ভাই, সিনেমা হলে টিভি কয়ডা?
‘দোস্ত, তোর জুতা কই’ নামে শৈশবের স্মৃতিকথা লিখতে গিয়ে ছোটন ভাইয়ের কথা আসছিল। বলেছিলাম যে, ছোটন ভাই সম্পর্কে অন্য একদিন লিখবো। এর মধ্যেই আজকে লেলিন আমাকে ফোন দিলো। বললো, তুই ছোটন ভাইকে নিয়ে কিছু একটা লেখ। ছোটন ভাইকে নিয়ে আমাদের অনেক মজার মজার স্মৃতি আছে। আমাদের শৈশবের নায়ক ছোটন ভাই। আমার কাছে এখনও তাই।
তার পুরো নাম জাকির হোসেন ছোটন। তারা দুই ভাই। আর একজনের নাম ইকবাল হোসেন। তাদের বাবা দুলাল হোসেন সবার কাছে খুব পরিচিত ব্যক্তি ছিলেন। বলে রাখা ভালো, তারা দু’জনেই সম্পর্কে আমার মামাতো ভাই। আমার নানার আপন বড় ভাইয়ের নাতি। যতটুকু মনে পড়ে, মামা মারা যাওয়ার আগে দুই ছেলেকে আদর করে ডাকতেন, বাবা, জাকির হোসেন ছোটন আর ইকবাল হোসেন নোটন, এদিকে আসো। মামা ১৯৮৯-৯০ সালের দিকে মারা যান। মামা মারা যাওয়ার পর ইকবালের নোটন নামটি হারিয়ে যায়। তবে আমি মাঝে মাঝে মজা করে ইকবাল হোসেন নোটন বলে ডাকি। ইকবাল আমার সমবয়সী, ভাই ও বন্ধু।
মামার মৃত্যুর পর ছোটন ভাইকে তার বড় চাচা মল্লিক মামা লেখাপড়া করানোর জন্য কিশোরগঞ্জ নিয়ে গেলেন। সেখানে ছোটন ভাই বেশ কয়েক বছর থাকার পর তার দাদার সঙ্গে একদিন গ্রামের বাড়ি ফিরে এলেন। সময়টা তখন খুব সম্ভবত ১৯৯৩ সাল। ছোটন ভাই বাড়িতে এসেই খুব সহজেই সবার মধ্যমণি হয়ে গেলেন। এই বেশ কয়েক বছর শহরে থাকার কারণে তিনি সবার চেয়ে একদম আলাদা ছিলেন। পোশাকের ব্যাপারে খুব যত্নশীল ছিলেন। তার মাধ্যমেই ব্যান্ড সংগীতের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটেছিল।
তিনি তখন আজম খান, আইয়ুব বাচ্চু, পার্থ বড়ুয়া, নকীব খান আর খালিদের গান গাইতেন। সে সময় স্টেরিও টেপের যুগ ছিল। ক্যাসেটে এসব ব্যান্ডের গান শুনতাম। ছোটন ভাইয়ের নেতৃত্বে আমাদের পাঁচজনের একটা দল হয়ে গেলো। আমি, আমার ভাই আজহার, আরমান মামা, ছোটন ভাই আর ইকবাল। তবে আমি আর ইকবাল একটু ছোট হওয়ায় সবকিছুতে আমাদের সঙ্গে নিতে চাইতো না। তবে সারাদিন আঠার মতো লেগে থাকতাম। সারাদিন টই টই করে ঘুরে বেড়াতাম আর সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার সময় পিঠে ছালা বেঁধে বাড়ি ফিরতাম।
