ভিডিও EN
  1. Home/
  2. প্রবাস

ভিভিডের আলোয় সিডনি যেন হয়ে উঠে রূপকথার মায়াপুরী

মো. ইয়াকুব আলী | প্রকাশিত: ১১:০০ এএম, ০৫ জুন ২০২৪

ভিভিড সিডনি প্রতি বছর সিডনিকে রূপকথার মায়া পুরিতে বদলে দেয়। এখানে একইসাথে সৃজনশীলতা, উদ্ভাবন এবং প্রযুক্তির সমন্বয়ে বর্ণীল আলোয় পুরো সিডনি শহরকে আলোকিত করা হয়। এটি রাতের সিডনিকে জীবন্ত করে তোলে। বছরের এই সময়টা শীতের প্রকোপে সিডনি শহর ঝিমিয়ে পড়ে।

সেইসাথে ঝিমিয়ে পড়ে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বিশেষ করে খাবার দোকানগুলো। ফলে পুরো অর্থনীতিই একটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। তখন তিন সপ্তাহের অধিক সময় ধরে চলা এই আলোর ঝলকানি একদিকে যেমন মানুষকে বিনোদন দেয়। অন্যদিকে অর্থনীতিকেও চাঙা করে।

এবার এই আলোর ঝলকানি শুরু হয়েছে ২৪শে মে থাকবে ১৫ জুন পর্যন্ত। এবারের ভিভিড সিডনির থিম হচ্ছে হিউম্যানিটি তথা মানবতা। আরেকটু বিস্তারিত বললে, আমাদের একে অপরকে আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজন। আমরা কে এবং আমরা কী করতে সক্ষম তা খুঁজে বের করার জন্য আমাদের কেবল নিজের ভিতরে তাকাতে হবে। সেই জিনিসগুলি খুঁজে পেতে ভেতরে তাকাতে হবে যা আমাদের প্রকৃত মানুষ করে তোলে যেমন-প্রেম, দয়া, মমতা, সৃজনশীলতা ও মানবতা।

ভিভিডের আলোয় সিডনি যেন হয়ে উঠে রূপকথার মায়াপুরীভিভিডের আলোয় জীবন্ত কাস্টমস হাউসের দেয়াল

ভিভিড সিডনি ডেস্টিনেশন এনএসডব্লিউ এবং নিউ সাউথ ওয়েলস সরকারের পর্যটন সংস্থার অধীন, পরিচালিত হয়। ভিভিড সিডনি আইএফইএ পিনাকল অ্যাওয়ার্ডস ২০২৩ এ ১৭টি পুরস্কার জিতেছে। এছাড়াও ভিভিড সিডনি ২০১৩, ২০১৪, ২০১৫, ২০১৭, ২০১৮, ২০১৯ এবং ২০২৩ সালে অস্ট্রেলিয়ার সেরা পর্যটন ইভেন্ট হিসাবে নির্বাচিত হয়েছিল।

সিডনির যেকোনো প্রান্ত থেকে আপনি এই আলোর ঝলকানি দেখা শুরু করতে পারেন। তবে পুরো ব্যাপারটা দেখতে হলে আপনাকে বেশ কয়েকদিন যেতে হবে। একদিনে সব দেখে শেষ করা যাবে না। আর মানসিক এবং শারীরিকভাবে হাঁটার প্রস্তুতি থাকতে হবে। ট্রেনে করে আপনি সেন্ট্রাল বা সার্কুলার কিয়ে স্টেশনে নামতে পারেন। তবে আমার পরামর্শ হচ্ছে আপনি সেন্ট্রাল স্টেশনে নামেন।

তারপর সেন্ট্রালের যে টানেলটা ইউটিএস এর দিকে বেরিয়ে গেছে সেটা দিয়ে বেরিয়ে পড়েন। তাহলে আপনি জনস্রোতে পড়বেন। এরপর আপনি হেঁটে হেঁটে পাওয়ার হাউজ মিউজিয়াম হয়ে ডার্লিং কোয়ার্টারে এসে পড়বেন। সেখান থেকে ডার্লিং হারবার হয়ে বারাঙ্গারু ফেরি পর্যন্ত আসবেন। তারপর ফেরিতে করে সার্কুলার কিয়েতে যাবেন।

