুপুরের খাবার সময় হয়ে যায়। আমার বন্ধু মাইকেল মিকেলপ থাকা অবস্থায় দুজন মিলে বের হতাম। এখন বেশিরভাগ সময় একাই বের হয়। মূল রাস্তার দুই পাশে অনেক রকমের খাবারের দোকান। চাইনিজ, ক্যান্টনিজ, লেবানিজ, সামুদ্রিক মাছ, মুরগির মাংসের কাবাব এমন আরো অনেক ধরনের খাবার পাওয়া যায় সেখানে। অতি সম্প্রতি অবশ্য একটা ভারতীয় খাবার দোকান চালু হয়েছে। কিন্তু খরিদ্দার না পাওয়ার কারণে সেটা বেশিরভাগ সময়ই বন্ধ থাকে। আর সস্তায় স্বাস্থ্যকর খাবার পাওয়া যায় বেকারিগুলোতে। সেখানে বিভিন্ন রকমের সালাদ রোল পাওয়া যায়। আমি একই দোকানে সবসময় না খেয়ে স্বাদ সময়ে সময়ে বদল করি। প্রায় সব দোকানের মানুষগুলোই পরিচিত। তাদের সাথেও শুভেচ্ছা বিনিময় হয় খাবার কেনার সময়।

প্রবাসের দিনলিপি
প্রবাস জীবনের আলোকজ্জ্বল মরীচিকা

দুপুরের খাবারের বিরতি ত্রিশ মিনিটের। আমি সেটাকে টেনে লম্বা করে প্রায়ই এক ঘণ্টা করে ফেলি। খাবারটা নিয়ে এক একদিন এক এক দিকে বেরিয়ে পড়ি। অফিসের আশপাশের প্রায় সব রাস্তায় এভাবে ঘোরা হয়ে গেছে। জানা হয়ে গেছে কোন দিকে কি আছে। উত্তর দিকে গেলে একটা পুকুর আছে নাম- মিলস পন্ড। সেখানে শীতকাল ছাড়া সারা বছরজুড়েই হলুদ রঙের শাপলা ফুল ফুটে থাকে।

আর পানিতে খেলা করে পানকৌড়ি আর হাঁসের বাচ্চা। ঠিক তার ওপর দিয়েই চলে গেছে মোটরওয়ে এম-১। আর আকাশে তাকালে দেখা যায় সিডনি এয়ারপোর্ট থেকে উড়াল দেওয়া উড়োজাহাজ। দক্ষিণে গেলে আছে একটা বিশাল পার্ক নাম- স্যার জোসেফ ব্যাংকস পার্ক। সেটা ধরে একটু এগুলেই বোটানি নৌবন্দর। পশ্চিম দিকে বেশিদূর যাওয়া যায় না। আর পূর্ব দিকে গেলে আছে একটা পার্ক না- বুড়ালি পার্ক। বেশিরভাগ সময় সেখানেই যাওয়া হয়।

আশপাশের অফিস থেকে অনেক মানুষ সেখানে আসে দুপুরের খাবারের বিরতিতে। আবার অনেকেই আসে তাদের কুকুরকে নিয়ে হাঁটতে। এসব মানুষের সাথেও শুভেচ্ছা বিনিময় হয়। রৌদ্রজ্জ্বল মাঠের মাঝখানের ক্রিকেট পিচে মাঝে মধ্যে শুয়ে পড়ে আকাশ দেখি। কিন্তু বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। চোখ জ্বালা করে। এরপর মন না চাইলেও অফিসেই ফিরে আসতে হয়। বিকেলে অফিস থেকে বেরিয়ে আবার একই পথে ফেরা। এভাবেই চলে সপ্তাহের পাঁচ কর্মদিবস।

এখন দিন ছোট তাই বাসা থেকে যখন ভোর সাড়ে ছয়টার সময় বের হই তখনও অন্ধকার থাকে আবার যখন কাজ শেষ করে সাড়ে ছয়টার দিকে ফিরে যাই তখনও অন্ধকার থাকে। অবশ্য শুক্রবারে একটু আগেই বের হতে পারি। তখন বাসায় গিয়ে বাচ্চাগুলোকে নিয়ে একটু বের হবার সুযোগ পাই।

