রানা প্লাজা
এখনো লাশের গন্ধ পাই
অনেক টালবাহানা করে অবশেষে সরকারি চাকরিতে যোগদান করলাম। বহুজাতিক মোবাইল কোম্পানি বাংলালিংকে থাকাকালে আফ্রিকার দেশ মালাউতে বড় অংকের বেতনের অফার পেয়ে কোনো চিন্তাভাবনা না করেই হুট করে চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে দিলাম। এরপর সেই কোম্পানির বাংলাদেশি মাতাল মালিকের খপ্পরে পড়লাম। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও আর শেষ পর্যন্ত যাওয়া হলো না। তাই বাধ্য হয়েই হাতের পাঁচ সরকারি চাকরিতে যোগদান করতে হলো। পাস করার পরপরই আবেগের বশবর্তী হয়ে সৎ থাকার তাগিদে টেলিকমে যোগদান করেছিলাম।
অবশ্য টেলিকমের বেশি বেতন, গাড়িও একটা প্রেরণা জুগিয়েছিল। অবশেষে যখন বুঝেছিলাম টেলিকম বেশিদিন পুরকৌশলীদের পুষবে না। তখন বিদেশে আসার চেষ্টার পাশাপাশি বিসিএস দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। আগের দুইবারও যোগ্য নির্বাচিত হয়ে যোগদান করিনি। কিন্তু এইবার বাধ্য হয়েই স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরে সহকারী প্রকৌশলী হিসাবে যোগদান করলাম। কারণ সরকারি চাকরি পাওয়া কঠিন কিন্তু যাওয়া অসম্ভব। আর অনেকেরই প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরির প্রতি অনেক মোহ থাকে যদিও আমার সেটা ছিল না মোটেও। মোবাইল কোম্পানিতে চাকরির সুবাদে সারা বাংলাদেশ ঘুরে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। তখন জেনেছিলাম বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ঠিক কতটা পরিশ্রমী। তারপরও কেন বাংলাদেশের মানুষের সার্বিক জীবনমানের উন্নয়ন কেন হয় না সেটা বুঝেছিলাম সরকারি চাকরিতে যোগদান করে।
বুয়েটের সিভিল ডিপার্টমেন্টে পড়তে গিয়ে জেনেছিলাম এটা বিশ্বের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে অন্যতম বড় ডিপার্টমেন্ট। কারণ বুয়েটের সিভিলের মতো এত ডক্টরেট করা শিক্ষক বিশ্বের আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ডিপার্টমেন্টে আছে কি না সন্দেহ আছে। অন্যান্য বিষয়ের শিক্ষকেরা উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশে গিয়ে আর ফিরে আসুন বা না আসুন সিভিলের শিক্ষকেরা অবধারিতভাবেই ফিরে আসেন।
কারণ দেশে তাদের জন্য উপরি আয়ের এক বিশাল ক্ষেত্র। বিভিন্ন ফার্মের কনসালটেন্সি করেই তারা গাদা গাদা টাকার মালিক হয়ে যান। পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্লাস নিয়েও অনেক টাকা যায় করা যায়। যাইহোক আমাদের শিক্ষকেরা বলতেন, ভূমির ওপরে পৃথিবীর বুকে চারপাশে গাছপালা ছাড়া মানুষ নির্মিত যাকিছুই দেখো না কেন সবই আমাদের কর্মের পরিধির মধ্যে পড়ে।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) এর হেড অফিস আগারগাঁও থেকে আমাকে পোস্টিং দেওয়া হলো সাভার উপজেলার সহকারী প্রকৌশলী হিসাবে। আমি নির্দেশ হাতে পেয়েই সাভারে যাওয়ার জন্য আগারগাঁও মোড়ে দাঁড়ালাম। পরিকল্পনা হচ্ছে এখান থেকে বাসে করে একবারে সাভার চলে যাওয়া। অনেক অপেক্ষা করেও সাভারে যাওয়ার কোনো বাস পেলাম না।
এভাবে প্রায় অর্ধেকদিন পেরিয়ে গেলে সাভার উপজেলার উপজেলা প্রকৌশলীকে মোবাইলে কল দিলাম। বললাম, স্যার অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি কিন্তু কোনো বাস পাচ্ছি না। স্যার বললেন, তোমার আজ আর এদিকে আসা হবে না। এখানে রানা প্লাজা বলে একটা গার্মেন্ট ধ্বসে পড়ে হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে। তাই পরিস্থিতি উত্তপ্ত। ফলে বাস চলাচলও বন্ধ হয়ে গেছে। এভাবেই রানা প্লাজা আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে গেলো।