ভিভিডের আলোয় সিডনি যেন হয়ে উঠে রূপকথার মায়াপুরীভিভিড সিডনি ২০২৪ এর লোগো

এভাবে গেলে আপনি পুরো ভিভিড সিডনির একটা ধারণা পাবেন। এরপর বাকিটা আপনাকে হেঁটে হেঁটে দেখতে হবে। পথে পথে এবার আগুন তাপানোর জন্য আগুনের ব্যবস্থা রয়েছে। আর আছে অনেক রকমের এবং স্বাদের খাবারের দোকান। এবার খাবারের দোকানের আধিক্য সবচেয়ে বেশি দেখলাম। আর পথে পথে দেখতে পারেন স্ট্রিট ম্যাজিক শো বা শুনতে পারেন স্ট্রিট মিউজিক শো।

এখানে আরেকটা বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। আমি সর্বপ্রথম ভিভিড শোতে যাই ২০১৬ সালে। তখন সব জায়গার সব আলোকসজ্জা বিনামূল্যে দেখা যেত। কিন্তু এখন প্রায় সবগুলোই টিকিট করে দেখতে হবে বিশেষ করে যেগুলো একটু বেশি জমকালো। যাইহোক ভিডিড শো বড়দের চেয়ে বাচ্চারা বেশি উপভোগ করে। আমার এখনো মনে আছে যেবার প্রথম সে গিয়েছিল সেবার সে অপেরা হাউসের গায়ে হাত দিয়ে যাচাই করে দেখেছিল যে তার গায়ের রংটা আসল না কি নকল।

সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে বের হলেই সামনে পড়বে একটা বিশালাকার জ্বলন্ত হৃদয়। তার সামনে দাঁড়িয়ে আপনি সপরিবারে ছবি তুলে নিতে পারেন। এরপর হাঁটতে শুরু করলেই রাস্তার দুইপাশে সারি সারি খাবারের দোকান। কিছু দোকান আছে আপনি অর্ডার করলে সাথে সাথেই খাবার দিয়ে দেবে। আর কিছু কিছু দোকান আছে যেখানে আপনি চাইলে নিজে নিজে খাবার বিভিন্ন পদ তৈরি করে নিতে পারবেন।

ভিভিডের আলোয় সিডনি যেন হয়ে উঠে রূপকথার মায়াপুরীভিভিড সিডনি ২০২৪ এর থিম হলো মানবতা

এছাড়াও রাস্তার দুপাশে ছোট ছোট ড্রামে আগুন রাখা হয়েছে দর্শনার্থীদের একটু উষ্ণতা দেওয়ার জন্য। এভাবে হাঁটতে হাঁটতে আপনি পাওয়ার হাউস মিউজিয়াম পর্যন্ত গেলে রাস্তাটা ঘুরে ডার্লিং কোয়ার্টারের দিকে গেছে। সেখানে রাস্তার পাশে এআই এর বেশ কিছু বেলুন আকৃতির পর্দা বসানো। আপনি পর্দার সামনে দাঁড়িয়ে সামনে রাখা লাল বোতামে চাপ দিলে এআই আপনার শারীরিক অভিব্যক্তি দেখে কবিতা রচনা করে দেবে।

সেটা দেখেই আমরা তিনজন হাসিহাসি মুখে পর্দার সামনে দাঁড়িয়ে গেলাম। আমাদের মুখের অভিব্যক্তি দেখে একটা সুন্দর কবিতা রচনা করে দিলো। এরপর কিছুদূর এগোতেই ডার্লিং কোয়ার্টারের আলোকসজ্জা চোখে পড়লো। সেখানে একটা জায়গায় জ্বলন্ত ভিভিড লেখাটা চোখে পড়লো। এছাড়াও একটা গোলাকার মঞ্চের ওপর গোলাকার আলোর বৃত্ত ক্ষণে ক্ষণে রং বদলাচ্ছিল।