সপ্তাহান্তের দুইটা দিন কাটে আরও বেশি ব্যস্ততায়। বাচ্চাদের একটার পর একটা কাজ লেগেই থাকে। তাদের রুটিনের সাথে তাল মিলিয়ে দৌড়াতে হয়। এভাবে দুটো দিন যে কোনদিক দিকে চলে যায় টেরই পাওয়া যায় না। এই রুটিন জীবনকে আমি একটা নাম দিয়েছি। পাঁচদিন গাঁধার জীবন আর দুই দিন বানরের জীবন। দিনশেষে অবধারিতভাবেই আসে রাত্রি। বাসায় ফিরে নিজে খাওয়ার পাশাপাশি বাচ্চা দুটোর খাওয়াও নিশ্চিৎ করতে হয়।

প্রবাসের দিনলিপিসহকর্মীদের সাথে খুনসুটি প্রবাস জীবনে বাড়তি আনন্দ যোগ করে

যদিও ওরা খাওয়া নিয়ে তেমন কোনো ঝামেলা করে না। মাখিয়ে দিলে নিজেরাই খেয়ে নেয়। তরকারি নিয়ে কোনো আবদার করে না। ফ্রিজে দুধ থাকে, ডিম থাকে কিন্তু সেগুলো তৈরি করে খেতে দেওয়ার সময় পাওয়া যায় না। ফলের ঝুড়িতে ফল ভর্তি থাকে কিন্তু সেগুলো খাওয়ার অবসর পাওয়ায় মুশকিল। পঁচে গেলে ফেলে দিতে হয়। যখন কোো খাবার ফেলে দিতে হয় তখন শুধু ভাবি দেশের কত মানুষ না খেয়ে আছে। এরপর ঘুমের সময় হয়ে যায়। তাড়াতাড়ি না ঘুমালে ভোরে উঠা কষ্টদায়ক তাই বাধ্য শিশুর মতো ঘুমিয়ে যেতে হয়। ঘুম থেকে উঠলেই আবার সেই একই রুটিন। মনে বেঁজে চলে নচিকেতার সেই গান-

‘নগর জীবন একই রকম একই ধারায় বয়ে যায়।
শুধু বয়ে যায়... শুধু বয়ে যায়’

এই জীবনযাপনে এখানকার মানুষ হাঁপিয়ে উঠে না কারণ তারা ছোটবেলা থেকে এভাবেই তৈরি হয়। কিন্তু আমি হাঁপিয়ে উঠি কলেজ পাশ করে বুয়েটের রুটিন জীবনে যেমন হাঁপিয়ে উঠতাম। আমার কাছে সবকিছুই কেমন জানি একঘেঁয়ে লাগে। এখানে আসার পর একটা বিষয় বুঝেছি সেটা হলো জীবনের না পাওয়া অপুর্ণতাগুলোও অনেক বড় বিনোদন। কারণ এখানে জীবনের সব মৌলিক অধিকার রাষ্ট্র নিশ্চিত করে বলেই এরা বিনোদনের জন্য এমনসব কর্ম করে যেগুলো দেখলে আপনার পাগলের বা মাতালের কাজ মনে হবে।

না পাওয়া কোনো কিছুর জন্য আকাঙ্ক্ষা আসলে আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। আর এখানে সবকিছুই অনেক বেশি গোছানো এবং সুন্দর তাই কোনো কিছুকে আর আলাদাভাবে সুন্দর মনে হয় না। আসলে অসুন্দরের পাশেই কেবল সুন্দরের আসল সৌন্দর্য ধরা পড়ে। তাই এই সুন্দরকে বলি ফাঁপা সুন্দর যার ভেতরটা অন্তঃসারশূন্য। ঠিক যেমন প্রবাস জীবনে সবকিছুর নিরাপত্তা থাকলেও জীবনের কোনো বোধ থাকে না। দিনে দিনে সবাই এক একজন অনুভূতিহীন যন্ত্রে পরিণত হয়।

এমআরএম/এএসএম