পরদিন আব্দুল্লাহপুর থেকে সাভারের বাসে উঠে বসলাম। সেই বাস সাভারে মূল স্টপেজের আগেই আমাদের নামিয়ে দিলো। রানা প্লাজায় স্বজনহারানো মানুষদের কারণে আর সামনে যাওয়া যাবে না। এরপর হেঁটে হেঁটে এগুতে থাকলাম। একটু পর দেখি বিপরীত দিক থেকে মানুষের স্রোত দৌড়ে আমাদের দিকে আসছে। রানা প্লাজার কাছে পুলিশের তাড়া খেয়ে তারা এদিকে দৌড়াচ্ছে। আমরা দ্রুতই পাশের একটা গলিতে ঢুকে পড়লাম। সেখানেও একটু পর শুনি মানুষের হৈহৈ রব।
আবার দৌড়াতে শুরু করলাম। মনে হচ্ছিল যেন কোনো হলিউড ছবির সেটে ঢুকে পড়েছি। এভাবে দৌড় উল্টো দৌড় করতে একটা সময় একটা গলিতে এসে আশ্রয় নিলাম। তারপর সেখান থেকে রিকশা করে উপজেলা অফিসে পৌঁছালাম। সেখানে গিয়ে দেখি উপজেলা প্রকৌশলীর অফিস লোকজনে ঠাসা। তার মধ্যেই তাকে আমার অফিস অর্ডার দেখিয়ে যোগদান করলাম।
এরপর প্রতিদিনই একইভাবে দৌড় উল্টোদৌড় করে অফিসে যাই। আর প্রতিদিনই শুনি লাশের মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। আর প্রতিদিনই ঢাকা থেকে বড় বড় দায়িত্বশীল মানুষেরা এসে আমাদের অফিসে বসে চা নাস্তা খেয়ে যান। উপজেলা প্রকৌশলী মহোদয় তাদের এন্টারটেইন করতেই সারাদিন ব্যস্ত থাকেন। আর আমি উপসহকারী প্রকৌশলীদের হোন্ডার পেছনে চড়ে সাইট থেকে সাইটে কাজ পরিদর্শন করে বেড়াই।
আর ভাবি এভাবেই হয়তোবা কোনো প্রকৌশলী রানা প্লাজার কাজও নিশ্চয় পরিদর্শন করেছিলেন। তিনিও কি ডিজাইনের সাথে বাস্তবের কাজের তফাৎটা মালিককে ধরিয়ে দেননি। না কি মালিক প্রকৌশলীর চোখ ফাঁকি দিয়ে শুধু রাজমিস্ত্রি দিয়েই কাজ চালিয়ে নিয়েছিল। যদি সেটাও হয় তাহলে অত্র এলাকার ভবন নির্মাণের তদারককারী প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশীলরা কি করেছিলেন তখন। না কি তারা টাকার কাছে বিক্রি হয়ে গিয়েছিলেন।
উদ্ধার অভিযান চলতে থাকলো। মানুষের আবেগও থিতিয়ে আসতে শুরু করলো। তবে আসলেই কি স্বজনহারা মানুষদের আবেগ থিতিয়ে আসে? এরপর একেবারে শেষের দিকে মঞ্চস্থ হয় জীবিত একজনকে উদ্ধারের সাজানো নাটক। কি অদ্ভুত আমাদের সরকার, কি মজার তার আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী আর কি অবাস্তব তাদের সাজানো নাটক।
শুরুতে মানুষ বিশ্বাস করলেও মানুষের ভুল ভাঙতে সময় লাগেনি। এরপর শুরু হলো মামলা মামলা খেলা। রানা প্লাজার মালিকের ছেলে সোহেল রানার সাথে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের সম্পৃক্ততা ছিল এটা সাভারের সবাই জানে। সাভারের তখনকার এম পি মুরাদ জং তাই শুরু থেকেই সোহেল রানার পক্ষ নিয়েছিল। কিন্তু পরিস্থিতি রাতারাতি বদলে গেলে বিচারাধীন সোহেল রানার স্থান হয় কারাগারে আর মুরাদ জং নিক্ষিপ্ত হন আস্তাকুড়ে। এখন পর্যন্ত সে সেই আস্তাকুড়ে থেকে উঠে আসতে পারেনি আর পারবে এমন সম্ভাবনাও ক্ষীণ।
বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা এবং বিচার বিভাগের দীর্ঘসূত্রিতা নিয়ে আলাদাভাবে কিছু বলতে চাই না। মামলাগুলোর কি অগ্রগতি হচ্ছে পত্রিকার পাতায় সেটা একটা সময় নিয়মিত ফলোআপ করতাম। এরপর সময় গড়িয়ে গেলো। পত্রিকার পাতা ঘাটতে ঘাটতে রানা প্লাজা ধ্বসের সাম্প্রতিক খবর পেলাম। এগারো বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো খুনের মামলার বিচারকাজ শেষ হয়নি। কবে হবে তারও কোনো হিসাব নেই।
বেশিরভাগ আসামিই জামিনে বেরিয়ে এসেছে। রান্না প্লাজায় যারা যারা মারা গিয়েছিলেন তারা নিজেদের সৌভাগ্যবান ভাবতেই পারেন কারণ তাদের এই মশকরা দেখতে হচ্ছে না। কিন্তু যারা পঙ্গুত্ব বরণ করে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তাদের মনের মধ্যে কি হচ্ছে আমার জানা নেই। অবশ্য বাংলাদেশের খেটে খাওয়া মানুষ বরাবরই অদৃষ্টবাদী। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস কেউ একজন আছেন যিনি সব দেখছেন। তিনিই সকল অবিচারের সঠিক বিচার করবেন। কিন্তু তারা জানে না যে সেই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী অস্তিত্বও বড়লোকদেরই প্রতিভূ।