পাশাপাশি বেজে চলছিল বিভিন্ন রকমের সংগীতের মূর্ছনা। একটা জায়গায় একটা গাছের মতো আকৃতির মধ্যে মনে হচ্ছিল অনেকগুলো ছাতা বন্ধ হচ্ছে এবং খুলছে। সেটা আবার একসময় দেখতে মানুষের মুখের আদল নিচ্ছিল।

ভিভিডের আলোয় সিডনি যেন হয়ে উঠে রূপকথার মায়াপুরী
আলোকিত হারবার ব্রিজ এবং অপেরা হাউস দেখে চাঁদ কি লজ্জা পেল

এরপর কিছুদূর এগোতেই ডারলিং হারবারের পানিতে আলোর নাচন চোখে পড়লো। প্রথমে ফোয়ারার মতো করে পানিকে শূন্যে ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে। আর তার ওপর বিভিন্ন কোণে আলো ফেলা হচ্ছে। এতে করে বিভিন্ন রকমের আকৃতির আলোকচ্ছটা তৈরি হচ্ছে। কখনও বাঁকা চাঁদ আবার কখনওবা সবুজ উদ্ভিদ। পাশাপাশি চলছে সংগীতের মূর্ছনা। এটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আমাদের গায়ে হারবারের ঠান্ডা পানির পরশ এসে লাগলো।

এরপর আমরা এগোতে থাকলাম বারাংগারুর দিকে। সেখানে যেতে কোকোল যে হার্ফে দেখলাম একটা বেলন আকৃতি ফুলিয়ে রাখা হয়েছে। সেখানে মোট পাঁচজন মানুষ হাতে হাত এবং মাথায় মাথা মিলিয়ে একটা গম্বুজের মতো আকৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা এর ভেতরে যেয়ে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। কারণ মানুষগুলোর অভিব্যক্তি আলোর রং বদলের সাথে সাথে বদলে যাচ্ছিল বলে আমাদের কাছে মনে হচ্ছিল।

এরপর আমরা বারাংগারু এসে ফেরিতে উঠলাম। উদ্দেশ্য সার্কুলার কিয়েতে যাওয়া। রাতের ফেরি থেকে সিডনি শহরের আসল সৌন্দর্য দেখা যায়। পানিতে পুরো শহরের ছায়া পড়ে আসলেই একটা সত্যিকারের মায়াপুরী তৈরি করে। পানির উপরে সোজা শহর আর পানির মধ্যে উল্টো শহর। এই দৃশ্য আমি যতবারই দেখি ততবারই নুতন মনে হয় আমার কাছে। সার্কুলার কিয়েতে যেতে যেতে রাতের সিডনি শহরের কিছু ছবি তুলে নিলাম।

ভিভিডের আলোয় সিডনি যেন হয়ে উঠে রূপকথার মায়াপুরীডারলিং কোয়ার্টারের আলোকসজ্জা

আলোকিত সিডনি শহরের উপরে চাঁদকে দেখে অনেকটা অসহায় লাগছিল। চাঁদের প্রাকৃতিক আলো যেন বৈদ্যুতিক এই আলোকচ্ছটার কাছে হার মেনেছে। সেদিন ছিল পূর্ণিমার পরদিন তাই চাঁদের উজ্জ্বলতাও ছিল অনেক তবুও ভূমির এই আলোকচ্ছটা থেকে কজনই আর দৃষ্টি ফিরিয়ে চাঁদকে দেখবে।