কেননা বাড়িতে আসার আগেই এক ডজন বিচার এসে বাবা-মায়ের কাছে জমা হতো। তবে বিচার এড়াতে আমি হাত-পা ধুয়েই দ্রুত বই নিয়ে টেবিলে বসে পড়তাম আর জোরে জোরে পড়তাম। তারপরেও নানা রকমের শাস্তি বরাদ্দ ছিল।
এ কথা সত্য যে, ছোটন ভাই বারবার আমাকে ঝামেলায় ফেলাতো তারপরেও ভাইয়ের সঙ্গে ঘুরতাম। বড় পর্দায় সিনেমা দেখার হাতেখড়ি ছোটন ভাইয়ের মাধ্যমে। আজ বলতে দ্বিধা নেই তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বিড়ি-সিগারেটের প্রথম হাতেখড়িও ছোটন ভাইয়ের হাতে। তবে সেসব ছিল স্রেফ মজা করার জন্য। সেই সময়েই গোল্ড লিফ আর বেনসন সিগারেটের গল্প শুনতাম। তিনি বলতেন আর আমরা মন্ত্রমুগ্ধের চেয়ে থাকতাম। মনে মনে ভাবতাম, আমার যখন অনেক টাকা হবে তখন শুধু বেনসন সিগারেটই খাবো। কেননা বেনসন সিগারেট বড়লোকদের খাবার! সময়ের ফেরে চা-পান-বিড়ি-সিগারেট কোনওটাই খাওয়া হয় না।
ছোটন ভাইয়ের কাছে কিশোরগঞ্জ শহরের মানসী সিনেমা হলের গল্প শুনতাম। একদিন বায়না ধরে বললাম, ভাই, আমারে একটু সিনেমা হলে লইয়্যা যাইবা? ছোটন ভাই বলতো, তুই ছোডু মানুষ। হলে গিয়া কী করবি? তারপরেও বলতাম, না ভাই, একটা ছবি দেহাও না! আমার পিড়াপীড়িতে তিনি একদিন রাজি হলেন। সময়টা তখন ১৯৯৪-১৯৯৫ সাল। পাকুন্দিয়ায় মৌসুমি হলে সোহেল রানা, রুবেল, শাবানা, রিমা আর হুমায়ূন ফরিদী অভিনীত ‘চোখের পানি’ নামে একটি সিনেমা চলছে। সিনেমা আসার আগে রিকশা করে মাইকিং করা হতো। রিকশার পেছনে পেছনে দৌড়াতাম আর ভাবতাম কবে হলে গিয়ে সিনেমা দেখবো!
সিনেমার বিজ্ঞাপনের পর ছোটন ভাই বললেন, ল যাই, সিনেমা দেহি। কিন্তু কাউকে কইতারবিনা কিন্তু! আমি কইলাম আচ্ছা। এরপর টিকিট কেনার টাকা যোগাড়ের পালা। ২৫০ গ্রাম মুক্তা ধানের চাল আর গাছ থেকে সুপারি বিক্রি করে ছোটন ভাইকে সাড়ে তিন টাকা দিলাম। চাল তখন ৬ টাকা কেজি ছিল। দেড় টাকার চাল আর দুই টাকার সুপারি- সব মিলে সাড়ে তিন টাকা।
ছোটন ভাইও সুপারি বিক্রি করে বাকি টাকা যোগাড় করলেন। সিনেমার থার্ড ক্লাস টিকিট ছিল মাত্র সাড়ে পাঁচ টাকা। টাকা যোগাড়ের পর দু’জনে হেঁটে রওনা দিলাম। বাড়ি থেকে সিনেমা হলের দুরত্ব প্রায় ৬ কিলোমিটার। মৌসুমি হলে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই, হলে টিভি কয়ডা? ছোটন ভাই মুচকি হাসে আর বলে, আগে ল যাই, এরফরে দেহিছ টিভি কয়ডা!