আমি আমার বিভিন্ন লেখায় বলেছি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছেন সরাসরি তিন পেশার মানুষ। গামেন্টসের কর্মীরা, কৃষকেরা আর প্রবাসী শ্রমিকেরা। প্রবাসী শ্রমিকদের আমরা বিমানবন্দরে হেনস্তা করে পুরস্কৃত করি। কৃষককে চাষা বলে গালি দিয়ে শান্তি খুঁজি। আর গামের্ন্টসে কাজ করা মানুষগুলোকে আমরা কোনোদিনই মানুষ হিসাবে গণ্য করি না। আমরা একটাবারের জন্যও ভেবে দেখি না তারা এই সামান্য বেতনে ঠিক কীভাবে বেঁচে আছে।
জীবনের ন্যূনতম মৌলিক প্রয়োজনগুলো কি এই বেতনে পূরণ করা আদৌ সম্ভব? আর রাস্তা ঘাটে তাদের দেখলে আমরা এমনভাবে গা বাঁচিয়ে চলি যেন তাদের ছোঁয়া লাগলে আমরা অপবিত্র হয়ে যাবো। কিন্তু তাদেরই শ্রমের ঘামের ফসল আমাদের গায়ের সস্তাদামের সুন্দর পোশাকটা।
‘গ্লোবাল ডাটা’ তথ্যমতে ২০২১ সালের জনসংখ্যার হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশ বিশ্বের দশম সর্বোচ্চ ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। এখানে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে বাস করে ১২৭৭.৬ জন মানুষ। ‘ম্যাক্রোট্রেন্ডস’ তথ্য অনুসারে শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই বাস করে প্রায় দুই কোটি চল্লিশ লাখ মানুষ। এতো কম জায়গায় এতো মানুষ বিশ্বের আর খুব কম দেশেই বাস করে। সেইসব মানুষদের কর্মের জোগাড় করতে গিয়ে এই শহর দিনে দিনে হাঁপিয়ে উঠেছে।
এই শহর থেকে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের নামে আমাদের আমলারা বরাবরই টালবাহানা করে। কারণ তাদের সবসময়ই ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকতে হবে নাহলে রাষ্ট্রীয় সম্পদের ভাগাভাগিতে নিজেদের ভাগে কম পড়ে যেতে পারে। বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থার আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত। আর তার ভুক্তভোগী খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ যারা নিজেদের অধিকার সম্মন্ধে কোনোদিনই সচেতন ছিলেন না।
বাংলাদেশের একজন শিক্ষিত মানুষ হিসাবে, একজন পুরকৌশলী হিসাবে রানা প্লাজা ধ্বসের দায় আমার ওপরও কিছুটা বর্তায়। স্বজনহারা মানুষের দীর্ঘশ্বাসের আঁচ আমার গায়েও কিছুটা লাগে। পঙ্গুত্ব বরণ করা হাজার হাজার মানুষের অভিসম্পাত কিছুটা হলেও আমাকে আতঙ্কিত করে। সে সময় কত রাতে ঘুম ভেঙে গেছে দুঃস্বপ্ন দেখে। কি ভয়ঙ্কর ছিল সেইসব স্বপ্ন। আমি শুধু ভাবি আমি তো সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হইনি তারপরও এই দশা তাহলে যারা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারা কীভাবে বেঁচে আছেন। সাভার উপজেলা থেকে রিকশা নিয়ে সাভার বাসস্ট্যান্ডে আসা যাওয়া করতে হতো রানা প্লাজার সামনের রাস্তা দিয়ে।
রিকশা যখনই গলি থেকে মূল রাস্তায় উঠে বাসস্ট্যান্ডের দিকে যেতে শুরু করতো আমি আর ভুল করেও ডানে তাকাতাম না কারণ আমি ভীষণ দুর্বলচিত্তের মানুষ। কিন্তু রিকশা রানা প্লাজার কাছে আসতেই একটা অপরিচিত গন্ধ নাকে এসে লাগতো। যতক্ষণ রিকশাটা রানা প্লাজা পার হতো এই গন্ধ নাকে লেগেই থাকতো।
এমনকি রানা প্লাজা পেরিয়ে গেলেও গন্ধটা নাকে আঠার মতো লেগেই থাকতো। বাসায় গিয়ে প্রথমেই নাকে পানি দিয়ে পরিষ্কার করতাম। সেই প্রথম আমি জেনেছিলাম মরা মানুষের লাশ পঁচে গেলে তার গন্ধ কেমন হয়। এখনও মাঝে মাঝে নাকে এসে লাগে সেই গন্ধ। কিন্তু যার বা যাদের গাফিলতির কারণে এতগুলো মানুষ মুহূর্তেই লাশ হয়ে গেলো তাদের মনে হয় নাক বলে কোনো কিছু নেই তাদের শরীরে।
এমআরএম/এএসএম