এরপর আমরা ধনুকের আকারের আলোকিত হারবার ব্রিজ দেখতে পেলাম। তার নিচ দিয়ে দেখা যাচ্ছিল আলোকিত অপেরা হাউস। আমরা ব্রিজ পার হবার সময় দেখলাম ব্রিজের দুপাশের পিলারেও চলছে আলোর খেলা। আর অপেরা হাউসের কাছে এসে দেখলাম তার জীবন্ত দেয়ালে আলোর খেলা। সেখানে অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাস ঐতিহ্য থেকে শুরু করে কৃষ্টি, সংস্কৃতি সবকিছুরই প্রদর্শনী চলছে। আর তার প্রতিবিম্ব পানিতে পড়ে তৈরি হচ্ছে আরও মোহনীয় পরিবেশ। আর সিডনি টাওয়ার থেকে ফেলা হচ্ছে সাতরঙের আলোর রশ্মি। যেটা ছোটবেলায় পড়া বে-নি-আ-স-হ-ক-লা'র কথা মনেকরিয়ে দিল।

এরপর আমরা ফেরি থেকে নেমে সার্কুলার কিয়ের সাথে লাগানো কাস্টমস হাউস বিল্ডিংয়ের দেয়ালে আলোর খেলা দেখলাম। সেখানে ভবিষ্যতের পৃথিবী দেখানো হচ্ছে। যেখানে পৃথিবীর নিয়ন্ত্ৰণ নিয়ে নিয়েছে যন্ত্র। এরপর আমরা মিউজিয়াম অব কনটেম্পোরারি আর্টসের দেয়ালে দেখলাম সিডনির সব ঐতিহ্যবাহী জায়গা এবং পশুপাখি। সেখানকার শো টা শেষ হলো উড়ন্ত প্রজাপতি দিয়ে। আমরা জীবনেও এতো বড় উড়ন্ত প্রজাপতি দেখিনি।

ভিভিডের আলোয় সিডনি যেন হয়ে উঠে রূপকথার মায়াপুরীডারলিং হারবারের পানির নাচন

এরপর কোণার জায়গাটার মধ্যে মানুষ আকৃতির কিছু আলোকদন্ড বসানো ছিল। নিয়ম হচ্ছে তার মধ্যে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা। আমরাও সেই আকৃতিগুলোর মধ্যে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে নিলাম। এভাবে হাঁটাহাঁটি করতে করতে আমাদের পেট ক্ষিধেয় চোঁচোঁ করছিল। তাই আবার সার্কুলার কিয়েতে ফিরে আসলাম। সেখানকার হাংগ্রি জ্যাকস থেকে খাবার নিয়ে আবার আমরা কাস্টমস হাউসের সামনে বেদিতে বসে পড়লাম। এরপর খাবার শেষ করে আমরা ফেরার ট্রেনে চড়ে বসলাম।

পুরো সময়টা বাচ্চা দুটো হাঁটাহাঁটি করা নিয়ে অভিযোগ করে যাচ্ছিল। কিন্তু ট্রেনে উঠে বললো, বাবা তোমাকে ধন্যবাদ আমাদের নিয়ে আসার জন্য। সেদিন ছিল ভিভিডের একদম প্রথম দিন তাই ভিড় অনেক কম ছিল। তাই আমাদের হাঁটতে তেমন বেগ পেতে হয়নি। তাই আমার সাজেশন হচ্ছে ওয়ার্কিং ডে’তে গেলে একটু ধীরস্থিরভাবে আলোর খেলা উপভোগ করা যাবে। সপ্তাহান্তে গেলে পা ফেলার জায়গা থাকে না।

আর এইবার ড্রোন শো ‘লাভ ইজ ইন দ্য এয়ার’ রাখা হয়েছে মাত্র তিন দিন, ৮, ৯ এবং ১৫ই জুন। এই তিন দিনের কোনো একদিন গেলে আপনাকে অবশ্যই রাত নয়টার মধ্যে সার্কুলার কিয়েতে ফিরে আসতে হবে কারণ ড্রোন শো শুরু হয় ঠিক নয়টা দশ মিনিটে চলে মাত্র দশ মিনিট সময় ধরে। ড্রোন শো টা এখন পর্যন্ত আমার কাছে ভিভিডের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ বলে মনে হয়েছে। তাহলে আর দেরি কেন, আপনিও আপনার পরিবার নিয়ে আজই বেরিয়ে পড়ুন রূপকথার মায়াপুরীতে একরাত ঘোরার জন্য।

এমআরএম/এএসএম