সিনেমা হলে দিয়ে দেখি মানুষ আর মানুষ! টিকিট কাটার কোনো সুযোগ নাই। তারপরেও ছোটন ভাই প্রচণ্ড ভীড় ঠেলে অরাধ্য দুটো টিকিট কাটলেন। তখন এমনও সময় ছিল মানুষ হাতে ব্লেড নিয়ে যেতো টিকিট কাটার জন্য। বেশি ঝামেলা হলে সামনের সারিতে টিকিটের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা দর্শকের হাতে ব্লেড দিয়ে ছোট্ট একটা টান দেওয়া হত যেনও সে তার জায়গা ছেড়ে দেয়।
আরও বলে রাখা ভালো, আমাদের আশপাশের বেশ কয়েক থানায় পাকুন্দিয়ার মৌসুমি সিনেমা হলের প্রচণ্ড নামডাক ছিল।
টিকিট কেটে দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষা করার পর সবার সামনের দিকের সিটে গিয়ে বসতে পারলাম। চোখের সামনে বিশাল আকারের একটা কালো পর্দা। ঠিক সাড়ে ১২টায় পর্দাটা দু’ভাগ হয়ে দু’দিকে সরে যাচ্ছে। আমার চোখে সে কী বিস্ময়! কীভাবে সম্ভব? এরপর দেখা গেলো বিশাল এক সাদা টিভি! সেই টিভিতে রঙিন লাইটের মাধ্যমে ছবি ভেসে উঠতে থাকলো!
আমি অবাক বিস্ময়ে একবার লাইট আর একবার পর্দার দিকে তাকাই! আমার আর ঘোর কাটে না! এরপর ছোটন ভাই সব বুঝিয়ে বললো কীভাবে সিনেমা হলে টিকিট কাটতে হয়, কীভাবে হলে সিনেমা দেখায়, কীভাবে সিটে বসতে হয়, আরও কতো কী! তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই সিটে কীভাবে বসতে হয় জ্ঞান দেওয়া মানুষটিই পরে একদিন সিনেমা দেখতে গিয়ে সিট ভেবে এক মেয়ের কোলের ওপর বসে পড়েছিলেন!
চোখ না সরিয়ে অবাক বিস্ময়ে তিন ঘণ্টার ছবি দেখলাম। সেই থেকে ছবির প্রতি এত প্রেম, এত ভালোবাসা। যখন কেউ বাংলা ছবিকে খারাপ বলে আমার খুব কষ্ট অনুভূত হয়। ছবি দেখে বাড়ি ফিরলাম। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। বাড়িতে আসতেই তো আব্বার রুদ্রমূর্তি! রেগেমেগে একেবারে আগুন হয়ে গেছে। আব্বা জিজ্ঞেস করলো, কই গেছিলি? আমি বললাম, ইস্কুলে গেছিলাম। আব্বা জোর দিয়া কইলো, সত্য কথা ক। কই গেছিলি? অবস্থা বেগতিক দেখে বললাম, মজিদ নানার বাড়িতে গেছিলাম। মজিদ নানা আম্মার মামা ছিলেন।
এরপর শুরু হলো মাইর। সিনেমা দেখার স্বাদ একেবারে মিটিয়ে দিয়েছে। সঙ্গে যুক্ত হলো তিনদিন বাড়িতে ভাত না খেতে পারার শাস্তি। আব্বা আম্মাকে স্পষ্ট বলে দিলো, এই পুলারে তিনদিন কোনো ভাত দিবা না। যেই কথা সেই কাজ। আমার ভাত বন্ধ। এই তিনদিন নানু আমাকে খাবার দিয়েছেন। বাড়িতে সত্যিই ভাত পাইনি।
তিনদিন পর ছোটন ভাই মুচকি হেসে আমাকে জিজ্ঞেস করেন, কীরে সিনেমার মজা কিমুন বুঝলে? পরে জানতে পারলাম ছোটন ভাই নিজেই বাড়িতে বলে দিয়েছে যে আমি মৌসুমি হলে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম। এরপর বহুবার আমকে ফুসলিয়ে হলে সিনেমা দেখাতে নিয়ে যেতেন আর বাড়ি এসে বলে দিতেন।
তাপরেও ছোটন ভাইয়ের সাথে সিনেমা দেখতে যেতাম। আমাদের শৈশবে ছোটন ভাই এমন এক মজার চরিত্র যে বলার মতো না। তার অসংখ্য গল্প আছে। আমি যদি কখনও শৈশবের স্মৃতি নিয়ে কোনও গ্রন্থ লিখি তবে সেই গ্রন্থের অবধারিত কেন্দ্রীয় চরিত্র হবেন ছোটন ভাই।
এমআরএম/জেআইএম